Wednesday, June 15, 2016

আহালে আল বায়াত এবং ইমাম হযরত আলীর নামের শেষে আলাইহিস (আঃ) সালাম ব্যবহার প্রসঙ্গে

'আলাইহিস সালামযে কেবল নবী-রাসূলদের নামের শেষে ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু নয়। যেমন-আমরা হযরত লোকমান,হযরত মারিয়াম এবং ইমাম মাহদীর নামের শেষে 'আলাইহিস সালামব্যবহার করি অথচ তারা কেউই নবী-রাসূল নন। শুধু তাই নয়ফেরেশতাদের নামের সাথেও আমরা 'আলাইহিস সালাম'ব্যবহার করি। আমরা আরেকটি প্রশ্ন তুলতে পারি যেপবিত্র কোরআন বা হাদীসের কোথাও কি এমন বর্ণনা রয়েছে যে,কোনো মুসলমানের নামের পর "আলাইহিসসালাম" বা সংক্ষেপে (আ.) ব্যবহার করা যাবে না বা এ ধরনের ব্যবহার হারাম?আমাদের জানামতে কোরআন-হাদীসের কোথাও এমন নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়নি কিংবা এ ধরনের ব্যবহার যে অপছন্দনীয় তাও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বরং পবিত্র কোরআনের নানা আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ মুমিনদের,পরহিজগারদের ও বেহেশতীদের সালাম দিয়েছেন। যেমন- সুরা ইয়াসিনের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘করুণাময় পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে বলা হবে সালাম।'অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে সুরা ত্বাহার ৪৭ নম্বর আয়াতে এবং সুরা আরাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে।
"
আলাইহিসসালাম" শব্দের অর্থ তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এটি এক বিশেষ প্রার্থনা। আমরা মুসলমানরা সবাই একে-অপরকে সালাম দিয়ে থাকি। এবার আমরা বিশ্বনবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদের নামের পাশে "আলাইহিসসালাম" বা সংক্ষেপে (আ.) ব্যবহার যে বৈধ তার কিছুপ্রমাণ তুলে ধরছি:
১-সুন্নি মাজহাবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থ বুখারী শরীফের " কিতাবুল ফাজায়েলে সাহাবেহ" অধ্যায়ের (৩৭/৬২ নম্বর অধ্যায়) "বাবুল মানাক্বিবে ফাতিমাতু" শীর্ষক পর্বে (পর্ব নম্বর ৫৯/২৯) হযরত ফাতিমার নামের পর "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছে।
একই হাদীস গ্রন্থের অর্থাৎ বুখারী শরীফের "বাবুল মানাক্বিবি ক্বুরাবাত্বা রাসুলুল্লাহ ওয়া মানাক্বিবাতি ফাতিমাতা আলাইহিসসালাম বিনতি নাবী" শীর্ষক আলোচনায় (পর্ব নম্বর-৪১/১২) "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছেযা এই শিরোনামের মধ্যেই লক্ষ্যনীয়।
২- একই ধরণের ব্যবহার রয়েছে সুন্নি মাজহাবের আরেকটি বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ তিরিমিজি শরীফের হাদীসে। যেমনকিতাবুল মানাক্বিবিত তিরমিজি'র "ফাজলি ফাতিমাতা বিনতি মুহাম্মাদ সাল্লিল্লাহু আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" উপপর্বে। (৫০/৬১ নম্বর অধ্যায়অর্থাৎ কিতাব নম্বর ৫০বাব নম্বর ৬১ ) এখানেও শিরোনামের মধ্যেই "সাল্লিল্লাহু আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
একই হাদীস গ্রন্থের "মানাক্বিব আল হাসান ওয়া আল হুসাইন আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম" শীর্ষক আলোচনার শিরোনামেই এই শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
এটা স্পষ্ট যে বিশিষ্ট সাহাবীদের বর্ণিত এসব হাদীসে হযরত ফাতিমা (সাঃ আঃ) এবং হযরত ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.)'র নামের পর "আলাইহিসসালাম" ব্যবহার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সাহাবীরা তাঁদের বর্ণনায় কখনও এ শব্দ ব্যবহার করতেন নাবরং শুধু "রাজিয়াল্লাহু আনহু" বা এ জাতীয় অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন। "রাজিয়াল্লাহু আনহু" শব্দের অর্থ আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোক।
৩- বিশিষ্ট সুন্নি মনীষী ইমাম ফাখরে রাজিও শিয়া মুসলমানদের ইমাম বা বিশ্বনবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদের নামের পর "আলাইহিসসালাম" দোয়াটি ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেনরাসূল (সা.)'র আহলে বাইত (আ.) কয়েকটি ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর সমান সুবিধা বা সম্মানের অধিকারী। সালাম এসবের মধ্যে অন্যতম। মহান আল্লাহ কোরআনে বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের প্রতি সালাম দিয়েছেন "আলে ইয়াসিনের ওপর সালাম" শব্দের মাধ্যমে।
৪- বিশিষ্ট সুন্নি মনীষী ইবনে হাজার মাক্কীও মনে করেনকোরআনে বর্ণিত "আলে ইয়াসিন" শব্দের অর্থ আলে মুহাম্মাদ (দ:) বা মুহাম্মাদের বংশধর। ইয়াসিন বিশ্বনবী (সা.)-এরই অন্যতম নাম।
৫-বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল কিভাবে আমরা আপনার প্রতি দরুদ পাঠাবউত্তরে তিনি বলেছিলেনতোমরা বলবে " আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলি মুহাম্মাদ" । সালামের মত দরুদ তথা সালাওয়াত পড়া বা সাল্লি আলা বলাও এক ধরনের দোয়া। এর অর্থ কল্যাণ কামনা করা।
তাই এটা স্পষ্ট বিশ্বনবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সদস্যদের নামের পরে বা তাঁদের নামের পাশে "আলাইহিসসালাম" বা "সালাওয়াতুল্লাহ আলাইহি" বলা একটি ধর্মীয় নির্দেশ এবং রাসূলের সুন্নাত।
আমাদের এই শ্রোতা ভাইয়ের প্রশ্নের আরেকটি অংশ হল, ‘আশা'রা মুবাশ্বারাতথা পৃথিবীতেই বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবির সংখ্যা দশ জন যাদের মধ্যে চার জন হলেন ইসলামের ইতিহাসের প্রথম চার জন খলিফাআর এই চার জনের একজন হলেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) অথচ শিয়া মুসলমানরা শুধু হযরত আলী (আ.)-কেই কেন প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?উত্তর:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ ওয়া আহদিনি লিমা আখতুলিফা ফিহি মিনাল হাক্কি বিইজনিকা ইন্নাকা তাহদি মানতাশায়ু সিরাতিম মুস্তাক্বিম।
(
হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ-সা. ও তার পবিত্র বংশধরদের ওপর দরুদ বর্ষিত হোক এবং আমরা যখন বিরোধ ও সন্দেহপূর্ণ বিষয়ের শিকার হই তখন তোমার প থেকে আমাদের সঠিক পথ দেখাওনিশ্চয়ই তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সঠিক পথ দেখাও)
এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়রেডিও তেহরান মুসলমানদের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়ের চর্চার চেয়ে তাদের ঐক্যের বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। (কারণশিয়া ও সুন্নি উভয় মাজহাবই এক আল্লাহঅভিন্ন ও এক পবিত্র কুরআন এবং বিশ্বনবী (সা.)কে শেষ নবী ও রাসূল বলে মানে। মতবিরোধ শুধু সাহাবিদের নিয়ে।) তা সত্ত্বেও আপনার প্রশ্নের জবাবে শিয়া মুসলিম ভাইদের কিছু বক্তব্য ও যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরছি যাতে আপনার মত পাঠক ও শ্রোতাদের কৌতুহল মেটে। (তবে আগেই বলে রাখছিবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনো সুন্নি ভাই শিয়া মুসলমানদের যুক্তি বা দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেবেন কিনা সেটা তাদের একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা এখানে একজন শ্রোতা/পাঠকের প্রশ্নের জবাবে প্রসঙ্গক্রমে শিয়া মুসলমানদের বক্তব্য ও সেসবের পক্ষে তাদের যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরছি মাত্র। কাউকে আহত করা বা বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরা রেডিও তেহরানের কাজ বা দায়িত্ব নয় কিংবা কোনো সাহাবির সম্মানহানি করাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। মোটকথা শিয়া মুসলমানদের এইসব বক্তব্য রেডিও তেহরানের নিজস্ব বক্তব্য নয় এবং এইসব মতামতের জন্য রেডিও তেহরান ও এর বাংলা বিভাগ দায়ী নয়। এই সর্তকবাণী নিম্নের আলোচনার জন্যও প্রযোজ্য।)
শিয়া ও সুন্নি দুটি ভিন্ন মাজহাব। এ দুই মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্যই কিছু না কিছু পার্থক্য থাকবেই। যেমন পার্থক্য রয়েছে সুন্নিদের চার মাজহাবের মধ্যেও। এই চার মাজহাবের ইমামরা যদি সব বিষয়ে একমত হতেন তাহলে তো তাদের মাজহাবের সংখ্যা চারটি না হয়ে একটিই হত। কিংবা তারা যদি একে-অপরকে নিজের চেয়ে বড় মনে করতেন তথা অন্য মাজহাবের ইমামদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন তাহলে অবশ্যই নিজ মাজহাব ত্যাগ করে অন্যের মাজহাব গ্রহণ করতেন।
তদ্রুপ শিয়া ও সুন্নি ভাইয়েরা তাদের মাজহাবের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কারা ছিলেন সে ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন। যেমনসুন্নি মাজহাবের দৃষ্টিতে হযরত আলী (আ.)'র মর্যাদা বা অবস্থান রাসূলের (সা.) ও প্রথম তিন খলিফার পরে চতুর্থ স্থানে। অন্যদিকে শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে আলী (আ.) রাসূলের (সা.)পর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকারণ তিনি ছিলেন রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের সদস্য। শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিতে কুরআন ও হাদিসেই রাসূল (সা.)'র আহলে বাইত (আ.)-কে সাহাবাদের উর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। (এমনকি তাঁদের মর্যাদা বিশ্বনবী (সা.) ছাড়া অন্যান্য নবী-রাসূলগণের চেয়েও বেশিঠিক যেমনটি সুন্নি বিশ্বে বলা হয় রাসূল (সা.)'র উম্মতের আলেমগণের মর্যাদা বনি-ইসরাইলের নবীগণের চেয়ে উচ্চতর। সব নবী-রাসূল বলেছেনআমরা নবী-রাসূল না হয়ে যদি শেষ নবী(সা.)'র উম্মত হতাম! বাংলাদেশসহ আমাদের উপমহাদেশে মসজিদের মিলাদ মাহফিলে সুর করে রাসূলের প্রশংসা বর্ণনার সময়
বলা হয়,[ (হে রাসূল- সা.!)- নবী না হয়ে হয়েছি উম্মত তোমার তার তরে শোকর হাজারবার।] হযরত ঈসা (আ.) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উম্মত হিসেবে আবারও পৃথিবীতে ফিরে আসবেন এবং আহলে বাইতের পবিত্র ইমাম তথা শেষ ইমাম হিসেবে বিবেচিত হযরত ইমাম মাহদী (আ.)'র পেছনে নামাজ পড়বেন ও তাঁর সাহায্যকারী হবেন। ব্যাপারটা খুবই লক্ষ্যনীয় যেএকজন নবী শেষ নবীর (সা.) বংশে জন্ম নেয়া একজন ইমামের পেছনে নামাজ পড়বেন!!! )
এটা স্পষ্টরাসূল (সা.)'র সাহাবিদের ব্যাপারে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সুন্নি মুসলমানদের দৃষ্টিতে সকল সাহাবিই সম্মানিত এবং আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট ও তারা সবাই বেহেশতে যাবেন। তবে কোনো কোনো সুন্নি ইমামের দৃষ্টিতেও রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের মর্যাদা রাসূল (সা.)'র পর সবার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ তাঁরা সাহাবাদের মধ্যেও সর্বোত্তম সাহাবা ছিলেন। এঁরা হলেন হযরত আলী (আ.)হযরত ফাতিমা (সাঃ আঃ)হযরত হাসান ও হোসাইন (আ.)। আর রাসূলের (সা.) আহলে বাইত বলতে এই কয়েজন ছাড়াও হযরত হোসাইন (আ.)'র বংশে জন্ম নেয়া আরো নয় জন ইমামকেও বোঝায়যাদের মধ্যে ইমাম মাহদী (আ.) হলেন সর্বশেষ ইমাম। এই আহলে বাইতরা যে নিষ্পাপ তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে বলে অনেক সুন্নি আলেমও তাদের তাফসিরে স্বীকার করেছেন। আর (নিকটতম) আহলে বাইত বলতেও যে কেবলই আলীফাতিমাহাসান ও হোসাইনকে বোঝায় (তাঁদের সবার ওপর সালাম ও দরুদ) তাও অনেক সুন্নি আলেম সুরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেছেন।
শিয়া মুসলমানরা বলেনমহানবী (স.) তাঁর আহলে বাইত বলতে তাঁর নিষ্পাপ ও পবিত্র বংশধরকে বোঝাতেন। যেমন- হযরত ফাতেমা (সাঃ আঃ)ইমাম হাসান ও হুসাইন (সালামুল্লাহি আলাইহিম)। কেননা মুসলিম স্বীয় সহীহ গ্রন্থে (মুসলিম শরীফ৭ম খণ্ডপৃ-১৩০)
এবং তিরমিযী স্বীয় সুনানে হযরত আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে,
হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ তো শুধু তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ রাখতে চান।" এই আয়াতটি মহানবী (স.) এর উপর উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালমা (সাঃ আঃ)'র ঘরে অবতীর্ণ হয়। মহানবী (স.)ফাতেমা(সাঃ আঃ)হাসান(আ.) ও হুসাইন (আ.)কে নিজের আলখাল্লা বা আবা'র মধ্যে নিলেন এমতাবস্থায় আলী (আ.) তাঁর পেছনে অবস্থান করছিলেন। তাঁদেরকে একটি চাদর দ্বারা আবৃত করে এরূপ দোয়া করলেন: "হে আমার প্রতিপালক! এরাই আমার আহলে বাইত। অপবিত্রতাকে এদের হতে দূর করে এদেরকে পবিত্র কর।" উম্মে সালমা বললেন: হে আল্লাহর নবী! আমিও কি তাঁদের অন্তর্ভুক্ত (আমিও কি উক্ত আয়াতে বর্ণিত আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত)তিনি বললেন: তুমি নিজের স্থানেই থাকো। তুমি সত্য ও কল্যাণের পথেই রয়েছ। অনেকে বলতে পারেন রাসূল (সা.) আহলে বাইত শব্দের আভিধানিক অর্থ ঘরের লোক। সেই হিসেবে হযরত আয়শা ও হাফসা প্রমুখ রাসূলের স্ত্রীগণও কি তাঁর আহলে বাইতশিয়া মুসলমানরা মনে করেন কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে রাসূলের স্ত্রীরা আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কারণআহলে বাইতের সদস্যরা মাসুম বা নিষ্পাপ ও পবিত্র। তাঁরা কখনও ভুল করেন না বা অন্যায় কিছু করেন না। কিন্তু হযরত আয়শা ও হাফসা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ৬৬ নম্বর সুরা তথা সুরা তাহরিমের চার নম্বর আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন:
"
তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে  পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা করতবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য করতবে জেনে রেখ আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী।" (৬৬-৪)
এ থেকে বোঝা যায় রাসূল (সা.)'র স্ত্রীগণ আহলে বাইতের সদস্য ছিলেন না। (যদিও হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ) সম্পর্কে হাদিসে এসেছে তিনি সর্বকালের চার সেরা নারীর একজন। অন্য তিনজন হলেন হযরত ফাতিমা (সাঃ আঃ)হযরত মারিয়াম (আঃ) ও ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া (আঃ)। )
আমরা জানি হযরত হাসান ও হোসাইন (আ.)-কে সুন্নি বিশ্বের জুমার খোতবায়ও বেহেশতি যুবকদের সর্দার বলা হয়। আর তাঁদের মা নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সাঃ আঃ)-কে বলা হয় জান্নাতের নারীদের সর্দার। অতএব তারা নিঃসন্দেহে এ পৃথিবীতেই বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। কিন্তু আশা'রা মুবাশ্বারা'য় এই তিনজনের নাম নেই।
শিয়া মুসলমানরা মনে করেন আহলে বাইত বহির্ভূত সাহাবারা নিষ্পাপ নন। তাই তারা ভুল করতে পারেন ও তাদের অনেকেই ভুল করেছেন। আবার তাদের অনেকেই ছিলেন সুমহান ও সৎকিন্তু সবাই নন। অথচ রাসূলের আহলে বাইতের সদস্যরা সবাইই নিষ্পাপ যা সুরা আহজাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে:
"
হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে (সব ধরনের ভুল-ত্রটি ও পাপ থেকে) পূত-পবিত্র রাখতে।"-সুরা আহজাব-৩৩
পবিত্র কুরআনে রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার নির্দেশ এসেছে। তাদের আনুগত্যও করতে বলা হয়েছে। যেমনসুরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতে এসেছে:
"(
হে নবী! আপনি)বলুনআমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক বা মুজুরি চাই না কেবল আমার পরিবারের প্রতি ভালবাসা চাই।"
সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে এসেছে:
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য করনির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমরবা তোমাদের মধ্যে যারা [আইনসঙ্গত] মতার অধিকারী তাদেরশিয়া মুসলমানরা মনে করেন ইতিহাসের কতগুলো বাস্তবতা উপো করা অন্ধের পওে সম্ভব নয়। যেমনসাহাবারা পরস্পর যুদ্ধ করেছেন। তাদের সবাই নিজেদেরকে সঠিক পথে অটল বলে দাবি করা সত্ত্বেও একে-অপরকে বিভ্রান্ত বলেছেন। হযরত আয়শাহযরত তালহা ও হযরত যুবাইর জামাল যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)'র বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন। এ যুদ্ধে মারা গেছেন দশ হাজার সাহাবি ও তাদের সন্তান। এ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর হযরত আয়শা ভুল স্বীকার করে হযরত আলী (আ.)'র কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। হযরত আলী (আ.) ও মুয়াবিয়ার অনুসারীদের মধ্যে সংঘটিত সিফফিন যুদ্ধে মারা গেছে অন্ততঃ ৫০ হাজার সাহাবি ও সাহাবিদের সন্তান এবং সঙ্গী। এসব যুদ্ধের ব্যাপারে সুন্নিদের বক্তব্য হল সাহাবা হওয়ার কারণে তারা উভয় পক্ষই ছিল সঠিক পথে। কিন্তু শিয়ারা বলেনদু-জন নবী বা দুজন সৎ মানুষ কখনও পরস্পরের সঙ্গে শত্রতা পোষণ বা যুদ্ধ করে না-এটাই বিবেকের দাবি। সিরাতুল মুস্তাক্বিম বা সঠিক পথ একটিই হয়একাধিক হয় না। এক লাখ বা দুই লাখ ২৪ হাজার নবী যদি একই যুগে একই অঞ্চলে থাকতেন তাদের মধ্যে কখনও ঝগড়া বিবাদ হত না। স্বার্থ নিয়ে বা মতা নিয়ে কখনও দু-জন ভাল মানুষের মধ্যেই দ্বন্দ্ব হয় না। তাই যে কোনো দ্বন্দ্বে অবশ্যই এক প সঠিক পথে থাকে অন্য প অন্যায়ের পে বা অন্ততঃ ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে।
হযরত আলী (আ.)হযরত তালহা ও যোবাইর-কে "আশা'রা মুবাশ্বারার" তালিকায় রাখা হয়েছে। তারা যদি জানতেন যে তারা বেহশতী হওয়ার সুসংবাদ দুনিয়াতেই পেয়েছেন তাহলে বেহেশতী হওয়া সত্ত্বেও কেন একে-অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেনতারা তো বলতে পারতেনআপনিও বেহেশতীআমিও বেহেশতীতাই আমরা সবাই সঠিক পথেই আছিআপনার কাজ আপনি করুন আমার কাজ আমি করিকেউ কারো কাজে বাধা দেয়ার দরকার নেই,আমরা কেন বেহেশতী হয়েও একে-অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবকিন্তু তারা কি এমন কথা বলেছেনতাছাড়া সুন্নি সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে আছেমুসলমানদের কেউ যদি একে-অপরকে হত্যার জন্য যুদ্ধ করে তবে তারা উভয়ই জাহান্নামি। জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে সাহাবিরা কি পরস্পরকে হত্যার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেননিযদি হাদিসটি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তো আলী (আ.)তালহা ও যুবাইর-সবাইই জাহান্নামি (নাউজুবিল্লাহ)। তাহলে আসল সত্য বিষয়টা কীনিচের হাদিসটি দেখুন:
রাসূল (সা.) একবার হযরত যোবাইরকে বলেছিলেন তুমি কি আলী(আ.)-কে ভালবাস। তিনি জবাবে বললেনএটা কেমন কথাআলীকে ভালবাসব না! তাছাড়া তিনি তো আমার আত্মীয়ও হন! রাসূল (সা.) বলেছিলেনকিন্তু একদিন তুমি তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হবে। জামাল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) যোবাইরকে এই হাদিস স্মরণ করিয়ে দিলে যোবাইর লজ্জিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছিলেনসে আমার উম্মতের একদল বাগীবিদ্রোহী বা পথভ্রষ্ট লোকের হাতে শহীদ হবে। যখন সিফফিন যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)'র পে যুদ্ধরত অবস্থায় মুয়াবিয়ার সেনাদের হাতে হযরত আম্মার (রা.) শহীদ হনতখন মুয়াবিয়ার পক্ষে থাকা অনেক সাহাবির বোধদয় হয়।
এ ছাড়াও রাসূল (সা.) বলে গেছেনআলী সব সময়ই হকের পথে থাকবে। "আলী (আ.)-কে মহব্বত করা ঈমানআর আলী(আ.)'র সঙ্গে শত্রতা করা মুনাফেকী" (মুসলিম১ম খণ্ডপৃ-৪৮)। " আমি জ্ঞানের শহরআলী তার দরজা"(সহি তিরমিজি৫ম খণ্ডপৃ;২০১)। এমনকি রাসূল (সা.) এ দোয়াও করেছেন যে, "হে আল্লাহ সত্যকে আলীর পক্ষে ঘুরিয়ে দিও।" রাসূল (সা.) আরো বলেছেনকেবল মুনাফিকই আলীর সঙ্গে শত্রতা করবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, " আলী আমার থেকে এবং আমি তাঁর থেকে এবং আলীই আমার পর সমস্ত মুমিনদের ওলি তথা অভিভাববক ও নেতা" (তিরমিজি৫ম খণ্ডপৃ-১১০)।
"
যে আলীকে দোষারোপ করলসে আমাকে দোষারোপ করলআর যে আমাকে দোষারোপ করল সে খোদাকে দোষারোপ করল। আল্লাহ তাকে মুখ নীচু করে দোজখে নিপে করবেন। "(সহি বুখারী-দ্বিতীয় খণ্ডসহি মুসলিম- দ্বিতীয় খণ্ডসহি তিরমিজি৫ম খণ্ড)।

"
আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। হে খোদা যে আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে তুমিও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখ,যে আলীর সাথে শত্রতা রাখে তুমিও তার সাথে শত্রতা রাখ।" (সহি মুসলিম২য় খণ্ডপৃ-৩৬২মুসনাদে ইমাম হাম্বল৪র্থ খণ্ডপৃ-২৮১) সাহাবিদের অনেকেই বলতেনআমরা আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও শত্রতা দেখে কে মুনাফিক ও কে মুমিন তা নির্ধারণ করতাম। পবিত্র কুরআনে সাহাবা বা মুহাম্মাদ (সা.)'র সাহবি বা সঙ্গীদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছেতারা কাফেরদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের পরস্পরের প্রতি দয়ালু বা রহমশীল। কিন্তু সাহাবাদের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ কি দয়া বা পারস্পরিক রহমের পরিচয় বহন করে?শিয়া মুসলমানরা এইসব বক্তব্যহাদিস ও যুক্তির আলোকে বলেন যেসাহাবারা ভুল করতে পারেন ও অন্যায় যুদ্ধেও লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু নবী বংশের ইমাম বা রাসূলের আহলে বাইত (আ.) ভুল করতে পারেন না কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে নিষ্পাপ হওয়ার কারণে।
আর শিয়া মুসলমানরা এটাও মনে করেন যেন্যায় ও অন্যায়ের প্রশ্নে এবং সঠিক ও ভুল পথের প্রশ্নে অবশ্যই ন্যায়ের পক্ষ নিতে হবে। সঠিক ও ভুল পথ কখনও সমান হতে পারে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে যারা বলবে যে আমরা উভয় পক্ষেই আছি বা উভয় পক্ষকেই সম্মান করিতা হবে সুবিধাবাদিতা ও অনৈতিক। তারা আরও বলেনআমরা যদি রাসূল (সা.)-কে ভালবাসি তাহলে তাঁর বন্ধুদেরকেও ভালবাসতে হবে এবং তাঁর শত্রদেরকে বা বিপক্ষ শক্তিকেও ভালবাসি বলা যাবে না। ঠিক একইভাবে যদি বলি যে আলী (আ.)-কে ভালবাসি তাহলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি বা বিরোধী গ্রপকেও ভালবাসা উচিত নয়।
এবার আমরা সুন্নী মাজহাবের হাদিসের আলোকে অন্য সাহাবিদের তুলনায় আমিরুল মুমিমিন হযরত আলী (আ.) এবং রাসূল (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত বা নিষ্পাপ বংশধরদের শ্রেষ্ঠত্বের সপে আরো কিছু দলিল তথা হাদিস ও রেওয়ায়েত বা ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরছি:
এই আলী আমার ভাইআমার ওয়াসি এবং আমার পর আমার প্রতিনিধি হবে। তাই তাঁর আদেশ শোনতাঁর আদেশ মত কাজ কর।" (তাফসিরে তাবারি১৯ খণ্ডপৃ-১২১, ‘লাইফ অফ মুহাম্মাদ'-ড. মো. হোসাইন হায়কাল,প্রথম সংস্করণ১৩৫৪ হি,প্রথম খণ্ডপৃ-১০৪)
হযরত আহমদ বিন হাম্বল বলেছেন, "যত ফজিলতের বর্ণনা আলীর বেলায় এসেছে অন্য কোনো সাহাবির বেলায় তা আসেনি। আলী (আ.)'র অসংখ্য শত্র“ ছিল। শত্ররা অনেক অনুসন্ধান করেছে আলী (আ.)'র দোষ-ত্রটি বের করারকিন্তু পারেনি।"
হযরত কাজী ইসমাইল নাসায়ি আবু আল নিশাবুরি বলেন, "যত সুন্দর ও মজবুত সনদের দ্বারা আলী (আ.)'র ফজিলতগুলো বর্ণিত হয়েছে-অন্য সাহাবিদের বেলায় তেমনি আসেনি।"
হাদিসে সাকালাইন
১। মুসলিম স্বীয় সহীহ গ্রন্থে যায়েদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণনা করেন যেআল্লাহর রাসূল (স.) একদিন মদিনা ও মক্কার মধ্যবর্তী স্থলে "খুম" নামক একটি পুকুরের কাছে খোতবা দান করেন। উক্ত খোতবায় তিনি আল্লাহর প্রশংসার পর লোকদেরকে নসিহত করে বলেন:
হে লোকসকল! আমি একজন মানুষ। খুব শিগগিরি আমার প্রভুর নিযুক্ত ব্যক্তি আমার কাছে আসবে এবং আমিও তাঁর আহ্বানে সাড়া দেব। আমি তোমাদের মাঝে দু'টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছিযার একটি হল আল্লাহর কিতাবযাতে রয়েছে নূর এবং হেদায়েত। আল্লাহর কিতাবকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধর। রাসূল (স.) আল্লাহর কিতাবের উপর আমল করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অত:পর বলেন: আর অপরটি হলো আমার আহলে বাইত। আমার আহলে বাইতের বিষয়ে তোমাদেরকে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি (অর্থাৎ মহান আল্লাহকে ভয় করে তাদেরকে অনুসরণ কর) এই বাক্যটিকে তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন। সূত্র: সহীহ মুসলিম৪র্থ খণ্ড,পৃ.১৮০৩। দারেমী এই টেক্সট বা মাতন তথা হাদিসের মূলপাঠটি নিজ সুনান'-শীর্ষক বইয়ে বর্ণনা করেছেন। সূত্র:সুনানে দারেমী২য় খণ্ডপৃ. ৪৩১-৪৩২।
২। তিরমিযি এই হাদিসটিতে শব্দগুলো বর্ণনা করেছেন। মূল হাদিসটি হলো:
"
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু'টি ভারী (মূল্যবান) জিনিস (আমানত হিসেবে) রেখে যাচ্ছি। যদি তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধর তবে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। সেগুলো একটি অপরটির উপর প্রাধান্য রাখে। (সেগুলো হচ্ছে) আল্লাহর কিতাব যা আসমান হতে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত (রহমতের) ঝুলন্ত রশির ন্যায় এবং অপরটি হলো আমার বংশধরআমার আহলে বাইত। এরা হাউযে কাওসারে আমার সঙ্গে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও একে অপর হতে আলাদা হবে না। অতএবতোমরা ল্য রেখ যেআমার (ছেড়ে যাওয়া)
আমানতের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করো।'' (সূত্র:সুনানে তিরমিযি৫ম খণ্ডপৃ. ৬৬৩।)
মুসলিম এবং তিরমিযী যাদের দু'জনই সহীহ হাদিস গ্রন্থ এবং (দুই পৃথক) সুনান'-এর প্রণেতা। আর (মুসলিম এবং তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত) উক্ত হাদিস দু'টি সনদগত দিক থেকে পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য এবং কোনরূপ আলোচনা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন রাখে না। অর্থাৎএই হাদিস দু'টি সনদগতভাবে দিবালোকের মতো স্পষ্ট ও নিখুঁত।
হাদিসে সাকালাইনের ভাবার্থ
যেহেতু মহানবী (স.) নিজ বংশধরকে পবিত্র কুরআনের পাশে স্থান দিয়েছেন এবং উভয়কে উম্মতের মাঝে আল্লাহর হুজ্জাত (চূড়ান্ত দলিল) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তাই এ দু'টির প্রতি দৃষ্টি রেখে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়:
১। মহানবী (স.) এর বংশধরদের বাণী কুরআনের মতোই হুজ্জাত (চূড়ান্ত দলিল)। আর দ্বীনি বিষয়ে চাই তা বিশ্বাসগত (আকিদাগত) দিক হোক আর ফেকাহগত দিক হোকঅবশ্যই তাদের বাণীকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে এবং কোনো বিষয়ে তাদের প থেকে
বর্ণিত কোনো যুক্তি বিদ্যমান থাকলে অন্যের শরণাপন্ন হওয়া বৈধ নয়।
মহানবী (স.) এর ওফাতের পর মুসলমানরা যদিও খেলাফত এবং উম্মতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিষয়টিতে দু'টি দলে বিভক্ত হয়েছেন এবং প্রত্যেকেই নিজেদের দাবির সপে যুক্তি পেশ করেছেন এবং এসব বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছেতারপরও আহলে বাইত (আ.) যে ধর্মীয় জ্ঞানের নির্ভুল উৎস সে বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা উচিত নয়। কেননা সবাই হাদিসে সাকালাইন সহীহ হওয়ার পে ঐকমত্য পোষণ করেন। আর এই হাদিসে পবিত্র কুরআন এবং আহলে বাইত (আ.)- কে আকাঈদ ও আহকামের বিষয়ে মারজা বা
একমাত্র ফয়সালাকারী কর্তৃপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদি উম্মতে মুহাম্মাদী (স.) এই হাদিসটির ওপর আমল করে তাহলে তাদের মতানৈক্য কমে আসবে এবং তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
২। পবিত্র কুরআন যেহেতু মহান আল্লাহরই বাণীতাই এ মহাগ্রন্থ সব ধরনের ভুল-ত্রটি হতে মুক্ততাই কিভাবে তার মাঝে ভুল-ত্রটির সম্ভাবনা থাকবে যখন স্বয়ং মহান আল্লাহই এই মহাগ্রন্থ সম্পর্কে বলেন :
"
তাতে তার আগে ও পিছে কোনো দিক থেকেই বাতিল বা মিথ্যা প্রবেশ করতে পারে না। তা তো প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত আল্লাহর প থেকে নাজিল করা হয়েছে।" যদি পবিত্র কুরআন সব ধরনের ভুল ও বাতিল হতে মুক্ত হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে তার সমকও সব ভুল-ত্রটি থেকে মুক্ত। কেননা নিষ্পাপ নয় এমন ব্যক্তি অর্থাৎ কোনো গোনাহগার ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা পবিত্র কুরআনের জুটি হতে পারে না। হাদিসে সাকালাইন ও এই আয়াতে কারিম তাঁদের তথা আহলে বাইত (আ.)-গণের সব ধরনের ভুল-ত্রটি হতে মুক্ত হওয়ার সাী স্বরূপ। অবশ্য মনে রাখতে হবে যেনিষ্পাপ হওয়ার অর্থ নবী হওয়া নয় বা নিষ্পাপ হওয়ার জন্য নবী হওয়া জরুরি নয়। কেননা
এমন হতে পারে যেকোনো এক ব্যক্তি নিষ্পাপ বা গুনাহ হতে মুক্ত কিন্তু নবী নন। যেমন- হযরত মারইয়াম (আ.) নিম্নোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে গুনাহ হতে মুক্ত কিন্তু নবী নন:
"...
আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র করেছেন। আর তোমাকে বিশ্বের নারীদের ওপর মনোনীত করেছেন।"
আরো কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা :
রাসুলের আহলে বাইত বা পবিত্র বংশধরের মর্যাদা এত বেশি যেসুন্নি ইমাম শাফেয়ী তার প্রসিদ্ধ কবিতায় বলেছেন: "হে মহানবী (স.) এর বংশধর! তোমাদের প্রতি ভালোবাসা একটি ফরজ কাজ যা মহান আল্লাহ কোরআনে অবতীর্ণ করেছেন। তোমাদের মাহাত্ম প্রমাণের ক্ষেত্রে এতটুকুই যথেষ্ট যেযে ব্যক্তি তোমাদের ওপর দরুদ পড়বে না তাঁর (আল্লাহর রাসূলের) জন্যও সে দরুদ পড়নি।"
অন্যদিকে সাহাবিদের একদল সম্পর্কে হাদীসে এসেছেঃ
বুখারী ও মুসলিম মহানবী (স.) হতে বর্ণনা করেছেন যেতিনি বলেছেন:
"
কিয়ামতের দিন আমার সাহাবিদের মধ্যে হতে একটি দল (অথবা বলেছেন আমার উম্মতের মধ্য হতে) আমার সামনে উপস্থিত হবে। অতঃপর তাদেরকে হাউজে কাওসার হতে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে (হাউজে কাওসারে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না)। তখন আমি বলব:
হে আমার প্রভু! এরা আমার সাহাবি। মহান আল্লাহ উত্তরে বলবেন: আপনার পরে এরা যা কিছু করেছে সে সম্পর্কে আপনি অবগত নন। তারা তাদের পূর্বাবস্থায় (অজ্ঞতা তথা জাহেলিয়াতের যুগে)প্রত্যাবর্তন করেছিল। (বোখারী৪র্থ খণ্ডপৃ-৯৪১৫৬ পৃ২য় খণ্ড,
৩২ পৃমুসলিম শরীফ ৭ম খণ্ডপৃ-৬৬)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে রাখুন ও সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ দিন এবং ইসলামী ঐক্য জোরদারের তৌফিক দিন ও কাফেরদের ইসলাম-বিরোধী ষড়যন্ত্রগুলো বানচালের যোগ্যতা দান করুন। আমীন।

No comments:

Post a Comment