Monday, November 30, 2015

সিয়াম (রোজা)


সিয়াম (রোজা)


সুবেহ সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার (খাদ্য গ্রহণ) হতে বিরত রেখে, যৌন অশীলকাজ হতে বিরত থেকে, অযথা
কথাবার্তা ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি হতে বিরত থেকে শরিয়তের নির্ধারিত বিধিসমূহ যথাযথ পালনের নামই রোজা বা সিয়াম।
সিয়াম পালনের সাথে সেহরি ও ইফতারের শর্ত যুক্ত আছে। সিয়াম পালনের মধ্যে সংযমী হওয়ার বিশেষ শিক্ষা রয়েছে।
বছরের মধ্যে ১২ মাসের একটি মাসকে সিয়াম সাধনার মাস বা রোজার মাস হিসেবে আলাহ নির্ধারণ করেছেন যাতে আমরাযাবতীয় অন্যায়, অশীলতাও নফ্সের খামখেয়ালীপনার হাত হতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হই। এই সিয়াম সাধনাখারাপ কাজ হতে বেঁচে থাকার এক অভিনব কৌশল শিক্ষা দেয়। শুধুমাত্র উপবাস বা অনাহারে থাকা নয়, বরং সংযমী হয়েইসলামের ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ যথাযথ পালনের নাম সিয়াম বা রোজা। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে সিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণস্তম্ভ। ইসলামে প্রতি বছরের মধ্যে ইহাকে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। মানুষ নিজের নফ্সের ইচ্ছাধীন থাকতেচায়। এরূপ চলতে থাকলে দিনের পর দিন মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তাই সিয়ামের বিধান ঐরূপ একঘেঁয়েমি ওনফ্সের খামখেয়ালীপনার হাত হতে নিজেকে সংযম ও সচেতনতা শিখায়। শরিয়তের এরূপ বিধান পালনে ধর্মীয়, সামাজিক ও
নিজের আত্মশুদ্ধির এমনকি দেশের কল্যাণের বিষয়টি রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠির চরিত্র সংশোধনের মধ্যে। কোরানুল মাজিদ-এর সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে আলাহসিয়ামের গুরুত্ব দিয়ে বলছেন :
ইয়া আইউহাল (ওহে) লাজিনা (যারা) আমান ু (ইমান এনেছ) কুতিবা (ফরজ করা হয়েছে) আলাইকুম (তোমাদের উপর)
সিয়াম (রোজা) কামা (যেমন) কুতিবা (ফরজ করা হয়েছিল) আলা (উপর) আললাজিনা (যারা) মিন (হতে) কাবলিকুম
(তোমাদের পূর্বে) আললাকুম্ (হয়তো তোমরা) তাত্তাকুন (তোমরা তাকওয়া কর)। (হুবহু অনুবাদ : বাবা জাহাঙ্গীর)।
“ওহে, যারা ইমান আনিয়াছ, ফরজ করা হইয়াছে তোমাদের উপর রোজা, যেমন ফরজ করা হইয়াছিল তাদের (যারা) উপর
তোমাদের পূর্ব হইতে, হয়তো (সম্ভবত) তোমরা তাকওয়াকে (গ্রহণ) করিবে।”
আমানু তথা যারা ইমান এনেছে তাদেরকে রোজার বিধানটি পালনের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে যা অবশ্যই পালনীয় এবং
যা পালনে বান্দার কল্যাণ নিহিত আছে তাকওয়া অর্জনের মধ্যে। সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে হাকিকতের তাৎপর্য তথা মর্যাদা অনেক
ঊর্ধ্বে। মানুষের মন হতে সব ধরনের জাগতিক আশা আকাক্সক্ষা দূরীভূত করার চেষ্টা হচ্ছে এক অভিনব কৌশল। মনের মধ্যে
বিভিনড়ব চাওয়া-পাওয়া লেগেই থাকে। তাদেরকে অন্তর বা দেল হতে মুছে ফেলার জন্য সর্বদা সাধনায় থাকা কর্তব্য।
সিয়াম একটি সাধন অবস্থা, যার জন্য রজমান মাসকে একটি সিয়াম সাধনের মাসও বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা কোনো মাস
হিসেবে পালনেই সীমাবদ্ধ নয় সাধকের জন্য, বরং সাধক আলাহর
সাথে মিলনের আশায় নিজের নফ্সের মধ্যে মিশে থাকা
অতি গোপন খানড়বাস নামক শয়তান তথা ছয় রিপুর (লোভ, মোহ, মাৎসর্য, কাম, μোধ, এবং অহংকার) কবল হতে নিজেকে
মুক্ত করার সাধনায় সদা সর্বদা খেয়াল রাখা কর্তব্য। নিজের মনের মধ্যে বাইরের কলুষিত বস্তুবাদ, লোভ-মোহ যাতে প্রবেশ
করে ক্ষতি সাধন করতে না পারে তার জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। সাধক যখন সিয়াম সাধন করার জন্য সচেষ্ট হয় তখনই
সিয়ামের প্রকৃত সময়। আনুষ্ঠানিক সময় নির্ধারণ করেও যদি সে-মোতাবেক সিয়াম সাধনের কার্য যথাযথ সম্পাদিত না হয় তবে
সিয়াম পালন হবে না। যে ব্যক্তি সিয়াম সাধনারত থাকে তাকে সায়েম বলা হয়। সিয়ামরত ব্যক্তির দুনিয়াবি এলেম বা
জাগতিক ব¯ু—বাদী এলেম থাকে না। জাগতিক বিষয়াদি মন হতে বাদ দেওয়ার সাধনকৌশল অবলম্বন করা একজন সায়েমের
কর্তব্য।
সিয়াম পঞ্চস্তম্ভের/ পঞ্চভিত্তির অন্যতম ভিত্তি। সিয়াম ছয় রিপুর কবল হতে মুক্ত হওয়ার হাতিয়ার। সিয়াম নিজের মধ্যে ডুব
দেওয়ার এক কৌশল। সিয়াম আত্মসংযমী হওয়ার সাধনা। সিয়াম শুধুমাত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণা হতে বিরত থাকা নয়। সিয়াম দুনিয়ার
জ্বালা-যন্ত্রণা হতে মুক্ত হওয়ার পথ। সিয়াম নিজের মধ্যে ধৈর্যগুণ সৃষ্টি করার হাতিয়ার। সিয়াম আত্মদর্শনের সাধনা। সিয়াম
নিজেকে নিজে দেখার ও চেনার সাধনা। সিয়াম ইন্দ্রিয়সমূহের লাগামহীনতাকে লাগাম দেয়ার সাধনা। সিয়াম নিজের মধ্যে
আর এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টির করার সাধনা। সিয়াম ত্যাগী হওয়ার শিক্ষা দেয়। সিয়াম অল্পে তুষ্ট হতে সাহায্য করে। সিয়াম
কামভাবকে তালা দেয়। সিয়াম নিজেকে নিজের মধ্যে পাইয়ে দেয়। সিয়াম একা হওয়ার সাধনা। সিয়াম নিজ ইচ্ছায় বস্তুমোহ,
ইহকাল ও পরকালের সুখ সম্ভোগের খায়েশ পরিত্যাগ করা শিক্ষা দেয়। সিয়াম নফসের খাময়েখালীপনাকে দূর করে দেয়।
সিয়াম আত্মিক শক্তি আনয়ন করে। সিয়াম কোনো দুর্ভেদ্য বিষয়ের উপর জয়লাভ করতে শিক্ষা দেয়। সিয়াম আপন রবের
সাথে সংযোগ স্থাপন করার সাধনা। সিয়াম তাই পুরস্কার দেয় তার আপন রবকে Ñ যে রব তার মধ্যেই বসবাস করে অতি সুপ্ত
অবস্থায় জাতরূপে (নুরে মোহাম্মদিরূপে)।
“সিয়াম পূর্ণ কর রাত্রির দিকে।” (সুরা বাকারা : ১৮৭)। সিয়াম শুধুমাত্র
পানাহার ত্যাগেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাত্রির গভীরে ধ্যানসাধনা তথা মোরাকাবা মোশাহেদা সিয়ামের একটি প্রধান অংশ। সিয়াম
পালনের জন্য রাত্রে সিয়াম সাধক জাগরণ করেন রবের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য, গভীর ধ্যানসাধনায় মগড়ব থাকেন বিশেষ
রহমতের আশায়। এই বিশেষ রহমত (রেজেক) হিসেবে যা পেয়ে থাকেন সাধক তা বস্তুগত খাবার খেয়ে যে শক্তি অর্জিত হয়
তার চেয়ে যথেষ্ট কল্যাণকর। রাত্রিতে এবাদতের একাগ্রতা ও নিবিড়তা থাকে। দিনের বেলায় কর্মব্যস্ততায় মানুষ এবাদতের
জন্য তা পায় না। আলাহ
তাঁর প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুলাহ
(সা.)-কে সম্বোধন করে সুরা মোজাম্মেল-এ রাত্রিতে জাগরণ
করতে গিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছে, সে আয়াতসমূহ জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করা প্রয়োজন। আয়াতসমূহ (সুরা মোজাম্মেল) :
(১) হে বস্ত্রাবৃত, (২) রাত্রিতে দণ্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে, (৩) অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম, (৪) অথবা
তদপেক্ষা বেশি এবং কোরান আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে, (৫) আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ
বাণী, (৬) নিশ্চয়ই এবাদতের জন্য রাত্রিতে ওঠা প্রবৃত্তি দমনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল, (৭) নিশ্চয়ই দিবাভাগে
রয়েছে আপনার কর্মব্যস্ততা, (৮) আপনি আপনার পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন এবং একাগ্রচিত্তে তাতে মগড়ব হোন।
বিশেষভাবে লক্ষনীয় (৬) নং আয়াতের মর্মবাণী সম্পর্কে। এবাদতের জন্য রাত্রি জাগরণে ‘প্রবৃত্তি দমন’ হয় বা সাহায্য করে
এবং (৭) নং আয়াতের মধ্যে দিনের ‘কর্মব্যস্ততার’ কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আরও অবাক হতে হয় এই সুরার (২০) নং
আয়াতের মর্মবাণী হতে। ২০ নং আয়াতে আছে :
“আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি এবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হন রাত্রি প্রায় দু’তীয়াংশ, অর্ধাংশ ও এক তৃতীয়াংশ এবং
আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দণ্ডায়মান হয়।”
আলাহ
আগেই জানেন যে, তার প্রিয় নবি মুহাম্মদুর রাসুলাহ
(সা.) রাত্রিতে জাগরণ করেন এবং তাঁর (নবিজির) সঙ্গীদের
একটি দলও রাত্রে জাগরণ করেন এবাদতের জন্য। গবেষণায় দেখা যায় বন্দেগি বা এবাদতের জন্য রাত্রি উত্তম সময় এবং
দিবাভাগে কর্মব্যস্ততা থাকে।
সিয়াম সম্পর্কে চিশতিয়া তরিকার শিরোমণি হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি যাঁকে আমরা সম্মান করে খাজা বাবা বলে
সম্বোধন করে থাকি, তারই রচিত দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন কেতাবের বাংলায় অনুবাদ করেছেন জনাব জেহাদুল ইসলাম ও ড.
সাইফুল ইসলাম খাঁন Ñ এই কেতাবে আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট সিয়াম/ রোজা সম্পর্কে যেভাবে
বর্ণনা করেছেন তা হলো উক্ত কেতাবের ৪৩৭, ৪৩৮ এবং ৪৩৯ পৃষ্ঠায়। রোজার হাকিকত সম্পর্কে ঐ ব্যাখ্যা সত্যিই অবাক
করে দেয়।

No comments:

Post a Comment