Monday, November 30, 2015

কোরবানি

  কোরবানি


কোরবানি সম্পর্কে শরিয়তের যে বিধান রয়েছে তা আমরা সবাই জানি। কোরবানিতে যে পশু জবাই দেয়া হয় তা শরিয়তের
নিয়ম-কানুন তথা আইন মেনে এর গোস্ত ভাগবণ্টন করে গরিব-মিসকিন, আত্মীয়-স্বজনকে দিই ও নিজে গ্রহণ করে থাকি।
নবি ইব্রাহিম (আ.)-এর তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য যে ঘটনা তা জেনে আসছি। প্রিয় বস্তু
কোরবানি করার আদেশ পালন করতে যাওয়ার ঘটনা ছোট-বড় সবাইকে অবাক করে। নবি ইব্রাহিম (আ.) সে পরীক্ষায়
অবতীর্ণ হন এবং আলাহর সে প্রেমের পরীক্ষায় নবি ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) প্রেম দিয়েই পরীক্ষায়
ভালোভাবে উত্তীর্ণ হন। এ ঘটনাও সবার জানা। কিন্তু যে প্রশড়ব এসে যায় তা হলো, নবি ইব্রাহিম (আ.)-এর সাথে একজন আম
মানুষ তথা সাধারণ মানুষের তুলনা কি হয়? তুলনা হতে পারে না। নবি ইব্রাহিম (আ.)-এর ঘটনা আমাদের শিক্ষা নেওয়ার
অপূর্ব সুযোগ। কোরবানির বিষয়সমূহ গবেষণা তথা বিশেষণ করা প্রয়োজন। কোরবানির বিষয়সমূহ গবেষণার জন্য একজন
অন্তর্দৃষ্টিপ্রাপ্ত কামেল মোর্শেদ হলে উত্তম হয়।
আমার মোর্শেদ কেবলা ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন, তা হলো : জান
(জীবন) দেয়া সহজ, কিন্তু দিল দেয়া কঠিন। বিষয়টি এই জন্য বলা হলে যে অর্থশালী/ সম্পদশালী ধনী ব্যক্তির জন্য একটা
পশু কিনে জবাই করা যতখানি কঠিন কিংবা সহজ বরং তার চেয়ে অনেক কঠিন কাজ হলো নিজের আমিত্বকে বিসর্জন করা।
আমিত্বকে বর্জন করা অতি সাধারণ মানুষের কাজ নয়। সাধক ব্যতীত এ বর্জন করার কাজটি সবাই করতে সক্ষম হবে না।
ভিতরের খানড়বাস সμিয় থাকলে সেই মানুষটি একা বা ‘উদুউনি’ (একা) নয়। সে একের অধিক বা বহু কিংবা আরবিতে যাকে
বলা হয় ‘উদুউনা’ (বা একের অধিক)। সাধারণ মানুষের নফ্সের সাথে অতি গোপনে মিশে থাকা খানড়বাস (মিন সাররিল ওয়াস
ওয়াসিল খানড়বাস : সুরা নাস)-কে তাড়ানোর গভীর ধ্যানসাধনা (মোরাকাবা-মোশাহেদা) না করার কারণে নিজের নফ্সের সাথে
মিশে থাকা আমিত্ব দীর্ঘায়িত হয়। সে অবস্থায় একজন সাধারণ তথা আম মানুষ পশু জবাই দিলেই কোরবানির মূল উদ্দেশ্য
অর্জন হবে কি না তা গভীরভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে। পশু জবাই দেয়া কোরবানিটিও ‘কোরবানি’ তা অস্বীকার করার
কোনো উপায় নেই। তবে একমাত্র চার পায়ের নিরীহ পশু জবাই করে কোরবানির আসল উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গেলে
আত্মশুদ্ধির কিংবা ইব্রাহিম (আ.) নবির আদর্শের কোরবানির তাৎপর্য অর্জিত হয় না। সুরা হজের ৩৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়
স্পষ্টই বোঝা যায় যে কোরবানির গোস্ত, রক্ত কখনই আলাহর
দরবারে পৌঁছায় না, শুধু পৌঁছায় ‘তাকওয়া’। তাকওয়া
অর্জনের লক্ষে ‘জবাই’ আর ‘নির্বিচারে জবাই’ বিষয়টি এক কথা নয়। নিজের ভিতরের পশুরূপী নফ্সের খানড়বাসকে জবাই বা
সংশোধনের সাধনার দ্বারা আমিত্বকে বর্জন করাই উত্তম। তা না হলে শুধু নিরীহ পশু জবাইয়ের মাধ্যমে নিজের ভিতরের
খানড়বাসরূপী শয়তান তথা পশু হাসতে থাকে এবং এরূপ অবস্থা μমগাত চলতে থাকলে সংশোধনের কোনো সাধনাই থাকে না।
কোরবানি সম্পর্কে খুব ভালো গভীর আলোচনা করেছেন সুফি সাধক ও গবেষক সদর উদ্দিন আহম্মদ চিশতি তাঁর
কোরবাণী নামক গ্রন্থে এবং ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী রচিত সুফিবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ ১ম খণ্ডের
৩৬-৩৭ পৃষ্ঠায়। আমার বিশ্বাস, এ-বইগুলো পাঠ করলে পাঠক উপকৃত হবেন।
ধৈর্যগুণ ইয়া আইয়ুহালাজিনা আমানুস্তাউন বে সবরে ওয়া সালাতে ইনড়বালাহা মা আস সাবেরিন (আল-কোরান) Ñ
অর্থাৎ, “হে ইমানদারগণ! মস্তানি সাহায্য- (আলাহর দানকৃত বিশেষ দয়াগুণকে বুঝিয়েছেন) কামনা কর ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে নিশ্চয়ই আমি ধৈর্যশীলদের সাথেই আছি।”
ধৈর্যগুণ আলাহরপছন্দনীয় একটি গুণ, যা আমানু অবস্থায় অর্জন করা কঠিন। আমানুর ইমান আর মোমিন ব্যক্তির ইমান
(বিশ্বাস) এক নয়। তাই আমানুদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন, মোমিনদেরকে নয়। কারণ, আমানুর মধ্যে বিশ্বাসের গভীরতা না
থাকায় সে আমানু কেমন করে কামনা করে আলাহর বিশেষ দয়া? তাই সে আমানু যেন সবুর (ধৈর্য) ও সালাত (আলাহর সাথে
যোগাযোগ) বজায় রাখেন। তারপর আলাহ আশ্বাস দিয়েছেন নিশ্চয়ই শব্দটি ব্যবহার করে ‘ইনড়বালাহ’ শব্দটির মাধ্যমে। ৫০০বার বা ৫০০০ বার যে কোনো তসবিহ্ মুখ দ্বারা নিমেষেই দ্রুত পড়ে শেষ করা সম্ভব, কিন্তু কোনো বিষয় সম্পর্কে আমানু ধৈর্যধারণ করতে হিমশিম খেয়ে যাবে।
ধৈর্যগুণ মন দিয়ে নিতে হয়, দেহ দিয়ে নয়। ধৈর্যগুণ নিতে মনকে পোড়াতে হয়। ধৈর্যগুণ অর্জন করতে আমানুদের মনের
সাধনার প্রয়োজন। অতি সাধারণ মানুষের ধৈর্যধারণ করতে অনেক কষ্ট হয়। সবর বা ধৈর্যের সাথে সালাতের বিষয়কে অর্থাৎ
রবের সাথে যোগাযোগের বিষয়টির প্রতি শর্ত আরোপ করেছেন। ধৈর্য বিষয়টি কী? ধৈর্য হচ্ছে মনের সাথে না মিলাতে পারা
এমন একটা কঠিন বিষয় যার উপর জয়লাভ করার চেষ্টারত থাকা। এক্ষেত্রে মনের মধ্যে খুব চাপ সৃষ্টি হয়। মন এক্ষেত্রে অস্থির
হয় সমস্ত বাঁধ ভেঙে ফেলার, কিন্তু এসব বিষয় হতে মনকে শান্ত স্থির রাখাই ধৈর্য। বিশ্বাসী ও সাধক না হলে ধৈর্যর বাঁধ ভেঙে
ফেলে।
তাওয়াক্কুল হচ্ছে আলাহর প্রতি ভরসা বা পূর্ণ আস্থা। পূর্ণ আস্থা অর্জন হলে সে ধৈর্যধারণ করতে সক্ষম হবে। বিশ্বাস
অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত কেউ আলাহর ওলি হতে পারে না (মাতলাউ’ল উলুম, প-ৃ ৪৫)। এখানে আরও দেখার বিষয় হলো যে
একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তির ধৈর্য বাইরে হতে দেখা সম্ভব নয়। কারণ ধৈর্য কোনো আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। এটা মন দ্বারা করার
প্রয়োজন হয়, দেহ দ্বারা নয়। এখন কথা হলো, ধৈর্য ও সালাতের মধ্যে ধৈর্য আগে না সালাত আগে? অবশ্যই ধৈর্য আগে।
ধৈর্যধারণ সম্ভব না হলে সালাত বা যোগাযোগের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। ধৈর্য ও সালাত প্রতিষ্ঠা হলে আলাহ
ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন। অর্থাৎ, ধৈর্য ও সালাত হলে শেষ পর্যন্ত ধৈর্যশীলদের সাথেই আলাহ
থাকবেন - এটাই আলাহ্র ঘোষণা।



----------ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী 

No comments:

Post a Comment