হাদিসভিত্তিক শরিয়ত ও মারেফতের পরিচয়
বোখারি শরিফ একটি বিরাট হাদিসের বই। যিনি হাদিসগুলো সংগ্রহ করেছেন তাঁর নামেই হাদিস বইটি পরিচিত।
ফৌজদারি আইনের যে রকম ধারাবাহিক নম্বর থাকে সেই রকমভাবে এক দুই করে সাজানো রয়েছে। তা সহজেই বোঝা
যায়। এই বিরাট হাদিস বইটিতে আমরা অনেক মূল্যবান আদেশ-উপদেশ যে হুজুরপাক (আ.) দিয়ে গেছেন তার পরিচয়
পাই। এই কয়েক হাজার হাদিসের মধ্যে একটি হাদিস এক অপূর্ব এবং বিস্ময়কর স্থান জুড়ে সূর্যের আলোর মতো জ্বলজ্বল
করে আমাদের চোখে ধরা পড়ছে। হাদিসটা হুজুর পাকের (আ.) বাণী নয়, অথচ হাদিসের মর্যাদার আসন পেয়েছে।
সাহাবাদের মধ্যে বিশেষ জ্ঞানী-গুণি যাঁরা তিনি তাঁদেরই একজন। সেই সাহাবার কথা কয়টি হাদিস না হওয়া সত্ত্বেও
হাদিসের মর্যাদার স্থান পাওয়া কম কথা নয় এবং নিঃসন্দেহে স্থান পাবার মতো যোগ্যতা বহন করে। সেই বিশেষ সাহাবার
নাম হলো হজরত আবু হোরায়রা (রা.)। আবু হোরায়রা তাঁর আসল নাম নয়। তিনি খুব বিড়ালপ্রিয় ছিলেন বলে হুজুর পাক
(আ.) একদিন ‘বিড়ালের বাবা’ বলে ডাকলেন। সেই থেকে তাঁর আসল নাম মুছে গিয়ে আবু মানে বাবা এবং হোরায়রা
মানে বিড়াল তথা ‘বিড়ালের বাবা’ বলেই মুসলিম জাহানে সুপরিচিত। হুজুর পাকের (আ.) বেশিরভাগ বাণী আমরা পেয়েছি
এই মহান সাহাবার নিকটে। তাঁর এই মহান দান আমরা অতি তাজিমের সাথে মনে করি। তবে সবচাইতে বেশি তাজিম
করি তাঁর নিজের কয়েকটি অপূর্ব কথা মনে করে, যা বোখারি শরিফ-এর পঁচানব্বই নম্বর হাদিস। তিনি অকপটে শিশুর
মতো সরল-সহজভাবে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হুজুর পাক (আ.) হতে তিনি দুই প্রকার জ্ঞান অর্জন করেছেন :
একটি জ্ঞান বাহিরের, অপরটি ভেতরের তথা একটি জাহেরি এবং অপরটি বাতেনি। একটি সবাইকে বলা তো দূরে থাক,
একদম বিশেষ জ্ঞানী ছাড়া বলাই যায় না এবং সকলের সামনে এই গুপ্তজ্ঞান প্রকাশ করলে তা তিনি ব্যক্তিগতভাবে অন্যায়
মনে করেছেন এবং তাই তিনি বলেছেন যে, এই গুপ্তজ্ঞান তথা এলমে মারেফত সকলের সামনে প্রকাশ করলে তাঁর গলা
কাটা যাবে। এখানে গলা কাটা মানে একদম খুন করা অর্থে তিনি বোঝান নি। এখানে ‘গলা কাটা’ একটি বাগধারার মতো
ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এই এলমে মারেফত কখনোই সবার জন্য সমান বোধগম্য নয় বলেই প্রকাশ করা সমীচীন নয়।
তাই তিনি অকপটে স্বীকার করলেন যে, এলমে মারেফতের জ্ঞান তথা গুপ্তজ্ঞান, যা হুজুর পাক (আ.) হতে পেয়েছেন, তাঁর
বিরাট ভান্ডটি গুপ্তই রেখে গেলেন, তথা প্রকাশ না করে একটি সুন্দর রহস্যপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন। এই বিরাট
গুপ্তজ্ঞানভান্ডটি হজরত আবু হোরায়রার মতো বেশ কিছু সাহাবাদের জানা ছিল, যার পরিণতিতে ইসলামের মধ্যে সুফিবাদ
তথা ফকিরি প্রকাশ পেল। যদিও ইহা সুফিবাদ তথা ফকিরি নামে আলাদাভাবে সুপরিচিত, আসলে ইহা মোটেই আলাদা
নয়। নাম রাখা হয়েছে আলাদা, কিন্তু কর্মে ইহাই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। প্রাণকে বাদ দিয়ে দেহের মূল্যায়ন করতে গেলেই
আমরা বিভিনড়বতার মধ্যে হাবুডুবু খাই। সত্যকে আমরা মরা কুকুরের মতো উপেক্ষা করি হাজার বার সব মামুলি বুলি উচ্চারণ
করে এবং সত্যকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তুচ্ছ এবং বাজে বলতেও লজ্জা পাই না, যদিও আমরা পিছনের দিকে পা টেনে টেনেই
চলতে সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছি বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করি।
আল্লাহ যেমন রহস্য, আদমও তেমনি রহস্য এবং আজাজিল তথা শয়তানও আল্লাহ্র একটি উদ্দেশ্যমূলক রহস্য।
একের ভেতর তিনের গুপ্তরহস্য প্রকাশিত হলে রহস্যের সৌন্দর্য অতি প্রকটরূপে প্রকাশিত হয় এবং ইহার সৌন্দর্যে অবগাহন
করতে পারলেই শেরেকরূপ পরদা দূরীভূত হয়। আজাজিল ওরফে শয়তান কিসের তৈরি? ইসলামি দর্শন বলছে, শয়তান
এমন এক বিশেষ প্রকার আগুন দিয়ে তৈরি যে-আগুনের ধোঁয়া নেই তথা ধূম্রবিহীন অগিড়বর দ্বারা সৃজিত। কোনো অস্তিত্বের
নিজস্ব সত্তা নেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব ছাড়া। কারণ, তিনি একের মধ্যেই একক। ধূম্রবিহীন অগিড়বর মৌলিক কোনো সত্তা না থেকে
থাকে তবে উহাও কি একের ভিতর একক? যদি বলি হ্যাঁ, তবে সৃজনের মধ্যেই স্রষ্টা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে প্রকাশিত ও বিকশিত
হয়ে চলেছেন। তাঁর এই প্রকাশ এবং বিকাশের ধারা প্রতিটি সেকেন্ডে যদি কয়েক হাজার কোটি ভাগ করা হয় এবং সেই
ভাগে যতটুকু পরমাণুরূপ ক্ষুদ্রতম সময়ে কয়েক হাজার কোটি সম্পূর্ণ নতুন রূপ দেখিয়ে চলছেন এবং সেই ক্ষণিকতম সময়ে
বিশাল রূপটি আর কোনোদিনও দেখান না, তাই তিনি সব সময় নব নব রূপে বিকশিত হয়ে চলেছেন। আর যদি বলি : না,
ধূম্রবিহীন অগিড়ব তাঁর সম্পূর্ণ পৃক সত্তায় সত্তবান তা হলে ইহা শেরেকেরই নামান্তর। কিন্তু সৃষ্টিতে শেরেক বলতে কিছু
নেই, আবার আছেও শুনতে অনেকটা আত্মবিরোধী মনে হয়। আসলে অতি গভীরে প্রবেশ করলে কোনো আত্মবিরোধী
ভাবধারার সমাবেশ তো দূরে থাক, সবই একেরই অনেক রূপের মধ্যে তিনি একক রূপে খেলে চলেছেন। মূলত চরম সত্য
কথা বলতে গেলে, তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই আমাদেরকে দেখতে এবং মর্মে-মর্মে বুঝতে চেষ্টা করার তাগিদ
দিয়েছেন এই বলে যে বলো, আল্লাহ নিজেই আহাদ।
No comments:
Post a Comment