Saturday, November 28, 2015

আল্লাহ এক ও এককের বিষয়ে আলোচনা

আল্লাহ এক ও এককের বিষয়ে আলোচনা


আহাদ শব্দটি অতি মারাত্মক এবং গুপ্তরহস্যপূর্ণ কথা। আহাদের সার্বিক অর্থ হলো ‘তিনিই সব কিছু’ অথবা ‘যা কিছু আছে
সবটুকুই তিনি’ অথবা তিনিই অখন্ড অথবা স্বয়ম্ভু (অ্যাবসোলিউট) অথবা একটি অণুও বলতে পারবে না যে, সে আল্লাহ হতে
আলাদা সত্তা নিয়ে বিরাজিত। যদি বলতে পারে বলা হয়, তবে এই অণু যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, অসীম আল্লাহ্র সঙ্গে
শেরেক করছে তথা অংশীত্বের দাবি নির্ভয়ে ঘোষণা করছে। সুতরাং এই অণু-পরমাণুও অষন্ড সত্তা হতে আলাদা নয়। মহা
এককের মধ্যেই নিমজ্জমান। তাই তিনি আহাদ।
তাই তিনি বলছেন যে, দুই পূর্ব এবং দুই পশ্চিমের যে দিকে তাকাও না কেন, কিছুই দেখতে পাবে না কেবলমাত্র তিনি
(আল্লাহ) ব্যতীত। এই দুই পূর্ব এবং দুই পশ্চিম বলে ঘোষণার অর্থ হলো, কোথাও তিনি ছাড়া কিছুই নেই। তা হলে
আমাদেরকে ‘লা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে কেন বললেন? ‘লা’ দিয়ে কেবলমাত্র আপনার মধ্যে যে অংশীত্বের ভুল ধারণার
ছায়া পড়ে আছে তা দূর করে দেওয়া। আয়নার ভিতরে আপনার মুখের ছবিটার মতই ‘লা’-এর ভ্রাš Í ধারণা লুকিয়ে আছে।
উহা দূর করতে বলা হচ্ছে। কেবলমাত্র মুখের বলা ‘লা’ শব্দটির কোনো মূল্যই থাকত না যদি সত্যিই কোনো অংশীদার
থাকত। কারণ, যদি কোনো অংশীদার সত্যি সত্যিই থাকত, সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার আকৃতি সব চাইতে ক্ষুদ্র
পজিট্রনও যদি থাকত তবে কখনোই তার অংশীত্বের দাবি ছেড়ে দিত না এবং দিতে পারে না। আসলে ‘লা’-এর ভ্রান্ত
ধারণার অপর নাম আমিত্ব তথা হাস্তি বা খুদি। এই আমিত্বের জন্ম কর্ম করার মধ্য হতে আসে না। কারণ কর্ম কোনোদিন
আমিত্বের বন্ধন হতে পারে না। কামনাটাই কর্মের বন্ধন।
তাই কামনা আসলেই কর্ম কলুষিত হয়। কামনা আবার আপনা হতে আসে না এবং আসতেও পারে না। ছয়টি রিপুর
মাধ্যম হতে কামনা আসে। এই কামনাই পরদা। ইহা অতি সূক্ষ্ম পরদা। পুলসেরাতের পুলের মতো চিকন এর রূপ এবং
তীক্ষè তরবারির চেয়ে অনেক ধারালো এই কামনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ইহাই আমিত্ব। এই আমিত্ব তথা কামনা বর্জন করতে
আদেশ দিচ্ছেন ‘লা’ শব্দের দ্বারা। এই ‘লা’ নামক ছায়া দ্বারা এক রং ও রূপকে বহুরূপে দেখা হয়। এই এককে বহুরূপে
দেখাটাই শেরেক তথা অংশীত্বের রূপ। সাত রং দেখা যায় এমন কাঁচের মধ্যে চোখ রাখলেই রঙধনু মনে হবে। চোখ সেই
কাঁচ হতে সরিয়ে ফেলুন আর সাত রঙের সমাহার আপনি খুঁজেও পাবেন না। অনেকটা কাঁচের ভেতর এত রূপ দেখার মতো
এই কামনা। এই কামনা দূর করতে পারলেই সমস্ত কিছুতে ‘তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই’ প্রত্যক্ষ করার দর্শন লাভ হয়।
তাই কর্ম কোনোদিন বন্ধনের হেতু হয় না। কামনা যখন কর্মের ওপর আরোপিত হয় কেবল তখনই হয় বন্ধন এবং ইহাই
আমিত্ব এবং ইহাকেই দূর করে দেবার জন্য এত লক্ষ কোটি উপদেশ আমাদেরকে প্রদান করা হয়েছে।
সব উপদেশেরই মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু হলো আমিত্ব পরিত্যাগ করা। তাই তিনি এই কথাও বললেন, যে তার আমিত্ব
ত্যাগ করতে পেরেছে, সে তার প্রতিপালক আল্লাহ পাকের দর্শন অবশ্যই পেয়েছে। এখানে ‘অবশ্যই’ শব্দটি যোগ করে
দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ আর কোনো সন্দেহের অবকাশই থাকবে না। গৃহ পরিত্যাগ করতে পারলেই বৈরাগ্য হয় না। আমিত্ব
ত্যাগ করতে পারলেই হয় সত্যিকার বৈরাগ্য। কারণ, বৈরাগ্যের মাধ্যমেই ইসলামের সত্য উপলব্ধি করতে হয়। বিবাহবন্ধনে
আবদ্ধ হয়ে সংসারে থেকেও বৈরাগ্য পালন করা যায়, আবার বিবাহ না করেও করা যায়, এতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
তবে এই বৈরাগ্য রোহবানিয়াতের মতো নির্দিষ্ট কোনো অবশ্যপালনীয় নির্দেশ নয়। ইহা ব্যবহারিক পদ্ধতি, নীতিনির্ধারণ
পদ্ধতি নয়। ব্যবহারিক পদ্ধতির পরিবর্তন আছে, কিন্তু নীতি নির্ধারণ পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন নেই। সুন্নাতাল্লাহে লা
তাবদিলা অর্থাৎ অল্লাহ্র আইন বদলায় না। প্রাকৃতিক নিয়মকানুন যুগ যুগ ধরে একই নিয়মের অধীনতায় আবদ্ধ। সম¯ Í
মানুষ একই নিয়মের উৎস হতে তৈরি, ইহা নীতি নির্ধারণ পদ্ধতি। অবশ্য ইহারও একটিমাত্র ব্যতিμম আল্লাহপাক করেছেন
হজরত ইসা রুহুল্লাহকে পিতা ছাড়া তৈরি করে। তাই হজরত ইসা রুহুল্লাহ মায়ের পেট হতেই রুহুল্লাহ, তাই তিনি আজীবন
রুহুল্লাহ। কামনার বন্ধন তাঁর মধ্যে জীবনেও এক মুহূর্তের তরেও আসন নিতে পারে নি।
আত্মতত্ত্ব জানলেই বা পড়লেই আত্মজ্ঞ হওয়া যায় না। আমিত্ব ত্যাগ তথা কর্তৃত্বাভিমান পরিত্যাগ করতে পারলেই
আত্মজ্ঞ হওয়া যায়, অর্থাৎ প্রতিপালকরূপী আলল্লাহকে চেনা হয়। আল্লাহ অনেক গুণের অধিকারী বলে জানি অর্থাৎ এই
নিরানব্বইটি অথবা তিন শত ষাটটি গুণের একের ভেতর অনেকগুলো বিশেষ গুণ এবং এক-একটি গুণের এক-এক রকম
রূপ আছে। তাই তিনি কখনো ওয়াহেদ, আবার কখনো আহাদ। অর্থাৎ কখনো তিনি একের মধ্যে বহু তথা একক। তাই
তিনি কখনো নিজেকে ‘আমি’ বলেছেন, আবার কখনো ‘আমরা’ বলেছেন। ‘আনা’ তথা ‘আমি’ এবং ‘নাহনু’ তথা ‘আমরা’।
যেমন রেজেক-বণ্টন ব্যবস্থার কথায়, রুহ ফুৎকার করার পরিবেশে, হেদায়েত করার সময় ‘আনা’ তথা ‘আমি’ শব্দটি
কোথাও ব্যবহার করা হয় নি। ব্যবহার করা হয়েছে ‘নাহনু’ তথা ‘আমরা’ শব্দটি। ইহার সৌন্দর্য এত বিশাল, এত
বিজ্ঞানময় এবং রহস্যপূর্ণ যে, ইহার গভীরে প্রবেশ করলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।
আত্মতত্ত্ব জানলেই আত্মজ্ঞ হওয়া যায় না। ঔষধের নামতালিকা পাঠ করলেই রোগের লক্ষণ ধরা যায় না। রোগের
লক্ষণ ধরতে হলে ভিনড়ব পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু  ‘তিনি ছাড়া কিছুই নেই’ মুখে পড়তে বলা
হয় নি। কারণ মুখের স্বীকৃতির কোনো মূল্য নেই, যদি কর্মে উহা প্রয়োগ না করা হয়। যেমন ‘শয়তানের ধোঁকাবাজি হতে
আশ্রয় চাইছি’ বললেই শয়তান তাকে মোটেই ছেড়ে দেবে না এবং শয়তানের ধোঁকাবাজি হতে মুক্তিও পাবে না, যে পর্যন্ত না
কর্মের মাধ্যমে শয়তানকে বিদূরিত করতে পারবে। মুখের হাজার কথায়ও শয়তান চলে যায় বললে হাস্যকরই শোনায়,
কারণ মুখের কথায় শয়তান চলে যেতে পারে না, যতক্ষণ না একাগ্র চিত্তে আল্লাহ-সাধন পদ্ধতির ফর্মুলায় ফেলে সাধনায়
সিদ্ধি লাভ না করা হয়। মৌখিক স্বীকৃতি তিনি গ্রহণ করেন না, বরং অন্তরের স্বীকৃতিটাই তিনি দেখে থাকেন এবং গ্রহণ
করেন। আল্লাহ আমাদের কথা, চেহারা এবং আমল দেখেন না, তিনি দেখে থাকেন আমাদের নিয়ত অর্থাৎ অন্তরের স্বীকৃতি
এবং একনিষ্ঠ সাধনায় ব্রতধারী কি না উহা তিনিই ভালো করে জানেন। তিনিই বুূঝতে পারেন যে, আমাদের নিয়তরূপ
সাধনার হাতের তলায় কামনার ইট লুকিয়ে আছে কি না। আমার বিচারক এখানে আমি নই, তাতে যত সাধনাই করি না
কেন। বিচারক তিনি, তিনিই বিচার করে যখন দেখতে পাবেন যে, আমার নিয়ত একদম তাঁর দিকে ছাড়া আর কোথাও
নেই, সেদিনই তিনি ‘রহিম’-রূপে বিশেষ দান করবেন তাঁর পরিচয়ের গুপ্তরহস্য। ‘রহমান’-রূপে নয়। কারণ ‘রহমান’রূে
প যে দান উহা সাধারণ দান। ‘রহিম’-রূপের দান আমিত্বের বর্জনপূর্বক দান। তাই তিনি গফুরুর রহিম। গফুরুর রহমান
নন। ‘রহিম’-রূপী দানপ্রাপ্ত হলেই আল্লাহ্র আহাদরূপের সম্যক জ্ঞান হয় এবং তখনই সে তৌহিদে বাস করে এবং ‘আইনুল
ইয়াকিন’ তথা প্রত্যক্ষ দর্শন হয়ে যায়। ‘আইনুল ইয়াকিন’ না হওয়া পর্যন্ত এবাদত করো বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে।
ইসলাম কী অপূর্ব সুন্দররূপে আহ্বান করছে : হে অদৃশ্যে ইমান আনার লোকেরা, তোমরা ইমান আনো  অর্থাৎ
মৌখিক ‘বিল গায়েবে’ তথা অদৃশ্যে ইমান আনার দল, এখন তোমরা আইনুল ইয়াকিনের দিকে এগিয়ে যাও তথা প্রত্যক্ষ
জ্ঞান অর্জন কর। যারা অদৃশ্যে ইমান এনেছে তাদেরকেই ইমান আনতে বলা হয়েছে। তা হলে ইমানকে মোটামুটি দুটো
ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। একটি মৌখিক ইমান অপরটি প্রত্যক্ষ ইমান। প্র মটির যে কোনো মুহূর্তে হারিয়ে যাবার
সম্ভবনা আছে আর দ্বিতীয়টির হারিয়ে যাবার আর কোনো প্রশড়বই উঠতে পারে না, যেহেতু প্রত্যক্ষ জ্ঞান তথা আইনুল ইয়াকিন
তার হয়ে গেছে। তাই ইসলাম ঘোষণা করেছে, এবাদত সেই পর্যন্ত করো যে পর্যন্ত না আইনুল ইয়াকিন হয়। অর্থাৎ আইনুল
ইয়াকিন হবার পর এবাদতেরও শেষ হয়ে যাওয়া বোঝায়। কারণ, মৌখিক ইমানের কোনো দৃঢ় ভিত্তি নেই। মৌখিক ইমান
হলো সদা চঞ্চল গতিসম্পনড়ব। এই ইমান কথায় কথায় ভেঙে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এই ইমান বিভিনড়বতার মধ্যে ছোটাছুটি
করতে ভালোবাসে। এই ইমানের অধিকারীদের মতামত অনবরত বদলাতে থাকে। এই প্রকার ইমানের অধিকারীদের কাছে
আজ যা সত্য বলে ধারণা জন্মায়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আবার উহা মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ মৌখিক
ইমানের এক কথায় কোনো স্থিরতাই নেই। কিন্তু আইনুল ইয়াকিন তথা প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করলেই আর কোনো প্রকার
চঞ্চলতা, অস্থিরতা এবং সন্দেহ প্রকাশ পাবে না। ইসলাম এই প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জনকারীকেই প্রকৃত শান্তি লাভ করেছেন বলে
তথা ইতমেনান লাভ করেছেন বলে ঘোষণা করেছে এবং জানড়বাতের সুসংবাদ এরা পেয়ে গেছেন বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি তাঁর মকতুবাতে খাজা নামক বইতে হজরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকিকে উপদেশ দিচ্ছেন
এই বলে যে, ‘যে ব্যক্তি আলল্লাহ আল্লাহ জিকির করছে, জেনে রাখো, সে আল্লাহকে পায় নি এবং ইহাও জেনে রাখো যে,
যে ব্যক্তি আলাø হকে পেয়েছেন তিনি আর কখনোই আল্লাহ আলাø হ জিকির করবেন না। ইহা কেমন কথা বলে তুমি আমায়
প্রশড়ব করতে পারো এবং যদি প্রশড়ব করো তবে তার উত্তর হলো যে, তোমার কোনো প্রিয়জনকে দূরে দেখতে পেলে ডাক দেবে,
কিন্তু যখন সে তোমার অতি নিকটে তখন আর ডাক দেবার প্রশড়বই আসতে পারে না। অর্থাৎ যখন তুমি আলাø হ্র পরিচয়
প্রত্যক্ষরূপে পেয়ে যাবে তখন তোমার জন্য আর এবাদত নেই বললেই চলে। তখন তুমি এবাদতের বহু ঊর্ধ্বে এবং
এবাদতের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই শেষ। যদিও তোমার মধ্যে আলাø হপ্রাপ্তির পর এবাদত করতে কেউ দেখে, সেই এবাদত
তোমার নিজের জন্য নয়, উহা তোমার মুরিদানের শিক্ষা দেবার জন্য। হুজুর পাক (আ.) এবাদতের অনেক ঊর্ধ্বে। অথচ
তাঁকে এবাদত করতে দেখা যেত, তার মানে এই অর্থ নয় যে, সেই এবাদত তাঁর নিজের জন্য, বরং সেই এবাদত তাঁর
অনুসারী সাহাবাদের শিক্ষার জন্য। শিক্ষক যদি ছাত্রের বিদ্যার ওপরে না হয়, তা হলে ছাত্রকে শিক্ষক কী শিক্ষা দেবেন?
শিশুকে ক,খ,গ, পড়াতে গেলে শিক্ষকের সেই অক্ষর উচ্চারণ করতে হবে বার বার। এই বার বার ক,খ,গ উচ্চারণের
মাধ্যমে শিশু অক্ষরজ্ঞান পাবে, কিন্তু শিক্ষক এর অনেক ঊর্ধ্বে, যদিও তিনি ঐ অক্ষরগুলো শিশুর সঙ্গে বার বার উচ্চারণ
করছেন। একজনের শিক্ষা হচ্ছে, অপরজনে শিক্ষা দিচ্ছেন।
খাজা গরিব নেওয়াজ তাঁর মকতুবাতে খাজা বইতে আর একটি সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, তুমি যদি
অনেক পয়সা খরচ করে দামি পোলাও-কোরমা পাকিয়ে দশমাসের শিশুকে খেতে দাও তবে সেই শিশুর জন্য সেই দামি
খাদ্যই হবে বিষতুল্য, যদিও উহা তোমার নিকট উপাদেয় খাদ্য বলে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে দশমাসের শিশুর জন্য যে
দুধের শিশি তা যদি তোমার বন্ধুদের এনে দাও তবে উহা হবে তাদের জন্য অপমানজনক একপ্রকার ঠাট্টা-তামাশা। কারণ,
তোমার বন্ধুরা দুধের শিশিতে ঠোঁট লাগানোর বয়স অনেক আগেই ফেলে এসেছেন। তাই যারা দুধের শিশিতুল্য জ্ঞানের
উপযোগী, তাদেরকে পোলাও-কোরমার মতো অতি উঁচুস্তরের জ্ঞান দিও না। কারণ, তা সবার জন্য সমান প্রযোজ্য নয় এবং
সবাইকে সমানভাবে বিতরণ করাও সমীচীন নয়।
খাজা গরিব নেওয়াজ অতি উঁচু পর্যায়ের ওলি। তিনি এমন কথাও বলেছেন যা ওলিদের অবাক করে। যেমন একস্থানে
তিনি বললেন যে, ‘(হজরত) ইসার (নবির) সানিই আমি তথা আমিই দ্বিতীয় ইসা। কারণ, তাঁর কাছে যে রুহুল কুদ্দুস সেই
একই রুহুল কুদ্দুস আমার কাছেও।’ ফারসি ভাষায় তাঁর এই অপূর্ব কথা আমরা দেখতে পাই যেমন দাম বা দাম রুহুল
কুদ্দুস আন্দার মঈনে মি দামাদ্Ñ মান নামিদানাম মাগার মান ইসায়ে সানি শুদাম।
হজরত শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মুনিরি ওরফে মখ্দুম শাহ্ বিহারির মকতুবাতে সদি নামক বইতে এলমে মারেফতের
অতি উঁচু ¯Íে রর কয়টি উপদেশ আমরা পাই এবং তাঁর একটি উপদেশ নিমেড়ব তুলে ধরলাম। তিনি তাঁর জনৈক মুরিদকে
বলছেন যে, ‘জেনে রাখো বাবা, দুনিয়ার সবচাইতে বড় পাপী বলে গণ্য ব্যক্তিটি দুনিয়ার সবচাইতে উত্তম ব্যক্তিটির মাথা
লাঠির দ্বারা আঘাতে জখম করলো বলে দেখলে, কিন্তু সেই আঘাত পাপী ব্যক্তিটি করে নি। তুমি বলবে, তবে? আমি এখন
যা বলবো উহা তোমার বিশেষ তথা খাস বন্ধু ছাড়া কাউকে বলবে না। জেনে রাখো, সেই লাঠির আঘাত সেই পাপী ব্যক্তিটি
করে নি। কারণ, আল্লাহ্র ইশারা ছাড়া তার পক্ষে লাঠি তোলা অসম্ভব। তুমি বলবে, এটা কেমন কথা? আমি বলবো, বাবা
তুমি পরদার ভেতরে আছ, পরদা যদি খুলতে পার তবে দেখতে পাবে সব তাঁরই রহস্যময় লীলাখেলা। তুমি দেখতে পাবে
যে, তিনিই বিচারক, তিনিই কৌশুলী তথা উকিল, তিনিই বাদী এবং তিনিই বিবাদী। কারণ, তিনি ছাড়া কিছুই নেই।’ আহাদ
রূপের গুপ্তদর্শন এখানেই, যা তোমার কাছে অমিল-বেমিল এবং কেমন যেন খাপছাড়া মনে হবে। মোকামে তৌহিদে না
যাওয়া পর্যš Í আহাদ রূপটি মৌখিক স্বীকৃতিরই নামান্তর।
হোমিওপ্যাথিক ঔষধের নবম শক্তিতে ঔষধের কোনো অ¯িতÍ ¡ই খুঁজে পাওয়া যায় না। তা হলে এক হাজার শক্তিতে
কী থাকতে পারে? অথবা একলক্ষ কিংবা দশলক্ষ শক্তিতে? ঔষধের কোনোই অ¯িতÍ ¡ নেই, কিন্তু অ¯িতÍ ¡হীন ঔষধ রোগের
মূলে গিয়ে আঘাত করছে। ঔষধ নেই অথচ শক্তি আছে  এ কেমন কথা?
এক ফোঁটা ধাতুর (সিমেন) মধ্যে কোটি কোটি শুμকীট (স্পারমাটোজা) হতে একটি কীটের μমবিকাশের পূর্ণাঙ্গ
রূপটি হলো মানুষ। আরও একটু তলিয়ে দেখি, দেখি এই ধাতু কোথা হতে এলো? শ্বেত (এ্যালবুমিন) ও লৌহ কণিকার
(হিমোগোø বিন) মিশ্রিত রূপ রক্ত হতে ধাতুর জন্ম। রক্ত কোথা হতে এলো? খাদ্যদ্রব্য হতে রক্তের জন্ম। খাদ্যদ্রব্য কোথা
হতে এল? মাটি, পানি, আলো এবং বাতাস হতে খাদ্যদ্রব্যের জন্ম। মাটি, পানি, আলো এবং বাতাস কোথা হতে এলো?
এভাবে পর পর চিন্তা করলে, আসল মূল কোথায়, এর উত্তর খুঁজতে গেলেই নিজেকে চেনার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
কারণ, নিজেকে চিনতে পারলেই আল্লাহকে চেনা হয়ে যায় বলে ইসলাম ঘোষণা করেছে এবং ইহাই ইসলামের একমাত্র
উপদেশ। দ্বিতীয় কোনো উপদেশ ইসলাম দেয় নি। আলাø হ এক কিন্তু তাঁর গুণাবলি অনেক। অনেক গুণাবলির মধ্যে
সবচাইতে প্রিয় গুণটি তাঁর কী? ‘ইচ্ছা’ তাঁর সবচাইতে প্রিয় গুণ। সব গুণগুলোই ‘ইচ্ছা’ নামক গুণের অধীন। ‘ইচ্ছা’ হলো
সকল গুণের নেতা বা সরদার। কিন্তু এই শীর্ষস্থানীয় ‘ইচ্ছা’ গুণটিও একদম বেকার হয়ে পড়ে কখন, কোথায় এবং কার
কাছে? তিনটি প্রশেড়বর একটি ছোট্ট উত্তর হলো প্রেমের তথা ইশকের কাছে ‘ইচ্ছা’ বেকার হয়ে পড়ে। প্রেমের তথা ইশকের
আগুন যখন প্রেমিকের তথা আশেকের মনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, ‘ইচ্ছা’র দৃঢ় বাঁধনও তাকে থামিয়ে দিতে পারে না।
মৃত্যুর যাতনাও প্রেমের কাছে তুচ্ছ। আইন-কানুন, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা কোনো কিছুই
প্রেমকে বেঁধে রাখতে পারে না। যেন একটি জ্বলন্ত আগুনের টুকরো। কে এগিয়ে যাবে নীতির আঁচলে প্রেমকে বেঁধে
রাখতে? সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একাকার করে দেয় এই প্রেম। তাই তো জেনে-শুনেই সত্যদ্রষ্টা আদম খেয়েছিলেন নিষিদ্ধ
গাছের ফল। জেনে-শুনেই আজাজিল ওরফে শয়তান গলায় নিয়েছেন কলঙ্কের মালা।
বিশ্ববিখ্যাত ওলিয়ে কামেল হজরত শামসে তাব্রিজ এ রকম অতি গুপ্ত কথা তাঁর দিওয়ান-এ বলে দিয়েছেন। কিন্তু
আমাদের বলার অধিকার নেই। সত্য যে উলঙ্গ হয়ে পড়ছে, আবরণী আর যে থাকছে না। কামনার মায়াকাননে বাস করে
কিছুই জানলাম না, বুঝলাম না। যত শিখি, যত পড়ি, তাতে আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে নিজের অজ্ঞতা। তবে কি
নৈরাজ্যের আঁধারে হিংসা, আত্মগরিমা, লোভ আর কামনাই জানলাম? তবে কি আমাদের মতো আমিত্বের রশিতে বাঁধা
জীবনে এটুকুই জানতে পারি যে, জীবনটা সত্য, মৃত্যুটাও সত্য এবং এর মাঝখানের ছুটোছুটিটা একটা ফাঁকা, বিরাট শূন্য।
হিশাব মিলাতে গিয়ে দেখি কলুর চোখ-বাঁধা বলদের মতো অনেক পথ বেয়ে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি, যেখান থেকে যাত্রা
শুরু করেছিলাম।
রক্তের সম্পর্ক ইসলাম স্বীকার করলেও পূর্ণ স্বীকৃতি দেয় নি। পূর্ণ স্বীকৃতির স্বাক্ষর পাই প্রেমের সম্পর্কে। রক্তের
সম্পর্কে হুজুর পাকের (আ.) আপন চাচা আবু লাহাব ছিলেন বিরোধীদের মধ্যে একজন জঘন্যতম শত্রু। ‘ধ্বংস হোক আবু
লাহাবের হাত দুটো’, কোরান পাকের এই ঘোষণা রক্তের সম্পর্ককে সোজাসুজি বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। অন্যান্য চাচাদের
মধ্যে আবু জাহেলের বিরোধিতা এত প্রকট ছিল যে, সাধুর বিপরীত শব্দ শয়তানের মতো তার ভূমিকা ইসলামের বিরুদ্ধে
ছিল। জীবনভর ইসলামের বিরোধিতাই ছিল হুজুর পাকের (আ.) চাচা আবু জাহেলের নৈতিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
শ্রদ্ধেয় শিয়া সম্প্রদায়ের ভাইদের অনেকেই আমার কথায় একমত নাও হতে পারেন। কারণ, তাঁদের অনেকেই বলে
থাকেন যে, ‘আবু সুফিয়ানের হাত দুটো ধ্বংস হোক’-কে আবু লাহাবের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রদ্ধেয় শিয়া
ভাইয়েরা, আপনারা একটু তলিয়ে দেখুন তো, হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) হুজুর পাকের (আ.) বংশেরই একজন কি না?
অবশ্য অপ্রিয় হলেও মানতে হচ্ছে যে, এই হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) জীবনভর হুজুর পাকের (আ.) বিরুদ্ধে জঘন্য
শত্রুতা করে গেছেন এবং অবশেষে অনেকটা বাধ্য হয়েই শেষ কাতারের হালকা ইমানওয়ালা মুসলমানরূপে পরিচিত
হয়েছেন। আপনারা মওলা আলিকে বড় করতে গিয়ে অনেক গণ্যমান্য সাহাবাদের ওপর জঘন্য অপবাদ ছড়াতেও লজ্জাবোধ
করেন নি। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর ফারুক (রা.) এবং হজরত ওসমান (রা.)-কে এত নীচে নামিয়ে কি যে
আদিম তৃপ্তি পান তা আপনারাই ভালো করে বোঝেন। অথচ এই তিন মহান সাহাবারাও কয়েক পুরুষ আগে একই বংশের
তথা নবিবংশের এবং দু’জন হুজুর পাকের (আ.) আপন শ্বশুর এবং একজন আপন জামাতা। এরই নাম বোধহয় ঘাড়
মোগড়ামি। ‘শিবাজী তাজমহল বানিয়েছে’  এ রকম উদ্ভট আবিষ্কার আপনাদের মগজের মধ্যেই পাওয়া যায়। মা’র চেয়ে
মাসির দরদের বহর প্রকাশ করতে গিয়ে মূল শিক্ষাকে হারিয়ে তথা নিজেকে চেনার শিক্ষাকে বাদ দিয়ে বগল বাজিয়ে
কুৎসিত আনন্দ পেতে পারেন, কিন্তু এতে সত্য-সুন্দর রূপের মাঝে অবগাহন করা যায় না।
ইসলামের একমাত্র শিক্ষা হলো : মান্ আরাফা নাফসাহু ফাকাদ্ আরাফা রাব্বাহু তথা যে তার নিজেকে চিনতে
পেরেছে সে তার প্রতিপালককে তথা আল্লাহকে চিনতে পেরেছে। অনেক প্রকার ঔষধের যেমন একটি মাত্র উদ্দেশ্য থাকে
এবং সে উদ্দেশ্য হলো ইহারা আকারে, প্রকারে এবং গুণের দিক দিয়ে অমিল থাকলেও সবাই রোগ মুক্তির জন্য তৈরি
হয়েছে। দ্বিতীয় কোনো প্রকার শিক্ষা ইসলাম দেয় নি। যাহা আছে বলে মনে হয়, ইহা আসলে নিজেকে চেনার মূল শিক্ষাকে
অনুধাবন ও গ্রহণ করার বি¯তৃত ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে। কে অনেক ছোট এবং কে অনেক বড় এবং পবিত্র 
সাহাবাদের চরিত্রের কুৎসা গাইবার শিক্ষা দেওয়া হয় নি। কারণ উহাতে নফসরূপ পাগলা ঘোড়া মাতালের মতো লাফাইতে
পারে এবং একটি মজবুত দলকে বিভিনড়ব গোত্রে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে এবং একে অন্যের উপর ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ির
মারহাবা পেতে পারেন, কিন্তু একমাত্র শিক্ষাকে সযতেড়ব এড়িয়ে গিয়ে উজবুকের মতো দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন।
তাই খাজা বাবাকে একবার শ্রদ্ধেয় শিয়া ভাইয়েরা এজিদ সম্বন্ধে মšবÍ ্য করতে বলাতে খাজা বাবা বলেছিলেন যে, তিনি
ইমাম হোসেনের মধ্যে এমনভাবে ডুবে আছেন যে এজিদ সম্বন্ধে চিন্তা করার সময়ই পান নি  যদিও আমরা দলমত
নির্বিশেষে এজিদকে একটি নরপশু বলতেও ঘৃণা বোধ করি। ঝগড়া কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে সত্য নেই।
আসল সত্য হলো সাধনার দ্বারা নিজেকে চেনা, যাহা আল্লাহ্র ওলিরা গ্রহণ করেছেন। একজনকে বড় করেই বা আমার
কী লাভ আর একজনকে ছোট করেই বা আমার কী ক্ষতি। অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে যে বা যারা ধিক্কৃত তথা আদ্ ও সামুদ
জাতির মতো, তাদের বিষয় স্বতন্ত্র। এই নোংরামি ও ইতরামির মধ্যে যারা ডুবে থাকে থাকুক, কিন্তু যখন ইহাই রক্তাক্ত
খুনাখুনির রূপে জাহির হয় তখনই এদের শিক্ষা দেবার কী পরিণাম হতে পারে তাহা মর্মে মর্মে বোঝা যায়। এদের এই
প্রকার শিক্ষারূপ পর্বত যখন ইঁদুর প্রসব করে তখন জনতা মুখে রুমাল চেপে হি হি করে হাসতে থাকে। জনতা একে
অপরকে বলতে থাকে, এদের বাদ্যযন্ত্রে কী সুর বাজে আর এরা কী গান গায়? এদের সুর থাকে একদিকে, গান থাকে
অন্যদিকে। হায় রে আমার শ্রদ্ধেয় শিয়া ভাইয়েরা, বকাবাজি করা আর ‘হাম সব কুছ জানতা হায়, বাকি সব বিয়াকুব’ এবং
আমাদের দেওয়া কোরান-এর ব্যাখ্যাই একমাত্র ব্যাখ্যা, তা শিবাজীর তাজমহল বানানোর মতো উদ্ভট শোনালেও কিছু যায়
আসে না, আর হাদিস সংগ্রহকারীদেরকে বিশেষ করে ইমাম বোখারি ও ইমাম মোসলেমকে তো দালাল, মিথ্যুক ইত্যাদি
বলে আগেই মন্তব্য করে ফেলেছেন, যদিও আপনারা প্রয়োজনে মাঝে মাঝে এদের দোহাই দিতে বাধ্য হন। আপনাদের
জেল্লা-মারা বাক্কা কথাবার্তায় কত সহজ-সরল-প্রাণ মুসলমান যে ইমান হারিয়ে ফেলবে তা কি বুঝতে পারেন না?
আপনারা প্র মে হাত দিয়ে পাহাড় ঠেলতে শুরু করে দেন, যখন পাহাড় নড়ছে না তখন পাছা দিয়ে ঠেলা শুরু করে
দেন। কী বিচিত্র রং-এ রঙ্গিলা আপনারা। হাদিস তো সব বাদই দিয়ে ফেলেছেন, এখন রইলো একমাত্র সম্বল কোরান 
সেই একমাত্র সম্বল কোরানকেও মাঝে মাঝে বেয়াদব বলে যে চড়-থাপড় মেরে বসেন তা আপনাদের লেখা পড়লেই বোঝা
যায়। আপনাদের চেয়ে এক ডিগ্রি গলা উঁচু করে লেখেন যারা তারা হলেন ‘গোলাবি শিয়া’। এই গোলাবি শিয়াদের বিকৃত
ম¯িÍে ষ্কর ফসলে এত দুর্গন্ধ যে নাকই রাখা যায় না। এরা আবার কোরান-এর ভেতর অনেক মানুষের কথা ঢুকে গেছে বলে
মন্তব্য করেন। যে
মšবÍ ্য কোরান-এর ঘোরতর শত্রুও করতে পারে নি। কারণ, হুজুর পাকের (আ.) সময়ই ত্রিশ হাজার কোরান-এ হাফেজ
জীবিত ছিলেন। খেজুর পাতা, চামড়া অথবা শিলালিপি নষ্ট করা যায়, কিন্তু বুকের ভিতর যাহা মুখস্থ করে রাখা হয়েছে তাহা
কেমন করে নষ্ট করা যায়, ইহা এই গোলাবি শিয়ারাই ভালো করে জানেন। কবি রবি ঠাকুরের একটি কবিতা বাল্যকাল হতে
মুখস্থ আছে। সেই কবিতাটিতে যদি এতটুকু বিকৃত করে লিখা হয় উহা কি আমার চোখে ধরা পড়বে না? যেমন ‘আমার বড়
নদী চলে হু হু করে বৈশাখ মাসে তার সাঁতার জল থাকে।’ এই কবিতার লাইনে কোথায় কতটুকু ভুল হয়েছে উহা হুবহু বলে
দিতে পারবো। কারণ, ইহা আমার মুখস্থ আছে। সুতরাং যদি কোরান-এর কোথাও কোনো বিকৃতি ঘটতো তবে সঙ্গে সঙ্গে
ত্রিশ হাজার হাফেজ সাহাবার চোখে ধরা পড়তো। ধরে নিলাম, দুই চারজন হাফেজ সাহাবা নীরব রইলেন, কিন্তু ত্রিশ হাজার
হাফেজের পক্ষে নীরবতা পালন করা অসম্ভব। এটা বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরার মতো শোনায়।
শ্রদ্ধেয় শিয়া ভাইয়েরা, বুকে হাত রেখে বলুন তো, ভিনড়ব মত ও পথের অনুসারীদের কয়জনকে মুসলমান বানাতে
পেরেছেন? গজনীর সুলতান মাহমুদ পাক-ভারতে মুসলমান বানাতে আসেন নি অথবা আপনাদের মতো বিদ্বান পন্ডিতগণও
মাশাল্লাহ মুসলমান বানাতে পারেন নি। সমগ্র পাক-ভারতে যাঁরা মুসলমান বানিয়েছেন তাঁদের আমাদের মতো অন্ধ পন্ডিতের
বিদ্যার কচকচানি ছিল না। আমাদের মতো বিদ্যার সাগরদের দিয়ে কাগজের পৃষ্ঠায় লিখিত কোরান-এর লিখিত ব্যাখ্যায়
পাক-ভারতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। এ রকম তফসির আমাদের মতো গাধার পিঠেই বোঝা হয়ে রইলো। অন্য কোনো
দল ও মতের ব্যক্তিদের ঝাঁকে ঝাঁকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করাতে পারি নি এবং মাশাল্লাহ কোনোদিন যে পারবো না তা
আমাদের উভয় পা দুটো দেখলেই বোঝা যায় যে, আমাদের ওজনে জয়পাল সাধুর মতো বটগাছ নড়বে কি না। দশহাজার
মণ ওজনের পাথরটি তারাগড় পাহাড়ের উপর হতে আমাদের ওপর গড়িয়ে দেওয়া হলে আমরা আমাদের মোটা মোটা
এলমের বই দিয়ে রুখে ফেলবো! যেমন চড়–ই পাখির পা দুটো দেখলে বোঝা যায় যে ইহার বিশাল (?) পায়ের ভারে বটগাছ
নড়বে কি না। তবে বটগাছ নড়ছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়, কিন্তু কাহাকেও বিশ্বাস করানো যায় কি না উহা আমরা
সকলেই বুঝতে পারি। লিখিত বই-পুস্তক দিয়ে ধর্মপ্রচার হয়, কিন্তু ধর্ম গ্রহণ করানো যায় না। তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে
গেছেন সুলতানুল হিন্দ খাজা গরিবে নেওয়াজ। ইচ্ছা করলে তিনিও আরবি ভাষায় কোরান পাকের তফসির করে যেতে
পারতেন। কিন্তু উহার মূল্য কতটুকু হবে ভেবেই তা করেন নি। তিনি নুরি কোরানকে, যে কোরান কাগজ অথবা
শিলালিপিতে কলম অথবা হাতুড়-বাটালে লিখা হয় সেই কোরান নয়, যে কোরান পবিত্র না হয়ে পাঠ করা তো দূরের কথা
স্পর্শই করা যায় না (লা ইয়া মাস্সাহু ইল্লাল্ মুতাহ্হারুন) সেই নুরি কোরানকে নিজের জীবনের ওপর তফসির করেছেন।
যে নুরি কোরান সাত হরফের দ্বন্দ্বের মধ্যে নেই এবং সেই তফসিরের ফলে সারা পাক-ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব
অনুভব করি তার অধিকাংশই তাঁর নেয়ামতের দান। মুখের কথায় ‘শয়তান হতে আশ্রয় চাই’-এর যেমন কোনো মূল্য নেই
তেমনি কাগজে লিখিত কোরান তফসিরের দ্বারা মানুষকে অনেক বিষয়ে অবগত করানো যায়, কিন্তু দীক্ষিত করা যায় না।
যদি দীক্ষিতই করা যেত তবে দুনিয়াতে অনেক হিয়া বড় বড় তফসির করা হয়েছে, কিন্তু খাজা বাবার লিখিত কয়টি চিঠি ও
কবিতা ছাড়া আর কিছুই নেই। তেমনি বাংলাদেশের মধ্যেও মুসলমান করে গেছেন বাবা শাহজালাল এবং তাঁর শিষ্যবৃন্দ।
কোনো রাজা, জমিদার এবং আমাদের মতো বাক্যবাগীস আরবি জানা শিয়া ও সুনিড়ব পন্ডিতরা মুসলমান করে যান নি। আমরা
উভয়েই আমাদের লিখিত চিšাÍ ধারা দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ফেরকার ভেদাভেদ বানাতে ওস্তাদ। আমরা উভয়েই আমাদের
এমন সব আজব বেমিল এবং অসংযত কথা ও লিখনী দ্বারা মুসলমানদের সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়ে মারহাবা কুড়িয়েছি।
আমাদের লিখনীর ফসল জগাখিচুড়ি আর সেই খিচুড়ি পরিবেশন করে কত প্রকার রোগের যে জন্ম দিয়ে ফেলেছি। তার
হিশাব দিলে, আমাদের উভয়ের ছেঁড়া জুতার স্ন্দুর মালা পাবার পুরস্কার ঘোষণা করবেন। নানা মুনির নানা মতের মতো
আমাদের চিল্লাচিলিøে ত মুসলমানের যত বড় ক্ষতি হয়েছে তা অন্য দল ও মতের দ্বারা এর শতাংশের একাংশও হয় নি।
আমরা উভয়ে নিজেদের কুঠার নিজেদের পায়ে মারার বিদ্যা শিখেছি কিন্তু এলমে মারেফতের ধারে কাছেও যাই নি। কারণ
উহাকে যে আগেই ফতোয়া মেরে দিয়েছি। আমরা এক ইসলামকে তেহাত্তরটি ইসলামে পরিণত করেছি। ইহা কি কম
কথা? ইহা কি আমাদের বিদ্যা হাসেল করার কম সুন্দর নমুনা? অথচ যে সকল ওলি-দরবেশ, পীর-ফকিরেরা মুসলমান
বানিয়ে গেলেন, তারা বলে আমাদের দৃষ্টিতে কোরানই ভালো করে বুঝতে পারেন নি। একেই বোধহয় বুড়ো বয়সে ভীমরতি
ধরেছে বলে মনে হয়। জাহেরি ইলম দিয়ে ইসলামের তবলিগ হয় না। বাতেনি ইলম অর্জন করতে পারলেই হয় ইসলামের
তবলিগ। জাহেরি ইলম দিয়ে মুসলমান মুসলমানকে তবলিগ করতে পারেন, কিন্তু একটা সম্পূর্ণ ভিনড়ব মতের অনুসারীদেরকে
ইসলাম গ্রহণ করানো যায় না।
হজরত মুজাদ্দেদে আল ফেসানি তাঁর মকতুবাত-এ লিখেছেন যে, মওলা আলি বলেছেন, যারা তাঁকে হজরত আবু বকর
এবং হজরত ওমরের ওপর প্রাধান্য দেয় তারা মিথ্যুক এবং স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে বাস করে।
আমি ভালো করেই জানি, আপনারা এই কথা মোটেই বিশ্বাস করবেন না। মনে করুন, ধরে নিলাম ইহা মওলা আলি
বলেন নি, কিন্তু মুজাদ্দেদে আল ফেসানি তো বলেছেন। তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত ওলির নাম আপনাদের জানারই কথা। কিন্তু
আপনারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ওলি বলা তো দূরের কথা আপনাদের আদিম চরিত্রের রূপটাই জাহির করে ফেলবেন। কিন্তু
আপনারা তো জানেন না যে, বেলায়েতের সামনে নবুয়ত একটি বিন্দু এবং আংটি বিশেষ। হজরত মুসা (আ.) এবং হজরত
খিজির (আ.)-এর ঘটনাগুলোর উপরই মুসা (আ.) নবি প্রাথমিক শর্ত ধৈর্যই ধারণ করতে পারলেন না।
বেলায়েতের প্রাণকেন্দ্র হুজুর পাক (আ.)-কে প্র মেই কিন্তু রসুল বলা হয় নি। প্র মে বলা হয়েছে ‘আবদুহু’ তথা
আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা এবং ইহাই বেলায়েত এবং পরে বলা হয়েছে ‘রসুলুহু’ তথা আল্লাহ্র রসুল। আমি জানি, হাজারোবার
যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাতে কোনো ফল হবে না। কারণ, যারা সব কিছু বুঝে গেছেন, তাদেরকে আর নতুন করে
বোঝানো যায় না এবং ‘শিবাজী তাজমহল বানিয়েছে’ যাদের নব আবিষ্কারের সাইনবোর্ড কাঁধে মরা কুকুরের মতো ঝুলছে,
তাদেরকে বলার মতো কিছুই থাকতে পারে না।
আরব দেশ হতে বহু দূরে আফ্রিকার কালো আদমি, নিগ্রো বলে যারা আমাদের কাছে সুপরিচিত, সেই কাফ্রি হজরত
বেলাল (রা.) চাবুকের আঘাতে রক্তসড়বাত হয়েও হুজুর পাকের (আ.) প্রেমের সম্পর্ককে অস্বীকার করলেন না, বরং জীবনের
বিনিময়েও প্রেমের সম্পর্ক যে সবচাইতে বড় সম্পর্ক, সেই আদর্শ আমাদের কাছে তুলে ধরলেন। আপন ঘরের সন্তানেরা
করে বিরোধিতা আর যাদের সঙ্গে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, যাদের সঙ্গে পরিচয় কিছুদিনের তারা কী করে প্রেমের
সম্পর্কের কাছে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে তারই বিস্ময়কর দৃষ্টানন্ত ইসলামের ইতিহাসে ভরপুর।
আপন ঘরের সšাÍ ন হয় কাফের। শুধু কি কাফের? হেন অকর্ম নেই যা তাদের দ্বারা করা হয় নি। অথচ দূরের সšাÍ নরা
হয় প্রেমিক। যুদ্ধের ময়দানে নিজের রক্ত-মাংসের বুকটাকে ঢাল বানিয়ে তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা করে নিশ্চিত মৃত্যুকে
করেছে আলিঙ্গন, তবু হুজুর পাকের (আ.) পবিত্র দেহ মোবারকে একটি আঘাত যাতে না লাগে তার জন্য চলেছে প্রাণপণ
চেষ্টা। ওহুদের যুদ্ধের কোনো একটি বিশেষ পরিবেশে পর পর কয়জন রসুল-প্রেমিক জেনে শুনে আপন বুকটাকে বানিয়েছে
তীরের আঘাত খাওয়া ঢাল, যার পরিণাম অবধারিত মৃত্যু। প্রেমের সামনে মৃত্যু কত তুচ্ছ, কত নগণ্য বলে বিবেচিত হতে
পারে, তারই অবাক করা নমুনা রয়ে গেল স্মৃতির ইতিহাসে। ইসলাম প্রেমের সম্পর্ককেই হুজুর পাকের (আ.) উত্তরাধিকার
তথা নিজ বংশের বলে ঘোষণা করেছে। এই সম্পর্কের বাঁধন ঘর-বাহির, সীমার নৈকট্য এবং দূরত্বের দ্বারা হয় না। কারণ
প্রেমের কোনো বাঁধাধরা আইন নেই। আইনের অভ্যন্তরে প্রেম থাকলে হুজুর পাকের (আ.) বংশের ভেতর জঘন্য কাফের
হতে পারে না। নবির পুত্র, নবির স্ত্রী তা হলে কাফের হতে পারে না, আর মূর্তিপূজারক আজরের পুত্র হজরত ইব্রাহিম (আ.)
কখনো নবি হতে পারে না, হজরত নুহ্ (আ.)-এর পুত্র কেনান কখনো কাফের হতে পারে না এবং হজরত লুত (আ.)-এর
স্ত্রীও কখনো কাফের হতে পারে না।

No comments:

Post a Comment