Wednesday, June 15, 2016

রাসুলের (সাঃ) ঘোষিত বার ইমাম কারা? আর পাকপঞ্চাতন বা কি ?

রাসুলের (সাঃ) ঘোষিত বার ইমাম কারা? আর পাকপঞ্চাতন বা কি ? 
বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
5. হযরত বাকের (আ.) : অত্যাচারী শাসক আবদুল মালেকের শাসনামলে ১১৪ হিজরী সনের ৭ জিলহজ্ব তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
ইসলাম বিশ্ব-সভ্যতার পূর্ণতার নিয়ামক। আর ইসলামের পরিপূর্ণতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলেন বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)। আর মহানবীর আহলে বাইতের ১২ সদস্যের প্রত্যেকেই হলেন হেদায়াতরূপ খোদায়ী নূরের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ও মানবীয় পরিপূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শের দিশারী তথা খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের সংরক্ষক, ক্রম-বিকাশক এবং পূর্ণতার মাধ্যম। তাই পয়লা রজব ইসলামের ইতিহাসের এক মহাখুশির দিন। কারণ, এই দিনে পবিত্র মদীনায় জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য তথা তাঁর নাতির নাতি হযরত ইমাম বাক্বির (আ.)। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর সাহাবি জাবের (রা.)-কে বলেছিলেন যে তুমি আমার বংশধর বাক্বিরকে দেখতে পাবে এবং তাঁর কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও। জাবের (রা.) সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নবীজীর আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) ১১৪ হিজরী সনের ৭ জিলহজ্ব ৫৭ বছর বয়সে শাহাদাতবরণ করেন। যেদিন তার শাহাদাতের খবর মদীনা শহরে ছড়িয়ে পড়লো সেদিন আহলে বাইতের অনুরাগীদের অন্তর শোকে-দুঃখে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিল। কারণ হলো তারা আর নবীজীর আহলে বাইতের ঐ নূরানী ও সদয় চেহারাটি আর দেখবে না,মসজিদে আর তাঁর হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ বক্তব্য শুনতে পাবে না-এই চিন্তায় তাদের মন ভেঙ্গে গেল। ইমামের অস্তিত্বহীনতা তাঁর ঘনিষ্ট সহচরদের জন্যে ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন জাবের ইবনে ইয়াযিদ জোফি। দুঃখের মুহূর্তগুলো যেন তার কাটছিল না। তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল ইমামের প্রিয় সান্নিধ্যের বহু অমর স্মৃতি। জাবের প্রথমবারের মতো যখন ইমামকে মসজিদে দেখেছিলেন তখন বহু কৌতূহলী মানুষ ইমামের চারদিকে বৃত্তাকারে বসে ছিলেন। সবাই তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাময় কথা শুনছিলো। প্রথম যেই উপদেশটি তিনি ইমামের কাছ থেকে শুনেছিলেন সেটা তিনি কখনোই ভোলেন নি,সবসময় তা তার স্মরণে ছিল।
ইমামের ঐ উপদেশ তাকে সবসময় জ্ঞান-অন্বেষী করে রেখেছিল। ইমাম বাকের (আ.) বলেছিলেনঃ 'জ্ঞান অন্বেষণ করো! কেননা জ্ঞান অন্বেষণ করা পূণ্যের কাজ। জ্ঞান তোমাকে অন্ধকারে পথ দেখাবে, দুঃসময়ে জ্ঞান তোমাকে সাহায্য করবে। জ্ঞান হলো মানুষের সবচেয়ে উত্তম বন্ধু।' এই উপদেশ পাবার কারণে জাবের ইমাম বাকের (আ.) এর যুক্তি বাহাসের জলসায় এবং যে-কোনো জ্ঞানের আসরে উপস্থিত থাকতেন। ইমামের প্রজ্ঞাময় বক্তৃতা থেকে ভীষণ উপকৃত হতেন। জাবের তাই ইমামকে হারাবার ব্যথায় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ইমামের স্মৃতিময় সান্নিধ্যের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন আর আনমনে ইমামের সেই বাণীটি আওড়ালেনঃ 'হে জাবের!যার অস্তিত্বে বা সত্ত্বায় আল্লাহর স্মরণের মাহাত্ম্য বিদ্যমান রয়েছে তার অন্তরে আর অন্য কোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসা জাগবে না। খোদাকে যারা অন্বেষন করে,যারা তাকেঁ পেতে চায় তারা দুনিয়া পুজারী হয় না,পার্থিব জগতের মোহ তাদের মাঝে থাকে না। তাই চেষ্টা করো আল্লাহ তাঁর হেকমাত ও দ্বীনের যা কিছু তোমার কাছে আমানত রেখেছেন তা রক্ষণাবেক্ষণ করো!'
জাবেরও ইমামের জন্যে শোকাভিভুত জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হলো। একদল লোক ইমামের পবিত্র লাশ কাধেঁ করে নিয়ে মদীনা শহরের বাকি কবরস্থানে নিয়ে গেল এবং তাকেঁ সেখানে দাফন করলো। এই দিনটিই সেইদিন অর্থাৎ ১১৪ হিজরীর জিলহজ্ব মাসের ৭ তারিখ। যেখানেই সত্য,ন্যায় ও বাস্তবতার নিদর্শন দেখা যাবে সেখানেই আহলে বাইতের নাম জ্বলজ্বল করবে। কেননা তাঁরা ছিলেন নীতিনৈতিকতার বিচারে সবোর্চ্চ পর্যায়ের। তাঁরা সবসময় অঙ্গনে এসেছেন সত্য-কল্যঅন ও মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছার পথ দেখাতে। মানুষের মাঝে তাদেঁর অস্তিত্বই ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল পথ প্রদর্শকের মতো।
ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতির মেয়াদকাল ছিল ১৯ বছর। হিজরী ৯৫ সালে তাঁর এই মেয়াদকালের সূচনা হয়। এই সময়টাতে ইসলামী সমাজ উমাইয়া শাসকদের শেষ দিককার এবং আব্বাসীয় শাসনের শুরুর দিককার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল। এই মেয়াদকালে বহু কিতাব এবং দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল। সেইসাথে কালের এই ক্রান্তিলগ্নে সমাজে বহুরকম বিকৃত ফের্কার বিস্তার ঘটেছিল। মানুষ তাই বিকৃত চিন্তার বেড়াজালে আটকে পড়ার সুযোগ ছিল খুব সহজেই। ইমাম বাকের (আ.) এবং তাঁর সন্তান ইমাম সাদেক (আ.) ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে দ্বীনের যথার্থ স্বরূপ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরার জোর প্রচেষ্টা চালান। তাদেঁর এই প্রচেষ্টা ছিল বেশ প্রভাব বিস্তারকারী। বিশেষ করে তাঁরা মদীনায় একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
জ্ঞানপিপাসু ও আধ্যাত্মিকতার আলো প্রত্যাশীরা দলে দলে তাই মদীনায় যেতে শুরু করেন। এভাবে দ্বীনের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। এ কারণেই তাকেঁ বাকেরুল উলুম নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ হলো পণ্ডিত বা জ্ঞানের বিশ্লেষক। ইমাম বাকের (আ.) তাঁর সময়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষার সীমান্তপ্রহরী ছিলেন। ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি ও নৈতিকতার বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিকৃত আকিদা ও চিন্তাচেতনার বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং ইসলামের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোর দৃঢ়তা ও মজবুতির ক্ষেত্রে ইমাম বাকের (আ.) মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন।
একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই যেসব শাসক অত্যাচারী এবং কেবল নিজেদের স্বার্থচিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং মানবীয় কোনো নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন নয় তারা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতিকালটি ছিল তেমনি এক শাসকগোষ্ঠির শাসনকাল। ইমাম তাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং একজন সৎ নেতৃত্বের গুণাবলি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। এভাবে অত্যাচারী খলিফাদের কাজকর্ম জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে।সে কারণে আব্বাসীয় শাসক বিশেষ করে হিশাম বিন আব্দুল মালেকের ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন ইমাম।
ইমাম বাকের (আ.) সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে বলেনঃ নিঃসন্দেহে যাদের মাঝে তিনটি গুণের সমাবেশ নেই তারা নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। ঐ তিনটি গুণ হলো-এ্যাকঃ আল্লাহকে ভয় করা এবং খোদার নাফরমানী থেকে নিরাপদ থাকা, দুইঃ সহিষ্ণুতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা এবং তিনঃ অধীনস্থদের ব্যাপারে পিতৃসুলভ সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা।
ইমাম বাকের (আ.) ছিলেন পরোপকারী ও অসহায়-বঞ্চিত জনগোষ্ঠির প্রতি সদয়। তিনি নিঃস্ব-হতদরিদ্রদের সাথে মিশতেন। তাদের সাথে কথা বলে তাদের ক্লান্ত আত্মাকে প্রশান্ত করতেন। তিনি সবাইকে বলতেন বঞ্চিতদেরকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাকা না হয়। তাঁর জ্ঞান আর মিষ্টি আচার-আচরণের কারণে জনগণ তাঁর কথায় ব্যাপক আকৃষ্ট হত। বহু ছাত্র তিনি তৈরি করে গেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস এখনো মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগছে। হিশাম বিন আব্দুল মালেক ইমামের এই প্রভাব সঞ্য করতে পারলো না। সে ছিল অর্থলোভি এক পাথর-হৃদয়। সে তার অধীনস্থদের আদেশ দেয় বিভিন্নভাবে ইমামকে যেন চাপের মুখে রাখা হয়। কিন্তু কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করে ইমামকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। ইমামের বিরুদ্ধে তাই হিশামের অন্তরে ক্ষোভের আগুণ আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।
অবশেষে হিশাম ইমামের নূরানী অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলো। সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ইমাম বাকের (আ.) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাতের সেই শোকাবহ স্মৃতিময় দিনটিই হলো ৭ জিলহজ্ব।
6. হযরত জাফর সাদিক (আ.) : আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, নিকৃষ্ট, প্রতিহিংসাপরায়ণ খলিফা ছিল মানছুর। মানছুর ইমামকে খুব কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছিল। তাঁর পিছনে গোয়েন্দা লাগানো হয়েছিল। ইমামের প্রতি জন সমর্থন মানছুরের হিংসার কারণ ছিল। অবশেষে ১৪৭ হিজরীর ৫ শাওয়াল বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে।
সঠিক ও অবিচ্যুত ইসলামকে যাঁরা সংরক্ষণ করেছেন নানা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, যাঁরা ছিলেন প্রত্যেক যুগে ভুল পথে চলা মানুষের জন্য সত্য ও সঠিক পথের দিশারী, যাঁরা তুলে ধরেছেন মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের স্বরূপ, যাঁরা ছিলেন জালিম ও ইসলামের তকমা ব্যবহারকারী শাসকদের মোকাবেলাসহ সবক্ষেত্রে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)’র নিষ্কলুষ অনুসারী এবং যাঁদের উচ্চমানসম্পন্ন জ্ঞান ও ফজিলত ছিল মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় সৌভাগ্যের পথনির্দেশনা বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.) ছিলেন সেইসব মহামানবদের মধ্যে অন্যতম। ইসলামের মহাতরীর অন্যতম কর্ণধার এই মহাপুরুষের পবিত্র জন্ম বার্ষিকী তথা ১৭ ই রবিউল আউয়াল উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ এবং তাঁর প্রতি অশেষ সালাম ও দরুদ। উল্লেখ্য, এই একই দিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'রও পবিত্র জন্ম বার্ষিকী। ( বিশ্বনবী-সা.'র জন্মদিন সম্পর্কে আমাদের ওয়েব সাইটের 'সমাজ-সংস্কৃতি' অংশের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য)
আজ এই মহাখুশির দিনে আমরা এই মহান ইমামের আলোকোজ্জ্বল আদর্শ ও অশেষ বরকতময় জীবনের কিছু দিকের কথা স্মরণ করব।
খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রূপকার ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। তিনি ৮৩ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদীনায় ভূমিষ্ঠ হন। বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদিক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা ( মহান আল্লাহ তাঁদের দান করুন অপার ও অসীম প্রশান্তি ) নিজেদের রক্ত দিয়ে নবী (সা.)’র রেখে যাওয়া পথকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা কেবল বক্তব্য নয়, বরং মূলত নিজেদের আমল ও আখলাকের মাধ্যমে কুরআন ও তৌহিদের শিক্ষাকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা ছিলেন ইতিহাস বিকৃতকারীদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ও জাহিল ধর্মহীন শাসকদের নিক্ষিপ্ত প্রতিটি পাথরের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই মহান ইমামগণ যাতে ইসলামের কোনো বিপর্যয় বা ক্ষতি না হয়। তাঁর ইমামতের সময়কাল ছিল ১১৪ থেকে ১৪৮ হিজরি পর্যন্ত। এই ৩৪ বছরে মুসলিম জাহানের শাসকরা ছিল: বনি উমাইয়া থেকে হিশাম বিন আবদুল মালিক, ওয়ালিদ বিন ইয়াজিদ বিন আবদুল মালিক, ইয়াজিদ বিন ওয়ালিদ, ইব্রাহিম বিন ওয়ালিদ, মারওয়ান হিমার এবং বনি-আব্বাস থেকে সাফফাহ ও মানসুর দাওয়াকিনি।
নবী বংশের যোগ্য উত্তরসূরি ও ইমামতের আকাশে অন্যতম প্রদীপ্ত সূর্য হযরত ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) খোদায়ী জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামকে এমন আলোকময় করেছেন ঠিক যেভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, বীরত্ব ও রক্ত দিয়ে ইসলামকে পবিত্র রেখেছিলেন। কেউ যদি মুহাম্মাদী ইসলামের বা প্রকৃত ইসলামের খাঁটি শিক্ষাগুলোর নির্মল ঝর্ণায় অবগাহন করতে চায় তাহলে হযরত ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র রেখে-যাওয়া ইসলামী শিক্ষার অমূল্য বিদ্যানিকেতনে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। মুমিনদের ওপর তিনি ঠিক সেরকম অধিকার রাখেন যেমনিভাবে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)’র জিহাদ, হযরত হাসান (আ.)’র সন্ধি-চুক্তি, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের রক্ত, খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা ও যেইনাব (সা.)’র অশ্রুজল আমাদের ওপর অধিকার রাখে।
মহান ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষার দিগন্তকে এত উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের কোনো অপচেষ্টাই তাঁর প্রস্ফুটিত অন্তর্দৃষ্টির নূরের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন এতটা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল যে কারাবালায় নবীবংশের ওপর জালিম শাসকচক্রের চরম দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এর প্রায় শত বর্ষ পর সেই একই বংশের তথা মহানবী(সা.)’র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী বিন মূসা রেজা (আ.) যখন ইরানের নিশাপুরে আসেন তখন সেখানে আহলে বাইতের প্রেমিক হাজার হাজার মানুষ নীরব অবস্থায় দাড়িয়ে ছিল তাঁর বক্তব্য শুনতে। ইতিহাসে এসেছে চব্বিশ হাজার মানুষ ইমামের কথাগুলো হাদীস হিসেবে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সেদিন।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) মুসলমানদের সব মাজহাবের কাছেই বরেণ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাঁর আদর্শ হতে পারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সূত্র। চারজন সুন্নি ইমামের মধ্যে একজন তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং আরো দুই জন সুন্নি ইমাম তাঁর পরোক্ষ ছাত্র ছিলেন। উল্লেখ্য শিয়া মাযহাব ইমাম জাফর সাদেক (আ) এর জ্ঞান থেকে বিরতিহীনভাবে গ্রহণ করে হৃষ্টপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়েছে, যে কারণে শিয়া মাযহাব 'জাফরি মাজহাব' হিসেবেও খ্যাত।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রথম ইমাম আবু হানিফা ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেছেন, যদি ওই দুই বছর না থাকত তবে নোমান তথা আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত।
তিনি আরো বলেছেন, “আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের (তথা ইমাম জা’ফর আস সাদিক আ.) চেয়ে বড় কোনো ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তি দেখিনি। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।”
মালিকি মাজহাবের ইমাম মালেক বিন আনাস ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহর শপথ! মানুষের কোনো চোখ সংযম সাধনা, জ্ঞান, ফজিলত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে জা’ফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কাউকে দেখেনি, কোনো কান এসব ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় কারো কথা শুনেনি এবং কোনো হৃদয়ও তা কল্পনা করেনি।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.) এমন এক যুগে জীবন যাপন করতেন যখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও গ্রীক পণ্ডিতরা সৃষ্টির উতস, তৌহিদ বা একত্ববাদ, পরকাল ও নবুওতসহ মুসলমানদের মৌলিক ঈমান-আকিদাসহ প্রধান চিন্তাধারার মধ্যে নানা সন্দেহ বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। আর মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও ছিল নানা বিচ্যুত ধারা। এইসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সঠিক যুক্তি ও চিন্তাধারা তুলে ধরে ইসলামের সংরক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মহান ইমাম। এ ছাড়াও মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া নানা কুসংস্কার ও কুপ্রথা উচ্ছেদের জন্য ইসলাম এবং কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)।
উমাইয়া খেলাফতের শেষের দিকে ও আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে তারা উভয় পক্ষ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল থাকায় ইমাম সাদিক (আ.)’র হাতে ছিল মুক্ত সময়। এ সময় ইমামের জ্ঞান-আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করে এবং মদীনার আলেমরাসহ হাজার হাজার মানুষ নানা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে থাকে। চার হাজার ছাত্র নানা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল এই মহান ইমামের কাছ থেকে। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ ও গণিতবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’রই ছাত্র। ইমামের জ্ঞান কেবল দ্বীনী বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। তিনি রসায়ন, পদার্থ, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে মালেক বিন আনাস বলেছেন, তিনি হয় সর্বদা রোজা রাখতেন, অথবা নামাজ পড়তেন অথবা আল্লাহর জিকির করতেন। প্রচুর হাদিস বলতেন ও বৈঠকের কর্ণধার ছিলেন। ইমামের সামনে বিশ্বনবী (সা.)’র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। একবার তাঁর সঙ্গে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করছিলেন।
নবী-রাসূলদেরকে যেমন অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়ে, তেমনি তাদের উত্তরসূরি মহান ইমামদেরকেও একই অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল আব্বাসিয় জালিম শাসক মনসুর দাওয়ানিকি। দাওয়ানিকি বলেছিল:
"জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছে না, কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।"
দাওয়ানিকির নির্দেশে (১৪৭ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল) বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয় ইসলামের এই চিরপ্রদীপ্ত সূর্য ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)কে। কিন্তু শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বরং আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। ৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম-প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন:
তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতে? তাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতাম, কাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ।
ইমাম জা’ফর আস সাদিক (আ.)’র কয়েকটি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা:
যারা নামাজকে গুরুত্বহীন মনে করবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।
ইমাম বলেছেন, কোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারা, সঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।
তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়, যুদ্ধের সময় বীরত্বের পরিচয় ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।
9. হযরত ইমাম মুহাম্মদ ত্বাফী (আ) : আব্বাসীয় খলিফাদের সবাই ইমামগণের কর্মকাণ্ডের প্রতি ভীত ছিল। তাদের ভয় ছিল খেলাফতী চলে যাবে। সকল ধরনের কৌশল এবং ষড়যন্ত্র তারা ইমামগণকে হত্যা করার জন্য চালিয়েছে। ক্ষমতালোভী বস্তুবাদী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফাগণ হত্যা, জিনা, মদ্যপান, লুণ্ঠন, সম্পদের অপব্যয় সকল কিছু করেছে। ইসলামের নামে তারা ছিল মোনাফেক মুসলিম। ক্ষমতালোভী আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর নির্দেশে তাকে ২২০ হিজরীতে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয় ।
হিজরি জিলক্বাদ মাসের শেষ দিন নবীজীর আহলে বাইতের ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর শাহাদাতবার্ষিকী। ২২০ হিজরির এই দিনে ইমাম জাওয়াদ (আ) খোদার দিদারে চলে যান আর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ইমামকে হারানোর ব্যথায় শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। নবীজীকে রেসালাতের যে মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, নবীজীর অবর্তমানে সেই মহান দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় তাঁর আহলে বাইত ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালান। নবীজীর চিন্তার সেই গভীর জ্ঞানের আলো দিয়ে তাঁরা মুসলিম উম্মাহর সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনায়ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। আমরা যদি একবার নবীজীর আহলে বাইতের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো ইসলামের মৌলিক ভিত্তিকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন।
তাঁরা সবসময় কায়েমি স্বার্থবাদীদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন যাতে ইসলামের মহান স্বরূপ সর্বদা অটুট থাকে। ইমাম জাওয়াদ (আ) নবীজীর আহলে বাইতের একজন ইমাম যিনি তাঁর ১৭ বছরের ইমামতিকালে সবসময় ইসলামের প্রচার-প্রসারে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মহান এই ইমামের বেদনাঘন শাহাদাতবার্ষিকীতে তাই আপনাদের জানাচ্ছি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা। তাঁর জীবন থেকে খানিকটা আলোচনা করে আমরা সমৃদ্ধ করবো আমাদের জীবন।
ইমাম জাওয়াদ (আ) তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন,'মানুষ যদি তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে। একটি হলো-আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। দুই,মানুষের সাথে নম্র আচরণ করা এবং তিন,বেশি বেশি দান-সদকা করা।' ইমাম জাওয়াদ (আ) মানুষের সেবা করাকে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হবার কারণ বলে মনে করেন। এ ব্যাপারে কেউ যদি কৃপণতা করে তাহলে তাহলে আল্লাহর নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন: আল্লাহর নিয়ামত যখন কারো ওপর নাযিল হয়, তার কাছে মানুষের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। মানুষের এই প্রয়োজনীয়তা মেটানোর চেষ্টা যে না করে,সে নিজেকে আল্লাহর নিয়ামত হারানোর আশঙ্কার মুখে ঠেলে দেয়।
ইমাম জাওয়াদ (আ) ইমাম রেযা (আ) এর সন্তান ছিলেন। ১৯৫ হিজরিতে তিনি মদিনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর জীবনযাপন করেন। এই স্বল্পকালীন জীবনে তিনি মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও উন্নয়নে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর ও সন্দেহজনক। এই সন্দেহের কারণ হলো বহু মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়কে কেবল তার বাহ্যিক এবং বস্তুগত মানদণ্ডেই বিচার-বিবেচনা করে থাকে। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি আল্লাহর সর্বশক্তিমান ক্ষমতারই নিদর্শন।
ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় বিস্ময়কর উন্নত পর্যায়ের। ইতিহাসে এসেছে একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদিনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। এরকম জবাব পাবার ফলে জাওয়াদ (আ) এর ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে গেল। ইমাম জাওয়াদ (আ) বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের সাথে এমন এমন তর্ক-বাহাসে অংশ নিতেন যা কিনা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। এসব বিতর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যেত। কেবল তাই নয় তাঁর দেওয়া যুক্তির ফলে জ্ঞানের বহু জটিল বিষয়ও সহজ হয়ে যেত।
এ কারণে জ্ঞানীজনেরা এমনকি তাঁর বিরোধীরাও তাঁর জ্ঞানের গভীরতার বিষয়টি এবং তাঁর উন্নত আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বিষয়টি অস্বীকার করতেন না। একদিন আব্বাসীয় খলিফা মামুন ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করার জন্যে একটি মজলিসের আয়োজন করে। সেখানে তৎকালীন জ্ঞানী-গুণীজনদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঐ মজলিসে তৎকালীন নামকরা পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবনে আকসাম ইমামকে একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল এই: যে ব্যক্তি হজ্জ্ব পালনের জন্যে এহরাম বেঁধেছে,সে যদি কোনো প্রাণী শিকার করে,তাহলে এর কী বিধান হবে? ইমাম জাওয়াদ (আ) এই প্রশ্নটিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে মূল প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট ২২টি দিক তুলে ধরে উত্তরের উপসংহার টানেন। উত্তর দেওয়ার এরকম স্টাইল ছিল তাঁর জ্ঞানের বিস্ময়কর গভীরতার নিদর্শন। উত্তর পেয়ে উপস্থিত জ্ঞানীজনেরা ইমামের জ্ঞানের বিষয়টি কেবল স্বীকারই করলেন না বরং তাঁর জ্ঞানের প্রশংসাও করলেন।
২০৩ হিজরি থেকে ২২০ হিজরি পর্যন্ত মোট সতেরো বছরের ইমামতিকালে শাসক ছিলেন দুইজন আব্বাসীয় খলিফা। একজন হলেন মামুন আরেকজন মু'তাসিম। এরা আল্লাহর বিধি-নিষেধগুলোকে তেমন একটা মানতেন না এবং অনেক সময় ইসলামকে নিজেদের স্বার্থানুকূলে ব্যবহার করতেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) এসব দেখে চুপ করে থাকতে পারলেন না।তিনি সেসবের বিরোধিতা করলেন। সমাজে তাঁর এই বিরোধিতার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আব্বাসীয় খলিফারা ইমামকে হয়রানীর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে অবরোধ কঠোরতরো করে। ইমাম মামুনের পীড়াপীড়িতে মদিনা ছেড়ে আব্বাসীয় খিলাফতের তৎকালীন মূল কেন্দ্র বাগদাদে যেতে বাধ্য হন। তা সত্ত্বেও ইমাম জনগণের সাথে বিভিন্ন কৌশলে যোগাযোগ রক্ষা করে তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তো বটেই এমনকি স্বয়ং আব্বাসীয়দের হুকুমতের ভেতরেই আহলে বাইতের প্রতি বহু ভক্ত অনুরক্ত ছিল। ইমাম তাদেরকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে অনেক অবদান রেখেছিলেন।
জাওয়াদ শব্দের অর্থ হলো দয়ালু বা উদার। এই উপাধিটি থেকেই প্রমাণিত হয় যে ইমাম জাওয়াদ ছিলেন অসম্ভব উদার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর আসল নাম ছিল মুহাম্মাদ তাকি। তাঁর পিতা ইমাম রেযা (আ) জনগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার স্বার্থে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন,সেসবের মধ্যে একটি ছিল নিজের কাছে কিছু টাকা-পয়সা রাখা যাতে মানুষের প্রয়োজনে দান করতে পারেন। বাবার এই উপদেশ পালন করতে গিয়েই তিনি জাওয়াদ উপাধিতে ভূষিত হন। একবার একটি কাফেলা অনেক দূর থেকে ইমামের জন্যে বহু উপহার নিয়ে আসছিলো। পথিমধ্যে সেগুলো চুরি হয়ে গেল। কাফেলার পক্ষ থেকে ঘটনাটা ইমামকে লিখে জানানো হলো। ইমাম উত্তরে লিখলেন: আমাদের জান এবং মাল আল্লাহর দেওয়া আমানত। এসব থেকে যদি উপকৃত হওয়া যায় তো ভালো, আর যদি এগুলো হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত।কেননা তাতে সওয়াব রয়েছে। সঙ্কটে যে ভেঙ্গে পড়ে তার প্রতিফল বিফলে যায়।
ইমামের জীবনের শেষ দু'বছরে আব্বাসীয় শাসক ছিলো মুতাসিম। মুতাসিম জনগণের মাঝে ইমামের জনপ্রিয়তায় উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইমামের বক্তব্যে জনগণের মাঝে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুতাসিমের ভেতর ঈর্ষার আগুণ জ্বলতে থাকে। তাই ইমামের বিরুদ্ধে শুরু করে বিচিত্র ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইমাম শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে তাই আবারো আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক সমবেদনা। ইমামের একটি বাণী উচ্চারণ করে শেষ করবো আজকের আলোচনা।
"বাজে লোকের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো, কেননা তার বন্ধুত্ব হলো তলোয়ারের মতো, যার বাহ্যিক দিকটা বেশ চকচকে আর কাজটি খুবই জঘন্য।"

No comments:

Post a Comment