Saturday, November 28, 2015

আরবি ভাষায় যাকে সালাত বলা হয় ফারসি ভাষায় তাকে বলা হয় নামাজ।

 সালাত

আরবি ভাষায় যাকে সালাত বলা হয় ফারসি ভাষায় তাকে বলা হয় নামাজ। আমরা সবাই এ নামাজের জন্য পরস্পর পরস্পরকে আহ্বান করে থাকি মসজিদসমূহে। বাংলা ভাষায় এই সালাত বা নামাজ এর অর্থ দাঁড়ায় যোগাযোগ। কোরান-এ আলাহ বলেন, ইনড়বা সালাতা লিজিকরি Ñ
 অর্থাৎ,“নিশ্চয়ই সালাত আমার (সহিত) সংযোগের জন্য।”
সালাত দুই প্রকার : (১) ওয়াক্তিয়া সালাত, (২) দায়েমি সালাত।
ওয়াক্তিয়া সালাত ও দায়েমি সালাত পাশাপাশি আলোচনা ও জ্ঞান-গভীর গবেষণা পাওয়ায় যায় যে সকল গ্রন্থে তার মধ্যে নিমড়ববর্ণিত গ্রন্থসমূহ উলেখযোগ্য :
(ক) দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন : খাজাবাবা, (খ) মাত্লাউল উলূম : বাবা জান শরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী, (গ) নিহ্নবে চিত্তদাহ :সুফিবাদ সার্বজনীন : ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী।
হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.) যাঁকে আমরা খাজা বাবা বলে জানি তাঁর রচিত গ্রন্থে (দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন) সালাত তথা নামাজের গভীর গবেষণামূলক আলোচনা পাওয়া যায়। ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী রচিত নিহ্নবে চিত্তদাহ :সুফিবাদ সার্বজনীন গ্রন্থে সালাতের ৮২ বার কোরান-এর তাগিদ সম্পর্কে এবং দায়েমি সালাত সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে।
(১) ওয়াক্তিয়া সালাত : শরিয়তের বিধান মোতাবেক মসজিদে কিংবা বাড়িতে সময় অনুযায়ী সালাত আমরা ঠিক ঠিকভাবে পালন করে থাকি। এ প্রকার সালাত ছোট বড় সকলেরই জানা। ধর্মীয় নিয়মনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের জন্য তাগিদ রয়েছে যা পালন অবশ্যই কর্তব্য।
(২) দায়েমি সালাত : যে সালাত সার্বক্ষণিকভাবে বজায় রাখা হয় তাই দায়েমি সালাত। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, যে যোগাযোগ সার্বক্ষণিকভাবে বজায় রাখা হয় তা-ই দায়েমি সালাত। মহানবি বলছেন, আসসালাতুদ দাওয়ামি আফজালুম মিনাল সালাতিল ওয়াক্তি, অর্থাৎ Ñ “ওয়াক্তিয়া নামাজ হতে দায়েমি নামাজ অনেক মর্যাদাপূর্ণ।” মহানবি দায়েমি সালাত বা নামাজে গুরত্ব আরোপ করেছেন। সালাত বা নামাজ মানে যদি যোগাযোগ হয় তবে সে যোগাযোগ কার সঙ্গে? নিশ্চয়ই আলাহর সঙ্গে,দুনিয়ার সঙ্গে নয়। কারণ, যারা ঘোর দুনিয়াদার তারা দায়েমি সালাতি হতে পারে না। তরিকতপন্থী তথা গুরবাদী ব্যক্তিগণ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কামেল পীর/ গুরুর সাহায্য নিয়ে সাধনার মাধ্যমে নফ্স হতে খানড়বাস তাড়ানোর পরে দায়েমি সালাত বা আলাহ্ র সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন। কোরান-এর সুরা মারেজের ২৩ নং আয়াতে দায়েমি সালাত সম্পর্কে বা আলাহর
সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের প্রসঙ্গে পাই : আলাজিনাহুম আলা সালাতেহিম দায়েমুনা Ñ অর্থাৎ, “তারা সালাতের(নামাজের) উপর সব সময় অবস্থান করেন।”
সালাত সম্পর্কে মহানবির আরও অনেক হাদিস আছে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না যেয়ে শুধু দু-একটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার
চেষ্টা করলাম। “জানড়বাতের চাবি হলো নামাজ আর নামাজের চাবিটি হলো তাহারাত (পবিত্রতা)।” আমরা অনেকেই “জানড়বাতের
চাবি নামাজ” Ñ এ বলেই শেষ করে দিই, কিন্তু “নামাজের চাবিটি হলো পবিত্রতা” Ñ এইটুকু বলি না। পবিত্রতা ব্যতীত নামাজ
হয় না। ‘পবিত্রতা’ কথাটি Ñ শুধু দেহের বাহ্যিক পবিত্রতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে না। সালাতি যখন তার নফ্সের সাথে মিশে
থাকা খানড়বাসকে বের করে দিতে পারে তখন সত্যিকারের পবিত্রতা হয় এবং তখনই দায়েমি সালাত হয়। পানি কিংবা সাবানের
সাহায্যে যতই পরিষ্কার করার, পবিত্রতা আনয়নের চেষ্টা করা হোক না কেন, আসল বা হাকিকি পবিত্রতার প্রশেড়ব তা বুঝানো হয়
নাই বা তা সম্ভব নয়। ওয়াক্তিয়া সালাত পালনের জন্য সময় নির্ধারিত থাকে, কিন্তু দায়েমি সালাতের সময় নির্ধারিত নয়, বরং
সার্বক্ষণিক। ওয়াক্তিয়া সালাতের সঙ্গে রুকু-সেজদার বিষয়টি দৃশ্যমান বা দেখা যায়, কিন্তু দায়েমি সালাত নিজের মধ্যে
যোগাযোগের ধারা গভীরভাবে ধারণ করে রাখে, যা বাইরে থেকে বোঝা খুব কঠিন।
আলাহর
সাথে গভীর প্রেম করেন ওলি, গাউস, কুতুব, পীর, ফকির, দরবেশ, সাধকগণ। আলাহর
সাথে বান্দার এরূপ
গভীর ভালোবাসা বন্দেগির একাগ্রতা না হলে সম্ভব নয়। নির্জনে, লোকচক্ষুর আড়ালে, গোপনে, হৃদয়ে ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে যে
বন্দেগি করা হয় সেরূপ বন্দেগিই আলাহ
পছন্দ করেন বলে আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কারণ, লোক-দেখানো বন্দেগি করা
সম্পর্কে সুরা মাউনে সাবধান করে দিয়েছেন। যার কারণে রাতের গভীরে সাধক ধ্যানসাধনার কার্যটি গোপনে সম্পনড়ব করেন।
এটা ছাড়াও বলতে গেলে বলতে হয় যে যত বন্দেগির কথা কোরান-এ পাই তা রাতের বেলায় নির্জনে গোপনে। যেমন : কদর
রাত হয় রাত্রিতে। সিয়াম পূর্ণ কর রাত্রির দিকে (২ : ১৮৭)। রাত্রে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপারে তাগিদ (সুরা মোজাম্মেল) ইত্যাদি।
তবে কথা হলো যে, সবার জন্য দায়েমি সালাত নয়। সবার জন্য হেরা গুহার ধ্যানসাধনা নয়। সবার জন্য পীর-মোর্শেদ
নয়। তকদির নামক বিষয়কে যদি বিশ্বাস করি তবে এই বলতে পারি যে, কেউ ওলি, গাউস, কুতুব, দরবেশ, পীর, ফকির হবে,
আবার কেউ মানুষের মাথায় আঘাত করে সর্বস্ব লুণ্ঠন করবে। কেউ আলাহর
সাথে দিদার বা প্রেম করার জন্য সর্বস্ব হারিয়ে
বনজঙ্গলে ধ্যানসাধনায় মগড়ব হবে, আবার কেউ কোটিপতি বা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেবে। তকদির
নামক বিষয়কে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মেনে নিতে হয়। জগতে বড় বড় মুনি-ঋষিগণ সবাই গুরু বা মোর্শেদ বা পীর ধরেছেন।
সর্বশক্তিমান আলাহর
নৈকট্য লাভ করার জন্য একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পনড়ব পীর বা ওলির শিক্ষা নিয়ে বা তাঁকে অনুসরণ করে সত্যের
সন্ধান করা ভালো, না নিজে নিজে সন্ধান করা ভালো তা একটু গভীরভাবে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে। সত্যের
সন্ধান করতে হলে নিরপেক্ষ জ্ঞান গবেষণা প্রয়োজন।
আসসালাতু মেরাজুল মোমেনিন Ñ অর্থাৎ, “সালাত মোমিন ব্যক্তির জন্য মেরাজ”, কিন্তু বলা হয় নাই যে “আসসালাতু
মেরাজুল আমানু” তথা “সালাত আমানুর জন্য মেরাজ।” তেমনি হাদিসে পাই, কুলুবুল মোমিনলু আরশ আলাহ
Ñ “মোমিনের
কলবে আলাহর
বাসস্থান।” এখানেও মোমিনের যায়গায় আমানু বলা হয় নাই। কারণ মোমিন ও আমানুর মধ্যে আকাশ-পাতাল
প্রভেদ। মনকে লোভ-মোহমুক্ত করার পরে, নফ্স হতে খানড়বাস দূর করার পরে একটা মহাশূন্য ভাব সৃষ্টি হয়, আর তখনই
দায়েমি সালাত হয়। মনের মধ্যে বিভিনড়বতা বা জঞ্জাল থাকলে সালাত হয় না। মনের মধ্যে মোহযুক্ত খারাপ চাহিদা থাকলে মন
তখন অকারণে জঞ্জালযুক্ত অনেক চিন্তার গোলাম হয়ে যায়। এ অবস্থায় সালাত সম্ভব নয়। সুরা নিসার ৪৩ নং আয়াতে আলাহ
বলেন, ইয়া আইয়্যুহালাজিনা
আমানু লা তাকরাবুস সালাতা ওয়া আনতুম সুকারা। শুকারা বলতে সাধারণ মানুষ আপন খেয়ালে
নেশাগ্রস্ত বুঝায়, রূপক অর্থে : চিনির মতো নেশা অর্থাৎ ক্ষুদ্র নেশা। মনের মধ্যে ক্ষুদ্রতম নেশা নিয়েও সালাতের ধারে কাছে
আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। সে জন্য আলাহ
কোরান-এ ধমকের ভাষায় যা বলছেন তার মর্মকথা হলো, “সালাতের ধারে
কাছে এসো না যে পর্যন্ত তুমি নেশাগ্রস্ত (চিনির নেশায়) থাকো” Ñ এখানে চিনির নেশা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য এটা
বোঝানো যে, সাধারণ বস্তুর মোহ মনের মধ্যে লেগে থাকলে আলাহর
সাথে সালাতির যোগযোগ সম্ভব নয়।
সুরা মোমিনের ৬০ নং আয়াতে আলাহ
বলেন Ñ ফা কালা রাব্বুকুম উদ্উনি আসতা জেবলাকুম। এখানে উদ্উনি অর্থ
একাকী। আলাহ
বলেন Ñ “একাকী ডাক দাও তবে আমি অবশ্যই ডাকের জবাব দেব।” এখানে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে
একা হলে একা বুঝায় না, বরং নফ্স-এর মধ্যে যে খানড়বাস আছে : মিন সাররিল ওয়াস ওয়াসিল খানড়বাস (সুরা নাস) Ñ তা বের
করে একা হলে আলাহ
ডাকের জবাব দেবেন। শর্ত হচ্ছে একা হওয়া। সাধনা ছাড়া মোরাকাবা-মোশাহেদা ব্যতীত খানড়বাস
তাড়ানো সম্ভব নয় এবং একা হওয়া সম্ভব নয়। উদ্উনি অর্থ হচ্ছে একা তথা একবচন। উদ্উনা অর্থ হচ্ছে, একের অধিক তথা
বহুবচন। একা না হলে বা একা হতে না পারলে আলাহ
ডাকের জবাব দেবেন না এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় উক্ত আয়াতে। তাই
গভীর ধ্যানসাধনা তথা মোরাকাবা-মোশাহেদার মাধ্যমে যখন নিজের ভিতরে খানড়বাস নামক শয়তান দূর করা যায় তখন সাধক
একা হয়েছেন এমন বোঝায় এবং এমন শর্তে আলাহ
কোরান-এ ঘোষণা দেন এইভাবে যে, “একাকী ডাক দাও তবেই আমি
ডাকের জবাব দেবো।” খানড়বাস তাড়ানো সম্ভব হলে উক্ত সালাতি ব্যক্তির দায়েমি সালাত বা সার্বক্ষণিক সালাত (নামাজ) কায়েম
হয়।
সালাত সম্পর্কে চিশতিয়া তরিকতের শিরোমণি হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (র.), যাঁকে আমরা সম্মান করে খাজা
বাবা বলে সম্বোধন করে থাকি, তাঁরই রচিত দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন কেতাবের বাংলায় অনুবাদ করেছেন জনাব জেহাদুল ইসলাম
ও ড. সাইফুল ইসলাম খান; এই কেতাবে আমাদের প্রিয় মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সাহাবি এবং খলিফা হজরত ওমর
(রা.)-এর নিকট নামাজ/ সালাত সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। খাজা বাবা রচিত সে মূল্যবান কেতাব দিওয়ান-ই-মুঈনুদ্দিন-এ
নামাজের হাকিকত সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তা সবাইকে অবাক করে দেয়। মুক্তভাবে নিরপেক্ষভাবে তা গবেষণা করা উত্তম।

No comments:

Post a Comment