Wednesday, June 15, 2016

দ্বীন ই মোহাম্মদী ব্লগ → রাসুলের (সাঃ) ঘোষিত বার ইমাম কারা? আর পাকপঞ্চাতন বা কি?

বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

আমি চেষ্ঠা করছিআহলে বাইত সম্পর্কে যে সমস্ত বাংলায় লিখিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য আছে ,তা এক জায়গায় সন্নিবেশ করতে।
মাওলার চরণে,আমাদের এই খেদমতটুকু কবুল করুন।ভোগবাদী ইসলামের ভীড়ে মোহাম্মাদী(দঃ) এর ইসলাম ও মাওলায়েতের ইসলাম আমরা হারিয়ে বসেছি।আমার পাঠকগণ এই প্রবন্ধের মাধ্যমে ,তাদের বিবেক কে প্রশ্ন করে,সত্যের,সু পথের দিকে পরিচালিত হবে এই কামনা রইল-সংকলকের ভূমিকা
ইসলাম ধর্মে কিছু ঘটনা
রাসুলের (স.) তিরোধানের পর ইসলামের ইতিহাসে যে সমস্ত ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল এর মধ্যে থেকে কিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা-
সমস্ত সৃষ্টি জগত নূরে মোহাম্মদির বিকশিত রূপ। প্রভূর বাইরে কিছুই নেই। তিনিই সব কিছুর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছেন। আকারে নিরাকারে তিনিই বিরাজমান। ওয়াহেদাতুল অজুদ অর্থাৎ সবকিছু এক দেহের অন্তর্গত বা একাঙ্গীভূত বুঝায়। সবই তাঁর শরীর। আহাদসামাদ এবং লা-শারিক এই তিন স্তরে নিজেকে প্রলম্বিত করেছেন।
রাসূল (স.) বলেছেনআমি আল্লাহর নূর হইতেআমার নূর হইতে সমস্ত সৃষ্টি।
সমস্ত বিশ্বজগতের সৃষ্টির মূলেই রয়েছেন পাক পাঞ্চাতন। তরিকতি মুর্শিদ প্রেমিক সূফিবাদে বিশ্বাসী মানুষের মাঝেই কেবল পাক পাঞ্চাতন অবিস্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন। আমাদের দেশের মসজিদ মাদ্রাসা  কিংবা ওয়াজ মাহফিলে  পাক পাঞ্চাতন সম্পর্কে কোন ধারণা বা আলোচনা শুনা যায় না। পাক পাঞ্চাতন কি এই বিষয়টাও অধিকাংশ মুসলমানগণ অবগত নয়।
পাক পাঞ্চাতনে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন যাঁরা সারা সৃষ্টিজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তাঁদের নিয়েই সৃষ্টি। পাঁচজন সদস্য হলেন – ১. নবী করিম (স.)২. মাওলা আলী (আ.),  ৩. মা ফাতেমা (সালামাল্লাহে)৪. মাওলা হুসাইন (আ.)৫. মাওলা হাসান (আ.)। রাসূল (স.) পাক পাঞ্চাতনের চারজন সদস্যকে আহ্‌লে বাইত’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের উপর দরুদ পড়া এবং নিজের প্রাণের চেয়ে অধিকপ্রিয় মনের মধ্যে জায়গা না দিতে পারলে এবাদতের পরিপূর্ণতা আসেনা।
আল কোরানে বলা হয়েছে – “ উহাই সেই সুসংবাদ যাহা আল্লাহ তাঁহার বিশ্বাসকারী এবং সৎকর্মশীল দাসগণকে দিয়া থাকেন। বল: আমি ইহার উপরে (অর্থাৎ নবুয়তের কর্তব্য পালনের উপরে) নিকটবর্তীগণের মধ্যে মোয়াদ্দাত ব্যতীত অন্য কোন পারিশ্রমিক চাইনা। এবং যে একটি ভাল গুন অর্জন করে আমরা তাহার জন্য উহাতে ( অর্থাৎ ঐ গুনের মধ্যে) বৃদ্ধি করিয়া দেই একটি ভাল গুন। নিশ্চয় আল্লাহ হইলেন একজন ক্ষমাশীলকৃতজ্ঞ। (সূরা শুরা- আয়াত নং ২৩)।
যাহারা গুরুর শিষ্য হইয়া ইমানের কাজ করে এবং সৎ আমল করে উপরে উল্লেখিত আল্লাহর ফজল দানের সুসংবাদ তাহাদের জন্যই রহিয়াছে। এখানে রাসূলাল্লাহ (স.) বলিতেছেন- নবুয়তের কর্তব্য পালনের পরিবর্তে আমার নিকটবর্তীগনের মধ্যে তোমরা মোয়াদ্দাত কর। ইহাই আমি চাই। আমার নিকটবর্তীগণের মধ্যে মোয়াদ্দাত ব্যতীত অন্য কোন পারিশ্রমিক আমি চাই না। এই মোয়াদ্দাত’ এর পরিবর্তে মোয়াদ্দাতকারীর মধ্যে যে ব্যক্তি একটি ভাল গুন অর্জন করে আমরা তাহার জন্য উহাতে আরও বৃদ্ধি দান করি। কারণ আল্লাহ হইলেন ক্ষমাশীলকৃতজ্ঞ। আত্ম্নিক গুনরাজি বৃদ্ধি ব্যতীত তথা আল্লাহর গুনে গুনান্বিত করিয়া তোলা ব্যতীত অন্য কোন দানই শ্রেষ্ঠ নয় এবং এই রূপ দান আত্ম্নোৎসর্গের মাধ্যম ব্যতীত লাভ করা যায় না।
মোয়াদ্দাত’ অর্থ পরম ভালবাসা। ধর্মীয় পরিভাষা অনুযায়ী মোয়াদ্দাত এমন এক চরম ভালবাসাযে ভালবাসার কারণে প্রয়োজনার্থে প্রেমাষ্পদের জন্য জীবন উৎসর্গ করা অবশ্য কর্তব্য। না করিলে কাফের রূপে চিহিৃত হইতে হয়। অতএব এই ভালবাসা সম্পূর্ণ ঐশ্বরিক। আত্মীয়-স্বজন এবং পার্শ্ববর্তীদের প্রতি ভালবাসা এই পর্যায়ভুক্ত নয়। ইহাও লক্ষ্য করিবার বিষয় যেনিকটবর্তীদের জন্য প্রেম কর অর্থাৎ মোয়াদ্দাত কর  এই রূপ না বলিয়া নিকটবর্তীগনের মধ্যে প্রেম করিতে বলা হইয়াছে। আত্মোৎসর্গের এই প্রেম বাহির হইতে নিছক তাঁহাদের সাহায্যার্থে নয় বরং তাঁহাদের ভিতরে থাকিয়া তাঁহাদের মধ্যে ডুবিয়া যাইয়া তাঁহাদেরই অর্ন্তভুক্ত হইয়া যাওয়ার জন্য।
কুরবা’ অর্থ নিকটবর্তীজন। এইরূপ নিকটবর্তীজন কাহারা হাদিসে রাসুল (আ) অনুযায়ী রাসূল (আ) বংশের চরম ব্যক্তিগণ হইলেন নিকটবর্তীজন। ইহারা কাহার নিকটবর্তীশুধু রসূলের না আমাদেরও তাঁহারা উভয়দিকে নিকটবর্তী। গুনের দিক দিয়া রাসূলাল্লাহর (আ) নিকটবর্তী এবং আদর্শ মানব হিসাবে এবং আত্মিক নেতৃত্ব দানের বিষয়ে তাঁহারা নিঃসন্দেহে আমাদের অতি নিকটবর্তী। তাঁহারা জগতগুরু। পারত্রিক কল্যাণ সাধন বিষয়ে আমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পার্শ্ববতী লোকজন কেহই আমাদের সাহায্যার্থে আসিবার ক্ষমতা রাখে না। এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে তাঁহাদের।
এই বাক্য নাজেল হইলে মুসলমানগণ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন: “ কাহারা আপনার নিকটবর্তীজন যাঁহাদের  জন্য আমাদের ভালবাসা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করিয়াছেন ? ” নবী করিম জবাব দিলেন :“ ফাতেমা,আলী ,হাসান এবং হোসাইন ।
-  (ফখরুদ্দিন রাজি )
কোরান দর্শন ২য় খণ্ড
মাওলা সদর উদ্দিন আহমদ চিশ্‌তী
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন -“ আমি মহানবী (স) জিজ্ঞাসা করলাম যেআপনার যে সব আত্ম্নীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্য ওয়াজিবতাঁরা কারা মহানবী (স.) বললেন – তাঁরা হলেন আলী (আ.)মা ফাতেমা (সালামাল্লাহ),মাওলা হাসান (আ.)মাওলা হুসাইন (আ.)। – (ইহা  নবিউল মুয়াদ্দাহ পৃ: ৩১১)
হযরত সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “ তিনি বলেন এমতাবস্থায় রাসূল (স.) এর নিকট উপস্থিত হলাম যেযখন হোসাইন তাঁর উরুর উপর ছিল এবং তিনি তাঁর চোখ ও উষ্ঠতে চুম্বন দিচ্ছেন আর বলছেন যেতুমি সাইয়্যেদের সন্তান সাইয়্যেদ এবং তুমি ইমামের সন্তান ইমামতুমি ঐশী প্রতিনিধির সন্তান ঐশী প্রতিনিধি। আর তুমি নয় জন ঐশী প্রতিনিধির বাবাযাদের নবম ব্যক্তি হলেন কায়েম ( ইমাম মাহ্‌দী)। – হাদিস
হযরত জাবের (রা) হইতে বর্ণিত আছে যেবিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল পাক (দ.) ঘোষণা করিয়াছিলেন, “ইয়া আয়্যুহান্নাছু ইন্নি তারাকতু ফি কুম মা ইন্‌ আখাজতুম লান তাদেল্লু বায়দি আউয়ালুহা কেতাবাল্লাহে ওয়া এতরাতি আহলে বায়াতি।
অর্থাৎ, “ হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের নিকট যাহা রাখিয়া যাইতেছি তাহা যদি আঁকড়িয়ে থাক তবে পথভ্রষ্ট হইবে না। প্রথমটি আল্লাহর কেতাবদ্বিতীয়টি আমার আহলে বায়াত।
হযরত আনাস (রা.) হইতে বর্ণিত আছে রাসুল পাক (দ.) বলিয়াছেন, “ আ হেব্বুনী লে- হুব্বিল্লা ওয়া আহেব্বু আহলে বায়াতী লেহুব্বি।
অর্থাৎ,“ আমাকে ভালবাসিতে হইবে আল্লাহর ভালবাসা পাইবার জন্য এবং আহ্‌লে বাইতকে ভালবাসিতে হইবে আমার ভালবাসা পাইবার জন্য।” – (তিরমিজি)
হযরত ইবনে আববাস (রা) বলেন, “ মহানবী  (স) বলেছেনআমার আহলে বাইতের উদাহরণ হযরত নূহ (আ.) এর নৌকার মত। যারা নৌকায় আরোহন করলতারাই রক্ষা পেল। আর যারা তা করলনা তারাই সবাই ডুবে মরল।
তারীখুল খুলাফা
(জালালুদ্দিন আস সুয়ুতী পৃ: ৩০৭)
পাক পাঞ্চাতনের পাঁচজন সদস্যের মধ্যে চারজনকেই মর্মান্তিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধখ্রিস্টান,ইহুদিনাসারাজৈন প্রভৃতি ধর্মীয় জাতি হত্যাকাণ্ড ঘটান নাই। নবি করিম (স.) এর উম্মত নামে পরিচিত মুসলমান নামের মোনাফেকগণ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মুসলিম ইতিহাসের বিরাট অংশ জুড়ে এদেরই গুনকীর্তন রয়েছে। তাদের উত্তরসুরীরাই ধর্মীয় নেতাখলিফামসজিদের ইমামহাদিসের ইমাম সেজে ধর্ম দর্শন মানুষের জানা-বুঝার বাইরে নিয়ে গেছে। সত্য খুঁজে বের করা মানুষের জন্য এক মহা কঠিন ব্যাপার। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে গিয়ে শত মিথ্যা কথা চালানো হয়েছে।  আর এই সকল মিথ্যা হাদিসমিথ্যা ইতিহাস আহলে বাইতের নামের উপর চেপে দেয়া হয়েছে।
আহলে বাইতের সকল সদস্যকে যে ভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা নিম্নে দেয়া হল -
1.     হযরত মাওঁলা আলী (আ) : তাঁকে ৪০ হিজরী সনের ২১শে রমজান মসজিদে এবাদতে থাকা অবস্থায় ইবনে মুলজাম হত্যা করে।
হযরত মা ফাতেমা (সালামাল্লাহ) তিনি ঘরে থাকা অবস্থায়  ঘরের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল।ওমরের নেতৃত্বে খেলাফতের যুবদল মাওঁলা আলী (আ.) কে ধরে আনতে গিয়ে ঘরে আগুন লাগিয়েছিল । ঘরের মধ্যে মা ফাতেমামাওঁলা আলীমাওঁলা হাসান ও মাওঁলা হুসাইন ছাড়া অন্য কেহ ছিল না। এই ঘটনা ছিল আকস্মিক। দরজার আঘাতে মা ফাতেমার পাঁজর ও হাত ভেঙ্গে যায়। এতে এমন আঘাত লেগেছিল যে মা ফাতেমার গর্ভস্থ সন্তান মারা যায়। ফলে তিনি অল্পকাল অসুস্থ থেকে ১১ হিজরী সনের ১৪ জমাদিউল আউওয়াল শহীদ হন।
2.     হযরত হাসান (আ.) : তাঁকে মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে ২৮ সফর ৫০ হিজরী বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
3.     হযরত হুসাইন (আ) : পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই তাদের বছরের প্রথম দিন আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে পালন করেন। কিন্তু মুসলমানগণ আরবী বছরের প্রথম দিন থেকে দশম দিন পর্যন্ত শোক পালন করতে হয়। চোখে আনন্দের পরিবর্তে থাকে অশ্রু। কারণ ইসলামী বছরের ৬১ হিজরী সনের ১০  মহরম কারবালায় মর্মান্তিকভাবে তিনি শহীদ হন।
এজিদের নির্দেশে কারবালায় রাসুল (স) বংশধর মাওলা হুসাইন (আ.) সহ ৭২ জন সদস্যকে অবরোধ করে রাখে। খাদ্য এবং পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। এজিদের সেনাপতি যিয়াদের নেতৃত্বে ২২ হাজার সৈন্য মাওঁলা পরিবারকে ঘিরে রাখে। পানির অভাবে বাচ্চা শিশু পর্যন্ত অকাতরে জীবন দান করেন। শিশু আজগরকে পানির বদলে বুকে তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। মুসলমানরূপী মুনাফেকগণের কারবালায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ফলে মোহাম্মদী সূর্যের অস্তমিত করা হয়। মানবজাতি বঞ্চিত হয় এক মহাকল্যাণ থেকে। প্রতিষ্ঠিত হয় আরব্য সাম্রাজ্যবাদ। যাতে ইসলামের কিছুই রইল না।
উপরোক্ত পাক পাঞ্চাতনের চারজন সদস্য ছাড়াও নয়জন ইমাম রয়েছেন। নবী করিম (স.) তাঁদেরকে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইমামরূপে ঘোষণা করেছেন। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফারা বিভিন্নভাবে ইমামগণকে হত্যা করেছে। আর এই সমস্ত খলিফারাই মুসলমানদের ইসলামের নেতা এবং মসজিদের ইমাম ছিল। তাদের দ্বারাই  ধর্মীয় ইতিহাস,হাদিস সংগ্রহ এবং আলকোরানের রাজকীয় তফসির করা হয়েছে। যেহেতু তাদের  দ্বারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং মসজিদ পরিচালনা করা হত। ফলে অধিকাংশ মুসলমানগণই তাদের রচিত বিকৃত ইসলামকে প্রকৃত ইসলাম বলে গ্রহণ করেছে। আসলে এই সমস্ত খলিফাদের তৈরী বিকৃত ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে আল্লাহ রাসুল এবং ইমামগণের কোন সম্পর্ক নেই। কোন কালেই মহাপুরুষগণের কোন সম্পর্ক ছিলনা। মহান ইমামগণকে মুসলমানরূপী খলিফারা যেভাবে হত্যা করেছিল তা নিম্নে দেয়া হল -
4.     হযরত ইমাম যয়নুল আবেদ্বীন (আ.) উমাইয়া খেলাফতের  অত্যাচারী শাসক ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক। তার ষড়যন্ত্র ও নির্দেশে হিশাম বিন আবদুল মালিক ৯৫ হিজরীর ২৫ মহরম তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে।
৩৮ হিজরীর ঠিক এইদিনে অর্থাৎ ৫ই শাবানে তিনি পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রথম কান্নার ধ্বনি তুলেছিলেন।
ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) জন্মগ্রহণ করলেন যেন ফেৎনা-ফাসাদপূর্ণ অন্ধকার সময়ের মাঝে ইসলামের মুক্তির আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারেন,যে আলোর সাহায্যে তাঁর পিতা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর বৃহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিগুলো অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া যায়। ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) ঐশী আলো এবং পিতা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠে নিজেকে সর্বোচ্চ ফযীলতের ঐশ্বর্যে অলংকৃত করেন। তাঁর জীবনের ২৩ বছরের বেশি সময় না পেরুতেই পিতা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর জীবনে নেমে আসে কারবালার সেই ঐতিহাসিক বিপর্যয়কর ঘটনা। কিন্তু ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) অসুস্থতার কারণে কারবালার সেই মহাদুর্যোগপূর্ণ ঘটনায় অংশ নিতে পারেন নি। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে এই ব্যাপারটি আসলে আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছে অর্থাৎ ইমাম সাজ্জাদকে জীবিত রাখার স্বার্থে তাঁর অসুস্থতার ব্যাপারটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। কারণ আল্লাহ চেয়েছেন ইমাম হোসাইন (আঃ) এর শাহাদাতের পর তিনি যেন ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখেন।

ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর জীবনকাল কেটেছে এমন একটা সময়ে যখন আহলে বাইতের জন্যেই পরিস্থিতি ছিল খুবই কঠিন এবং প্রতিকূল। এ রকম এক সংবেদনশীল সময়ে উমাইয়া বংশীয় খলিফারা চেয়েছিল জনগণের কাছে নবীজীর আহলে বাইতের মর্যাদা হ্রাস করতে। সেই লক্ষ্যে তারা ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) সহ সমগ্র আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীদের ওপর কঠোরতা আরোপ করে। সেজন্যে ইমাম বাধ্য হয়েছিলেন শাসকদের প্রচারিত সকল বিভ্রান্তি থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে। তিনি প্রকৃত ইসলামের বার্তা জনগণের সামনে তুলে ধরে উমাইয়াদের বিকৃতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। ইমাম সাজ্জাদ অবশ্য পিতার শাহাদাতের পর কী বন্দীজীবন আর কী কারবালা বিপর্যয় পরবর্তীকাল-সবসময়ই তিনি অন্যায় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং সুকৌশলে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর কারবালা বিপ্লবের স্মৃতিকে জনগণের মাঝে জাগ্রত রাখার মহান কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন।ইমাম হোসাইন (আঃ) কেন কারবালায় শাহাদাতবরণ করলেন,কী ছিল তাঁর মিশন-সেইসব গূঢ়ার্থ এবং মূল্যবোধগুলো জনগণের সামনে ব্যঅখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন ইমাম সাজ্জাদ (আঃ)। সেইসাথে ইসলামের উচ্চতর স্বরূপ তুলে ধরা এবং সকল প্রকার বিচ্যুতি ও বেদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা জনগণের সামনে তুলে ধরা তাঁর একান্ত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সাজ্জাদ মানে হলো যিনি অনেক বেশি বেশি সিজদাহ করেন। এটা ছিল তাঁর অনেকগুলো উপাধির একটি। আল্লাহর ইবাদাতের ক্ষেত্রে ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং সদাসচেষ্ট। তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কাটতো আল্লাহর সাথে একান্তে এবং নিঃসঙ্গ মুহূর্তে আপন প্রয়োজনীতার কথা পেশ করার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন একজন প্রসিদ্ধ আবেদ ছিলেন হাসান বসরি। তিনি বলেছেন-একদিন আল্লাহর ঘরের পাশে ইবাদাত করছিলাম। দেখলাম আলী ইবনে হোসাইন অর্থাৎ ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল আছেন। তাঁর ইবাদাতের ভঙ্গি বা ধরন ছিল খুবই আকর্ষণীয়। তাঁর কথাবার্তা এতো বেশি মনোমুগ্ধকর ছিল যে,আনমনেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলাম।'

বর্ণিত আছে যেএকদিন উমাইয়া শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালেক আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে এসে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং মানুষের ব্যাপক ভিড় হবার কারণে তাওয়াফ করতে গিয়ে হাজ্বরে আসওয়াদ বা বিখ্যাত কালো পাথরটি ছুঁতে পারেন নি। তিনি মাসজিদুল হারামের এক কোণে একটি উঁচু আসনে বসলেন। ঠিক সে সময় ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করে তাওয়াফ শুরু করলেন। যখন তিনি হাজ্বরে আসওয়াদের কাছে পৌঁছলেন মানুষ তাঁর নূরানী চেহারা দেখে দেরি না করে রাস্তা ছেড়ে দিলেন যাতে ইমাম হাজ্বরে আসওয়াদ স্পর্শ করতে পারে। হিশাম ইবনে আব্দুল মালেকের সাথে সিরীয় এক সফরসঙ্গী ছিল,সে জিজ্ঞেস করলো-ঐ লোকটিকে যে সবাই এতো শ্রদ্ধা-সম্মান করে-কে সেইমাম সাজ্জাদ (আঃ) কে চিনে ফেলার ভয়ে হিশাম লোকটিকে মিথ্যা জবাব দিয়ে বললো-আমি তাকে চিনি না। বিখ্যাত আরব কবি ফারাযদাক সেখানে ছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন-আমি চিনি তাকে। তারপর একটা চমৎকার কবিতায় ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর পরিচয় তুলে ধরলেন। যার বক্তব্যটা ছিল এ রকমঃ

ইনি সেই ব্যক্তি মক্কার পথে-ঘাটে যাঁর পায়ের নিচের নুড়ি-পাথরও তাঁকে চেনে। তিনি অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের লোক। সহনশীলতা এবং মহত্ত্ব তাঁর চরিত্রের মহান দুটি অলংকার। কখনোই তিনি ওয়াদা খেলাফ করেন না।তাঁর অস্তিত্ব সবার জন্যেই পবিত্র ও কল্যাণময়। তাকওয়াবানদের যদি গুণতে হয় তাহলে তিনি হবেন সেই তালিকার শীর্ষস্থানীয়। যদি কেউ প্রশ্ন করে আল্লাহর যমিনে শ্রেষ্ঠ মানুষটি কেতাহলে তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া যায়। তাকে যদি না চেনো তাহলে আমি বলবো তিনি হলেন ফাতেমা (সা) এর সন্তান এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর প্রিয় উত্তরপুরুষ। 
যেমনটি সবাই জানেন যে দোয়া হচ্ছে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মাঝে সম্পর্ক সেতু নির্মাণের আধার। সেজন্যে ইসলামে এ সম্পর্কে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দোয়া মানুষের মনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। খোদার সাথে সম্পর্ক মানুষকে আত্মিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত করে। ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) ইসলামকে যেসব পন্থা ও কৌশলে জনগণের কাছে প্রচার করেছেন তার মধ্যে এই দোয়া এবং ইবাদাতের সংস্কৃতি ছিল অন্যতম একটি মাধ্যম। তিনি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বহু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চিত্ত্বাকর্ষক দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সেইসব দোয়া সহিফায়ে সাজ্জাদিয়া নামের একটি সংকলনে বিধৃত হয়েছে। ইসলামের বিধি-বিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্যে এই সংকলনটি জ্ঞানসিন্ধুর মতো। সুযোগ হলে গ্রন্থটি পাঠ করতে ভুলবেন না।

ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) ছিলেন অসম্ভব দয়ালু। জনগণকে সাহায্য-সহযোগিতা করার ব্যাপারে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে রাতে যাদের চোখে ঘুম আসতো নাতিনি তাঁর আত্মপরিচয় গোপন রেখে তাদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতেন।দিন পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমে আসলেই তিনি মদীনার অভাবগ্রস্তদের ঘরে ঘরে খাবার নিয়ে হাজির হতেন। তাঁর এই বদান্যতা ইতিহাসখ্যাত। ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর সমসাময়িক একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন যাহরি। তিনি বলেন,বৃষ্টিশীতল এক রাতে ইমাম সাজ্জাদ (আঃ)কে অন্ধকারে দেখতে পেলাম পিঠের পরে বস্তা নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। বললাম হে রাসূলে খোদার সন্তান! তোমার পিঠে এটা কিসের বোঝাতিনি বললেন সফরে বেরুতে চাচ্ছি তো তাই কিছু পাথেয় নিয়েছি। বললাম-আমার গোলাম তো এখানেই আছে,সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ইমাম বললেন- না,আমি নিজেই বোঝাটা বহন করতে চাই। যাহরি বলেন- এই ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেল কিন্তু ইমাম সফরে গেলেন না। ইমামের সাথে দেখা হলে বললাম- সফরে যে যেতে চাইলেন যান নিইমাম বললেন-হে যাহরি! সফর বলতে তুমি যা ভেবেছো আসলে এই সফর সেই সফর নয়। বরং আমি সফর বলতে আখেরাতের সফর বুঝিয়েছি। এই সফরের জন্যে প্রস্তুতি নাও। এই সফরের প্রস্তুতি হলো গুনাহ থেকে দূরে থাকা এবং সৎ কাজ করা। ততোক্ষণে যাহরি বুঝলো যে ইমামের উদ্দেশ্য কী ছিল এবং ইমাম ঐ যে বোঝাটি বহন করছিলেন,তা ছিল অভুক্তদের জন্যে খাবারের বোঝা।

পাঠক! মানুষের দু'ধরনের ক্ষুধা থাকে। একটি দৈহিক এবং অপরটি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক। দৈহিক ক্ষুধা মেটানোর জন্যে খাবার গ্রহণ করতে হয়। আর অন্তর বা আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মেটানোর জন্যে প্রয়োজন পড়ে ঈমান,জ্ঞান এবং মারেফাতের। এই ক্ষুধার চাহিদা মেটানোর খাদ্য হলো দোয়া এবং ইবাদাত। আমরা ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনকে ইবাদাতের সৌন্দর্য দিয়ে সাজাবার চেষ্টা করবো-এই হোক তাঁর পবিত্র জন্মদিনে আমাদের সবার আন্তরিক প্রত্যয়।

5.     হযরত বাকের (আ.) : অত্যাচারী শাসক আবদুল মালেকের শাসনামলে ১১৪ হিজরী সনের ৭ জিলহজ্ব তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
ইসলাম বিশ্ব-সভ্যতার পূর্ণতার নিয়ামক। আর ইসলামের পরিপূর্ণতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলেন বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.)। আর মহানবীর আহলে বাইতের ১২ সদস্যের প্রত্যেকেই হলেন হেদায়াতরূপ খোদায়ী নূরের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ও মানবীয় পরিপূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শের দিশারী তথা খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের সংরক্ষকক্রম-বিকাশক এবং পূর্ণতার মাধ্যম। তাই পয়লা রজব ইসলামের ইতিহাসের এক মহাখুশির দিন। কারণএই দিনে পবিত্র মদীনায় জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য তথা তাঁর নাতির নাতি হযরত ইমাম বাক্বির (আ.)। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর সাহাবি জাবের (রা.)-কে বলেছিলেন যে তুমি আমার বংশধর বাক্বিরকে দেখতে পাবে এবং তাঁর কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও। জাবের (রা.) সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নবীজীর আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) ১১৪ হিজরী সনের ৭ জিলহজ্ব ৫৭ বছর বয়সে শাহাদাতবরণ করেন। যেদিন তার শাহাদাতের খবর মদীনা শহরে ছড়িয়ে পড়লো সেদিন আহলে বাইতের অনুরাগীদের অন্তর শোকে-দুঃখে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিল। কারণ হলো তারা আর নবীজীর আহলে বাইতের ঐ নূরানী ও সদয় চেহারাটি আর দেখবে না,মসজিদে আর তাঁর হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ বক্তব্য শুনতে পাবে না-এই চিন্তায় তাদের মন ভেঙ্গে গেল। ইমামের অস্তিত্বহীনতা তাঁর ঘনিষ্ট সহচরদের জন্যে ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন জাবের ইবনে ইয়াযিদ জোফি। দুঃখের মুহূর্তগুলো যেন তার কাটছিল না। তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল ইমামের প্রিয় সান্নিধ্যের বহু অমর স্মৃতি। জাবের প্রথমবারের মতো যখন ইমামকে মসজিদে দেখেছিলেন তখন বহু কৌতূহলী মানুষ ইমামের চারদিকে বৃত্তাকারে বসে ছিলেন। সবাই তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাময় কথা শুনছিলো। প্রথম যেই উপদেশটি তিনি ইমামের কাছ থেকে শুনেছিলেন সেটা তিনি কখনোই ভোলেন নি,সবসময় তা তার স্মরণে ছিল।

ইমামের ঐ উপদেশ তাকে সবসময় জ্ঞান-অন্বেষী করে রেখেছিল। ইমাম বাকের (আ.) বলেছিলেনঃ 'জ্ঞান অন্বেষণ করো! কেননা জ্ঞান অন্বেষণ করা পূণ্যের কাজ। জ্ঞান তোমাকে অন্ধকারে পথ দেখাবেদুঃসময়ে জ্ঞান তোমাকে সাহায্য করবে। জ্ঞান হলো মানুষের সবচেয়ে উত্তম বন্ধু।এই উপদেশ পাবার কারণে জাবের ইমাম বাকের (আ.) এর যুক্তি বাহাসের জলসায় এবং যে-কোনো জ্ঞানের আসরে উপস্থিত থাকতেন। ইমামের প্রজ্ঞাময় বক্তৃতা থেকে ভীষণ উপকৃত হতেন। জাবের তাই ইমামকে হারাবার ব্যথায় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ইমামের স্মৃতিময় সান্নিধ্যের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন আর আনমনে ইমামের সেই বাণীটি আওড়ালেনঃ 'হে জাবের!যার অস্তিত্বে বা সত্ত্বায় আল্লাহর স্মরণের মাহাত্ম্য বিদ্যমান রয়েছে তার অন্তরে আর অন্য কোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসা জাগবে না। খোদাকে যারা অন্বেষন করে,যারা তাকেঁ পেতে চায় তারা দুনিয়া পুজারী হয় না,পার্থিব জগতের মোহ তাদের মাঝে থাকে না। তাই চেষ্টা করো আল্লাহ তাঁর হেকমাত ও দ্বীনের যা কিছু তোমার কাছে আমানত রেখেছেন তা রক্ষণাবেক্ষণ করো!'

জাবেরও ইমামের জন্যে শোকাভিভুত জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হলো। একদল লোক ইমামের পবিত্র লাশ কাধেঁ করে নিয়ে মদীনা শহরের বাকি কবরস্থানে নিয়ে গেল এবং তাকেঁ সেখানে দাফন করলো। এই দিনটিই সেইদিন অর্থাৎ ১১৪ হিজরীর জিলহজ্ব মাসের ৭ তারিখ। যেখানেই সত্য,ন্যায় ও বাস্তবতার নিদর্শন দেখা যাবে সেখানেই আহলে বাইতের নাম জ্বলজ্বল করবে। কেননা তাঁরা ছিলেন নীতিনৈতিকতার বিচারে সবোর্চ্চ পর্যায়ের। তাঁরা সবসময় অঙ্গনে এসেছেন সত্য-কল্যঅন ও মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছার পথ দেখাতে। মানুষের মাঝে তাদেঁর অস্তিত্বই ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল পথ প্রদর্শকের মতো।

ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতির মেয়াদকাল ছিল ১৯ বছর। হিজরী ৯৫ সালে তাঁর এই মেয়াদকালের সূচনা হয়। এই সময়টাতে ইসলামী সমাজ উমাইয়া শাসকদের শেষ দিককার এবং আব্বাসীয় শাসনের শুরুর দিককার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল। এই মেয়াদকালে বহু কিতাব এবং দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল। সেইসাথে কালের এই ক্রান্তিলগ্নে সমাজে বহুরকম বিকৃত ফের্কার বিস্তার ঘটেছিল। মানুষ তাই বিকৃত চিন্তার বেড়াজালে আটকে পড়ার সুযোগ ছিল খুব সহজেই। ইমাম বাকের (আ.) এবং তাঁর সন্তান ইমাম সাদেক (আ.) ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে দ্বীনের যথার্থ স্বরূপ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরার জোর প্রচেষ্টা চালান। তাদেঁর এই প্রচেষ্টা ছিল বেশ প্রভাব বিস্তারকারী। বিশেষ করে তাঁরা মদীনায় একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

জ্ঞানপিপাসু ও আধ্যাত্মিকতার আলো প্রত্যাশীরা দলে দলে তাই মদীনায় যেতে শুরু করেন। এভাবে দ্বীনের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। এ কারণেই তাকেঁ বাকেরুল উলুম নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ হলো পণ্ডিত বা জ্ঞানের বিশ্লেষক। ইমাম বাকের (আ.) তাঁর সময়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষার সীমান্তপ্রহরী ছিলেন। ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি ও নৈতিকতার বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিকৃত আকিদা ও চিন্তাচেতনার বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং ইসলামের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোর দৃঢ়তা ও মজবুতির ক্ষেত্রে ইমাম বাকের (আ.) মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন।

একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই যেসব শাসক অত্যাচারী এবং কেবল নিজেদের স্বার্থচিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং মানবীয় কোনো নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন নয় তারা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতিকালটি ছিল তেমনি এক শাসকগোষ্ঠির শাসনকাল। ইমাম তাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং একজন সৎ নেতৃত্বের গুণাবলি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। এভাবে অত্যাচারী খলিফাদের কাজকর্ম জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে।সে কারণে আব্বাসীয় শাসক বিশেষ করে হিশাম বিন আব্দুল মালেকের ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন ইমাম।

ইমাম বাকের (আ.) সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে বলেনঃ নিঃসন্দেহে যাদের মাঝে তিনটি গুণের সমাবেশ নেই তারা নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। ঐ তিনটি গুণ হলো-এ্যাকঃ আল্লাহকে ভয় করা এবং খোদার নাফরমানী থেকে নিরাপদ থাকাদুইঃ সহিষ্ণুতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা এবং তিনঃ অধীনস্থদের ব্যাপারে পিতৃসুলভ সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা।

ইমাম বাকের (আ.) ছিলেন পরোপকারী ও অসহায়-বঞ্চিত জনগোষ্ঠির প্রতি সদয়। তিনি নিঃস্ব-হতদরিদ্রদের সাথে মিশতেন। তাদের সাথে কথা বলে তাদের ক্লান্ত আত্মাকে প্রশান্ত করতেন। তিনি সবাইকে বলতেন বঞ্চিতদেরকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাকা না হয়। তাঁর জ্ঞান আর মিষ্টি আচার-আচরণের কারণে জনগণ তাঁর কথায় ব্যাপক আকৃষ্ট হত। বহু ছাত্র তিনি তৈরি করে গেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস এখনো মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগছে। হিশাম বিন আব্দুল মালেক ইমামের এই প্রভাব সঞ্য করতে পারলো না। সে ছিল অর্থলোভি এক পাথর-হৃদয়। সে তার অধীনস্থদের আদেশ দেয় বিভিন্নভাবে ইমামকে যেন চাপের মুখে রাখা হয়। কিন্তু কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করে ইমামকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। ইমামের বিরুদ্ধে তাই হিশামের অন্তরে ক্ষোভের আগুণ আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।

অবশেষে হিশাম ইমামের নূরানী অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলো। সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ইমাম বাকের (আ.) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাতের সেই শোকাবহ স্মৃতিময় দিনটিই হলো ৭ জিলহজ্ব। #
                                     

6.     হযরত জাফর সাদিক (আ.) আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুরঅত্যাচারী,   নিকৃষ্ট,প্রতিহিংসাপরায়ণ খলিফা ছিল মানছুর। মানছুর ইমামকে খুব কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছিল। তাঁর পিছনে গোয়েন্দা লাগানো হয়েছিল। ইমামের প্রতি জন সমর্থন মানছুরের হিংসার কারণ ছিল। অবশেষে ১৪৭ হিজরীর ৫ শাওয়াল বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে।
সঠিক ও অবিচ্যুত ইসলামকে যাঁরা সংরক্ষণ করেছেন নানা ভয়ানক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেযাঁরা ছিলেন প্রত্যেক যুগে ভুল পথে চলা মানুষের জন্য সত্য ও সঠিক পথের দিশারীযাঁরা তুলে ধরেছেন মানুষের মধ্যে প্রকৃত মানুষের স্বরূপযাঁরা ছিলেন জালিম ও ইসলামের তকমা ব্যবহারকারী শাসকদের মোকাবেলাসহ সবক্ষেত্রে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)র নিষ্কলুষ অনুসারী এবং যাঁদের উচ্চমানসম্পন্ন জ্ঞান ও ফজিলত ছিল মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় সৌভাগ্যের পথনির্দেশনা বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.) ছিলেন সেইসব মহামানবদের মধ্যে অন্যতম। ইসলামের মহাতরীর অন্যতম কর্ণধার এই মহাপুরুষের পবিত্র জন্ম বার্ষিকী তথা ১৭ ই রবিউল আউয়াল উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ এবং তাঁর প্রতি অশেষ সালাম ও দরুদ। উল্লেখ্যএই একই দিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'রও পবিত্র জন্ম বার্ষিকী। ( বিশ্বনবী-সা.'র জন্মদিন সম্পর্কে আমাদের ওয়েব সাইটের 'সমাজ-সংস্কৃতিঅংশের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) 

আজ এই মহাখুশির দিনে আমরা এই মহান ইমামের আলোকোজ্জ্বল আদর্শ ও অশেষ বরকতময় জীবনের কিছু দিকের কথা স্মরণ করব।

খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রূপকার ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। তিনি ৮৩ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদীনায় ভূমিষ্ঠ হন। বক্তব্যের সত্যতার কারণে তিনি "সাদিক" বা সত্যবাদী নামে খ্যাত হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা ( মহান আল্লাহ তাঁদের দান করুন অপার ও অসীম প্রশান্তি ) নিজেদের রক্ত দিয়ে নবী (সা.)র রেখে যাওয়া পথকে অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা কেবল বক্তব্য নয়বরং মূলত নিজেদের আমল ও আখলাকের মাধ্যমে কুরআন ও তৌহিদের শিক্ষাকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা ছিলেন ইতিহাস বিকৃতকারীদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষার সর্বোত্তম মাধ্যম। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুদের ও জাহিল ধর্মহীন শাসকদের নিক্ষিপ্ত প্রতিটি পাথরের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই মহান ইমামগণ যাতে ইসলামের কোনো বিপর্যয় বা ক্ষতি না হয়। তাঁর ইমামতের সময়কাল ছিল ১১৪ থেকে ১৪৮ হিজরি পর্যন্ত। এই ৩৪ বছরে মুসলিম জাহানের শাসকরা ছিল: বনি উমাইয়া থেকে হিশাম বিন আবদুল মালিকওয়ালিদ বিন ইয়াজিদ বিন আবদুল মালিক,ইয়াজিদ বিন ওয়ালিদইব্রাহিম বিন ওয়ালিদমারওয়ান হিমার এবং বনি-আব্বাস থেকে সাফফাহ ও মানসুর দাওয়াকিনি।

নবী বংশের যোগ্য উত্তরসূরি ও ইমামতের আকাশে অন্যতম প্রদীপ্ত সূর্য হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) খোদায়ী জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামকে এমন আলোকময় করেছেন ঠিক যেভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর প্রোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ববীরত্ব ও রক্ত দিয়ে ইসলামকে পবিত্র রেখেছিলেন। কেউ যদি মুহাম্মাদী ইসলামের বা প্রকৃত ইসলামের খাঁটি শিক্ষাগুলোর নির্মল ঝর্ণায় অবগাহন করতে চায় তাহলে হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র রেখে-যাওয়া ইসলামী শিক্ষার অমূল্য বিদ্যানিকেতনে তাকে প্রবেশ করতেই হবে। মুমিনদের ওপর তিনি ঠিক সেরকম অধিকার রাখেন যেমনিভাবে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)র জিহাদহযরত হাসান (আ.)র সন্ধি-চুক্তি,হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)র শাহাদতের রক্তখাতুনে জান্নাত মা ফাতিমা ও যেইনাব (সা.)র অশ্রুজল আমাদের ওপর অধিকার রাখে।

মহান ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষার দিগন্তকে এত উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকদের কোনো অপচেষ্টাই তাঁর প্রস্ফুটিত অন্তর্দৃষ্টির নূরের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র জ্ঞান বিষয়ক আন্দোলন এতটা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল যে কারাবালায় নবীবংশের ওপর জালিম শাসকচক্রের চরম দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এর প্রায় শত বর্ষ পর সেই একই বংশের তথা মহানবী(সা.)র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম আলী বিন মূসা রেজা (আ.) যখন ইরানের নিশাপুরে আসেন তখন সেখানে আহলে বাইতের প্রেমিক হাজার হাজার মানুষ নীরব অবস্থায় দাড়িয়ে ছিল তাঁর বক্তব্য শুনতে। ইতিহাসে এসেছে চব্বিশ হাজার মানুষ ইমামের কথাগুলো হাদীস হিসেবে লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল সেদিন

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) মুসলমানদের সব মাজহাবের কাছেই বরেণ্য ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাঁর আদর্শ হতে পারে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সূত্র। চারজন সুন্নি ইমামের মধ্যে একজন তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র এবং আরো দুই জন সুন্নি ইমাম তাঁর পরোক্ষ ছাত্র ছিলেন। উল্লেখ্য শিয়া মাযহাব ইমাম জাফর সাদেক (আ) এর জ্ঞান থেকে বিরতিহীনভাবে গ্রহণ করে হৃষ্টপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়েছেযে কারণে শিয়া মাযহাব 'জাফরি মাজহাবহিসেবেও খ্যাত। 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রথম ইমাম আবু হানিফা ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র কাছে দুই বছর শিক্ষা অর্জন করায় নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। তিনি এই দুই বছরকে ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার জ্ঞান অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু হানিফা বলেছেনযদি ওই দুই বছর না থাকত তবে নোমান তথা আবু হানিফা ধ্বংস হয়ে যেত।

তিনি আরো বলেছেন, “আমি জাফর ইবনে মুহাম্মাদের (তথা ইমাম জাফর আস সাদিক আ.) চেয়ে বড় কোনো ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তি দেখিনি। তিনি মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।” 

মালিকি মাজহাবের ইমাম মালেক বিন আনাস ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) সম্পর্কে বলেছেনআল্লাহর শপথ! মানুষের কোনো চোখ সংযম সাধনাজ্ঞানফজিলত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে জাফর ইবনে মুহাম্মাদের চেয়ে বড় কাউকে দেখেনিকোনো কান এসব ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় কারো কথা শুনেনি এবং কোনো হৃদয়ও তা কল্পনা করেনি। 

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) এমন এক যুগে জীবন যাপন করতেন যখন ইহুদিখ্রিস্টান ও গ্রীক পণ্ডিতরা সৃষ্টির উতসতৌহিদ বা একত্ববাদপরকাল ও নবুওতসহ মুসলমানদের মৌলিক ঈমান-আকিদাসহ প্রধান চিন্তাধারার মধ্যে নানা সন্দেহ বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। আর মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও ছিল নানা বিচ্যুত ধারা। এইসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সঠিক যুক্তি ও চিন্তাধারা তুলে ধরে ইসলামের সংরক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই মহান ইমাম। এ ছাড়াও মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া নানা কুসংস্কার ও কুপ্রথা উচ্ছেদের জন্য ইসলাম এবং কুরআন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)। 

উমাইয়া খেলাফতের শেষের দিকে ও আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে তারা উভয় পক্ষ একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল থাকায় ইমাম সাদিক (আ.)র হাতে ছিল মুক্ত সময়। এ সময় ইমামের জ্ঞান-আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করে এবং মদীনার আলেমরাসহ হাজার হাজার মানুষ নানা বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে থাকে। চার হাজার ছাত্র নানা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল এই মহান ইমামের কাছ থেকে। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী এবং রসায়নবিদ ও গণিতবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)রই ছাত্র। ইমামের জ্ঞান কেবল দ্বীনী বিষয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল না। তিনি রসায়নপদার্থজ্যোতির্বিদ্যাচিকিৎসা,পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়েও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কে মালেক বিন আনাস বলেছেনতিনি হয় সর্বদা রোজা রাখতেনঅথবা নামাজ পড়তেন অথবা আল্লাহর জিকির করতেন। প্রচুর হাদিস বলতেন ও বৈঠকের কর্ণধার ছিলেন। ইমামের সামনে বিশ্বনবী (সা.)র নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত। একবার তাঁর সঙ্গে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম। ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক শীর্ষক তালবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্ধত্য বলে মনে করছিলেন। 

নবী-রাসূলদেরকে যেমন অশেষ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়েতেমনি তাদের উত্তরসূরি মহান ইমামদেরকেও একই অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও ইসলামী ভূখণ্ডগুলোতে ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র ইমামতের প্রভাব ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল আব্বাসিয় জালিম শাসক মনসুর দাওয়ানিকি। দাওয়ানিকি বলেছিল: 

"জাফর ইবনে মুহাম্মাদ যদিও তরবারি দিয়ে সংগ্রাম করছে নাকিন্তু তার পদক্ষেপগুলো আমার কাছে একটি অভ্যুত্থানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন বলে মনে হয়।"

দাওয়ানিকির নির্দেশে (১৪৭ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল) বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয় ইসলামের এই চিরপ্রদীপ্ত সূর্য ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)কে। কিন্তু শাহাদাতের পর ইমামের নুরানি ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য বরং আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। ৬৫ বছর বয়স্ক ইমামের লাশ দাফন করার সময় ইমাম-প্রেমিক আবু হুরাইরা আজালি নিজেকে বলছিলেন: 

তুমি কি জান কোন মহামানবের লাশ নিয়ে যাচ্ছ মাটি দিতেতাঁর আগে ও পরে যদি ইমাম না থাকত তাহলে অবশ্যই বলতামকাল কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবী এমন মহামানব তৈরিতে অপারগ। 

ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)র কয়েকটি অমূল্য বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা:

যারা নামাজকে গুরুত্বহীন মনে করবে আমাদের তথা বিশ্বনবী (সা.)র আহলে বাইতের শাফায়াত তাদের ভাগ্যে জুটবে না।

ইমাম বলেছেনকোনো বান্দাই পরিপূর্ণভাবে প্রকৃত ঈমানে পৌঁছাতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে: পুরোপুরি ধর্মকে বুঝতে পারাসঠিক পদ্ধতিতে জীবন যাপন করা এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা।

তিনটি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এ তিন ক্ষেত্রে: রাগের মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয়যুদ্ধের সময় বীরত্বের পরিচয় ও অভাবের সময় ভাইয়ের পরিচয়।

7.     হযরত মুসা কাযিম (আ) : (আলেমে আলে মুহাম্মাদ’ বা বিশ্বনবী (সা.)র আহলে বাইতের আলেম) খলিফা হারুনের নির্দেশে ইমাম সাহেবকে ফাযল ইবনে রাবির কারাগারে রাখা হয়। অত:পর কিছুদিন পর ইয়াহিয়ার কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেখানে কিছুদিন কারারুদ্ধ থাকার পর সানদি ইবনে শাহাকের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এখানেই সানদি ইবনে শাহাক তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে। তিনি ১৮৩ হিজরীর ২৫ রজব শহীদ হন।
২৫ রজব ইসলামের ইতিহাসের গভীর শোকাবহ দিন। কারণ ১৮৩ হিজরির এই দিনে (খ্রিস্টিয় ৭৯৯ সনে) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও নিষ্পাপ ইমামকুলের সদস্যসৎকর্মশীলদের অন্যতম নেতা,নবী-রাসূলদের উত্তরসূরি ও পরিপূর্ণ মহামানব হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) শাহাদাত বরণ করেন।

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর শানে পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ এবং সবাইকে জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।

ইমাম মুসা ইবনে জাফর আল কাযিম (আ.)'র জন্ম নিয়েছিলেন ১২৮ হিজরির ৭ ই সফর তথা খ্রিস্টিয় ৭৪৫ সনের দশই নভেম্বর মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবওয়া’ এলাকায়। তাঁর পিতা ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.)আর মায়ের নাম ছিল হামিদাহ (সালামুল্লাহি আলাইহা)। রাগ দমনে এবং ধৈর্য ধারণের ক্ষেত্রে ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র অশেষ ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত হত তৎকালীন জালেম শাসকগোষ্ঠী। অশেষ ধৈর্যের জন্যই এই মহান ইমামকে বল হত কাযিম। তিনি ছিলেন পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পিতার মহত গুণগুলোর সবই অর্জন করেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)। তাঁর ৩৫ বছরের ইমামতির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে।
  
ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় শাসকদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং কারাদণ্ড ও নির্বাসন সত্ত্বেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এ আন্দোলনের যে বিশেষ ধারা তাঁর মহান পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শুরু করেছিলেন তা আরও বিকশিত হয়েছিল পুত্রের প্রজ্ঞাকৌশল ও ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ অধ্যবসায়ের সুবাদে। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের প্রকৃত তাফসির ও হাদীস বর্ণনা তাঁর মাধ্যমে আরও বিকশিত হয়। ইমাম তাঁর অনুসারীদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তিনি বলতেনজ্ঞান মৃত আত্মাকে জীবিত করে যেমনটি বৃষ্টি জীবিত করে মৃত ভূমিকে।

আব্বাসীয় শাসকদের বিভ্রান্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত চাল-চলন যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা পিতার মতই তা তুলে ধরেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.) । তাই ভীত-সন্ত্রস্ত আব্বাসীয় শাসকরা চাইতেন না জনগণের সঙ্গে ইমামের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাক। তারা জনগণের ওপর নবী বংশের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য যে কোনো ধরনের প্রতারণপ্রচারণাবর্বরতা ও নৃশংসতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করত না। এমনকি বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীদের ওপর জুলুম ও নৃশংস আচরণের ক্ষেত্রে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছিলযদিও তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন জন-সমর্থন পেয়েছিল এই প্রতিশ্রুতির কারণে যে ইসলামী খেলাফতে সমাসীন করা হবে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতকে। আব্বাসীয়রা ইমাম জাফর সাদিক ও ইমাম মুসা কাযিম (আ.) সহ নবী বংশের বেশ কয়েকজন ইমামকে শহীদ করেছিল।

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) তাঁর বন্দী অবস্থার কঠিনতম সময়েও বিচক্ষণতাবীরত্ব এবং সংগ্রামী ও আপোষহীন মনোভাব ত্যাগ করেননি। এদিকে হারুন এটা বুঝতে পেরেছিল যে ইমাম যখনই উপযুক্ত সুযোগ পাবেন তখনই স্বয়ং বিপ্লব করবেন কিংবা তাঁর সঙ্গীদেরকে আন্দোলনের নির্দেশ দেবেনফলে তার হুকুমতের পতন হবে অনিবার্য। তাই আপোষহীন এই ইমামের প্রাণনাশের সিদ্ধান্ত নেয়। 

ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বসরায় ঈসা ইবনে জাফর নামক এক জল্লাদের কারাগারে এক বছর বন্দী রাখা হয়। সেখানে ইমামের উত্তম চরিত্র জাফরের ওপর এমন প্রভাব রাখে যে ওই জল্লাদ হারুনের কাছে এক লিখিত বার্তায় জানিয়ে দেয় যে: তাঁকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নাওনতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দেব।

এরপর ইমাম কাযিম (আ.)-কে এক কারাগার থেকে বার বার অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এর কারণ ছিল এটা যে হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীকে নির্দেশ দিত ইমামকে গোপনে হত্যা করার। কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয়নি এ কাজ করতে। অবশেষে সানদি নামের এক ইহুদি ৫৫ বছর বয়স্ক ইমামকে বিষ প্রয়োগ করতে রাজি হয়। বিষ প্রয়োগের তিন দিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। 

হারুন ইমামকে শহীদ করার আগে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কারাগারে উপস্থিত করেছিল যাতে তারা সাক্ষ্য দেয় যে ইমাম কাযিম (আ.) স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন। কিন্তু ওই সাক্ষীরা যখন ইমামের দিকে তাকিয়েছিল তখন তিনি বিষের তীব্রতা ও বিপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও তাদেরকে বললেন: আমাকে নয়টি বিষযুক্ত খুরমা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছেআগামীকাল আমার শরীর সবুজ হয়ে যাবে এবং তার পরদিন আমি ইহজগৎ থেকে বিদায় নেব।

ইমাম মুসা কাযিম (আ.)র মহানুভবতানম্রতাসহিষ্ণুতা ও দানশীলতা ছিল শত্রুদের কাছেও সুবিদিত। তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞানবিস্তৃত চিন্তাশক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ দখল ফুটে উঠত। তিনি যে কোনো প্রশ্নের সঠিকপরিপূর্ণ এবং প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন। তাঁর প্রেমময় ইবাদত ছিল সাধকদের জন্য আদর্শ। 

মদীনার অধিবাসীরা ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন অর্থাৎ রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই মহান ইমাম এত সুন্দর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যেযে কেউ তা শুনে কেঁদে ফেলত।  

ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র মাধ্যমে অনেক মু'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমনএকবার এক বিধবা মারা গেলে তার শিশুরা যখন কাঁদতে থাকে তখন এই মহান ইমাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনার মাধ্যম ওই বিধবাকে জীবিত করেন।

ইমামের কারারক্ষী মুসাইব বলেছে: 

শাহাদতের তিন দিন আগে ইমাম আমাকে ডাকিয়ে এনে বলেন: আমি আজ রাতে মদীনা যাব যাতে আমার পুত্র আলীর ( ইমাম আলী ইবনে মুসা রেজা-আ.) কাছে ইমামতের দায়িত্ব দিয়ে যেতে পারি। 

আমি বললাম: এতসব প্রহরী বা কারারক্ষীতালা ও শেকল (যা দিয়ে ইমামকে বেঁধে রাখা হয়েছিল) থাকার পরও কি আপনি আশা করেন যে এখান থেকে আপনাকে বের হতে দেয়ার সুযোগ করে দেব!!!ইমাম বললেন: হে মুসাইবতুমি কি মনে কর আমাদের ঐশী বা খোদায়ী শক্তি কমআমি ঠিক সেই ইসমে আযমে ইলাহি’ দিয়ে- যা দিয়ে আসফ বিন বারখিয়া (হযরত সুলায়মান-আর মন্ত্রী) বিলকিসের (সাবার রানী) প্রাসাদকে চোখের এক পলক ফেলার সময়ের মধ্যেই ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিনে নিয়ে এসেছিল- আল্লাহকে ডাকব ও মদীনায় যাব। হঠাৎ দেখলাম যে ইমাম একটি দোয়া পড়লেন ও অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন এবং নিজের হাতেই কারাগারের শেকলগুলো দিয়ে নিজের পা মুবারক বাঁধলেন। এরপর ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বললেন: আমি তিন দিন পর দুনিয়া থেকে বিদায় (শহীদ) হব। শুনে আমি কাঁদতে লাগলাম। ইমাম বললেন: কেঁদো নাজেনে রাখআমার পর আমার ছেলে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) তোমাদের ইমাম বা নেতা।

ইমাম মুসা কাযিম (আ.)র বরকতময় একটি বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের এই আলোচনা। 
খোদা পরিচিতির পরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থা হল নামাজ, / বাবা মায়ের প্রতি সদাচরণ /এবং হিংসা,স্বেচ্ছাচার,অহংকার ও দাম্ভিকতা পরিহার করা। #

8.     হযরত ইমাম রেজা (আ) আব্বাসীয় খলিফা মামুনের রাজত্ব কালে ইমামের জনসমর্থনমান-সম্মান বৃদ্ধি পায়। এতে মামুন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। দলে দলে জনগণ ইমাম সাহেবের নিকট আশ্রয় নিতে থাকে। খলিফা মামুন ভয়ে ভীতু হয়ে পড়ে। অবশেষে ইমামকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। কারণ মামুন উপলদ্ধি করে তিনি থাকলে তার খলিফা হিসেবে জনসমর্থন আদায় এবং নেতা হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই ২০৩ হিজরীর সফর মাসের শেষ দিনে তাঁকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যামে হত্যা করা হয়।
১১ ই জিলকাদ ইসলামের ইতিহাসের এক মহা-খুশির দিন। কারণ১৪৮ হিজরির এই দিনে  মদিনায় ইমাম মুসা ইবনে জাফর সাদিক (আ.)'র ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)।

 তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময়ী মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন নাজমা। ১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)। এই মহান

ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে ইমাম রেজা (আ.)'র জন্মদিনের তাবাররুক হিসেবে তাঁর জীবনের প্রধান কিছু ঘটনা ও প্রকৃত ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর অমর অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করব আজকের এই বিশেষ আলোচনায়।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত তথা মাসুম বংশধররা ছিলেন খোদায়ী নানা গুণ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ। তাঁরা ছিলেন মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ আদর্শ। তাঁদের মহত গুণ ও যোগ্যতাগুলো সত্য-সন্ধানী এবং খোদা-প্রেমিকদের জন্য অফুরন্ত শিক্ষা ও প্রেরণার উতস হয়ে আছে।

শেখ সাদুক ইমাম রেজা (আ.) সম্পর্কে এক বইয়ে লিখেছেন,  অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্টসাদিক বা সত্যবাদীফাজেল বা গুণধরমু'মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো ও কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উতস প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

তবে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.)'র একটি বড় উপাধি হল 'আলেমে আ'লে মুহাম্মাদবা মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের আলেম।

ইমাম রেজা (আ.)'র পিতা ইমাম মুসা কাজিম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যেতিনি বলেছেনআমার বাবা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাকে বার বার বলতেন যেআলে মুহাম্মাদের আলেম বা জ্ঞানী হবে তোমার বংশধর। আহা! আমি যদি তাঁকে দেখতে পেতাম!তাঁর নামও হবে আমিরুল মু'মিনিন (আ.)'র নাম তথা আলী

প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াতনামক বইয়ে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছেযারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। [এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.র ছোট বোন।  মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি।]

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারা বা আহলে বাইতের একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।

নবীবংশের প্রত্যেক ইমামের জীবনই যেন মহাসাগরের মতই মহত গুণজ্ঞানআর কল্যাণের নানা ঐশ্বর্যে কুল-কিনারাহীন এবং  শাহাদাতের স্বর্গীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ভাষ্য অনুযায়ী ইমামদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। ইসলামের মধ্যে নানা বিকৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ।

হিজরি প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইসলামি খেলাফত যখন সুস্পষ্টভাবেই রাজতন্ত্রের রূপ নেয় এবং ইসলামী নেতৃত্ব জোর- জুলুমপূর্ণ বাদশাহিতে রূপান্তরিত হয়তখন থেকেই আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণ সময়োপযোগী পদ্ধতিতে বিদ্যমান সকল অব্যবস্থা বা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাঁদের রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকেন। তাঁদের এইসব রাজনীতির বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং ইমামতের ভিত্তিতে হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা।

কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের সব ধরনের চরম অত্যাচার-নিপীড়নের মুখেও তাঁরা তাঁদের এই ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁদের শাহাদাতের পবিত্র রক্ত থেকে জন্ম দিয়েছে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের লক্ষ-কোটি অনুসারী। শাহাদতের  বেহেশতি গুল বাগিচার পথ ধরে ইমামতের সেই ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে এবং তাঁদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরিগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজো তৎপর রয়েছে। ইমামতের নুরানি জ্যোতিতে অলোকময় পৃথিবী তাঁদের নির্ভুল দিক-নির্দেশনায় খুঁজে পাচ্ছে প্রকৃত ইসলামের সঠিক দিশা। ইমামের পবিত্র জন্মবার্ষিকী তাই গোটা মুসলিম উম্মাহর মুক্তির স্মারক।

ইমাম রেজা (আ.)'র  ইমামতির সময়কাল ছিল বিশ বছর। এই বিশ বছরে আব্বাসীয় তিনজন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন ও মামুনের শাসনকাল অতিক্রান্ত হয়েছিল। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাজিম ( আ. )র নীতি-আদর্শকে অব্যাহত গতি দান করেন। ফলে ইমাম মূসা কাজিম (আ.)র শাহাদাতের পেছনে যেই কারণগুলো দেখা দিয়েছিলস্বাভাবিকভাবেই ইমাম রেজা (আ.)ও সেই কারণগুলোর মুখোমুখি হন। অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদি মহলের নেপথ্য রোষের মুখে পড়েন তিনি। আব্বাসীয় রাজবংশে বাদশা হারূন এবং মামুনই ছিল সবচে পরাক্রমশালী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তারা প্রকাশ্যে ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বলে বেড়াতেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইমামদের রক্তের তৃষ্ণায় তৃষিত ছিলেন।

ইমামদের প্রতি তাঁদের এ ধরনের আচরণের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। একআহলে বাইত প্রেমিক বা নবীবংশ প্রেমিকদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়াএবং দুই শিয়া মুসলমানদের মন জয় করা। ইমামদের সাথে সম্পর্ক থাকার প্রমাণ থাকলে  জনগণের কাছে তাদের শাসনও বৈধ বলে গৃহীত হবে-এ ধরনের চিন্তাও ছিল তাদের মনে। কারণ,মুসলমানরা যদি দেখে যে,  বিশ্বনবী (সা.)র নিষ্পাপ বংশধরগণ তথা হযরত আলীর (আ) পরিবারবর্গের প্রতি বাদশাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছেতাহলে তারা আব্বাসীয়দের শাসনকে বৈধ মনে করে খুশি হবে ফলে তারা আর বিরোধিতা করবে না। এরফলে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে।

ইমাম রেজা (আ.) শাসকদের এই দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতি বুঝতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁর কৌশলটি ছিল এমনযার ফলে একদিকে বাদশা মামুনের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের জনগণও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারে। আর সেই সত্য হলো এই যেআল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবলমাত্র নবী পরিবারের নিষ্পাপ বা পবিত্র ইমামগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাঁরা ছাড়া কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়। জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাদশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে-এই আশঙ্কায় ধূর্ত মামুন ইমাম রেজাকে (আ) সবসময়ই জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। শুধু ইমাম রেজা (আ.) নন প্রায় সকল ইমামকেই এভাবে গণ-বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা তাঁদেরকে গৃহবন্দী করাসহ কঠোর প্রহরার মধ্যে রাখার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারপরও নিষ্পাপ ইমামদের সুকৌশলের কারণে তাঁদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়।

আর জনগণের কাছে মহান ইমামগণের বার্তা পৌঁছে যাবার ফলে জনগণ প্রকৃত সত্য বুঝতে পারেএবং নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। বিশেষ করে বাদশাহ মামুনের অপততপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেজা (আ.) যখন দাঁড়িয়ে গেলেনতখন ইরাকের অধিকাংশ জনগণ মামুনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। হযরত আলী(আ.)র  পবিত্র খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহি যে হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। যার ফলে মামুন একটা আপোষ-নীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হন নিকিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে । বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন। উল্লেখ্য যেনবীবংশের মধ্যে ইমাম রেজা(আ.)ই প্রথম ইরান সফর করেন। যাই হোকযাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। ইমামও নবী করিম (সা.)তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান।

চতুর বাদশাহ মামুন ইমামের আগমনে তার সকল সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেনহে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি আলী বিন মূসা বিন রেজার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো। ইমামমামুনের রাজনৈতিক এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেনমহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেনতাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাকতাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করে। ইমাম রেজা (আ.) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন।

শর্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছিল এরকম-একতিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। দূরে থেকে তিনি খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মোনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন - হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল ( আ ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়া আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারিতোমার নবীর সুন্নতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি।

 ইমাম রেজা র এই দায়িত্ব গ্রহণের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভেবেছিলখেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার আসল উদ্দেশ্যের কথা তাদেরকে খুলে বলে। তা থেকেই বোঝা যায়যেমনটি আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেনইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিলশিয়াদের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। যাতে তাদের উত্তাল রাজনীতিতে ভাটা পড়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়তইমামকে উত্তরাধিকার বানানোর মাধ্যমে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মহান উদার হিসেবে প্রমাণ করা।

 তো মামুনের এই অশুভ উদ্দেশ্যের কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপদস্থ করতে পারে নি। যেমন,বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করার চেষ্টাকিংবা ক্ষরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টি বর্ষণের জন্য ইমামকে দিয়ে এই আশায় দোয়া করানো যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু ইমাম প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল।

 বাদশাহ মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রেক্ষাপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশা ভীষণ ক্ষেপে যান এবং ইমামের বিরুদ্ধে অন্তরে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকেন। এইভাবে   ইমামতজনপ্রিয়তাখেলাফতআলীর বংশধর প্রভৃতি বিচিত্র কারণে বাদশাহ ইমামের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে থাকে। অন্যদিকে জনগণ বুঝতে পারে যেখেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি উপযুক্ত। ফলে ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা বাড়তেই থাকে।

আর ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে পরাস্ত করা গেল নাতখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে ডালিমের রস বা আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়-জ্বালা মেটাবার উদ্যোগ নেয়। ২০৩ হিজরির ১৭ই সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে যেন অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের জন্মদিনে কাতারে কাতারে মানুষ আসে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সোনালি রঙ্গের সমাধি-ভবনের চারপাশ জাঁকজমক আর অপূর্ব ঐশ্বর্যে কোলাহল-মুখর হয়ে ওঠে নিমেষেই। যুগ যুগ ধরে মানুষের নেক-বাসনা পূরণের উসিলা হিসেবে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি রয়েছে নবীবংশের ইমামগণের। ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর পবিত্র মাজারও এর ব্যতিক্রম নয়।

কেনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইমামের মাযারে এসে ভিড় জমানএ সম্পর্কে যিয়ারতকারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁদের আবেগ-অনুভূতি জানিয়েছেন। একজন বলেছেনআমি যখনই বা যেখানেই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইতখনই ইমাম রেজা (আ.)র  মাজারে চলে আসি। এখানে এসে আল্লাহর দরবারে সমস্যার সমাধান চেয়ে দোয়া করি। আমি বহুবার লক্ষ্য করেছি ধর্মীয় এবং পবিত্র স্থানসমূহ বিশেষ করে ইমাম রেজা (আ.)র পবিত্র মাযারে এলে মনোবেদনা ও সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং এক ধরনের মানসিক প্রশান্তিতে অন্তর ভরে যায়। মনের ভেতর নবীন আশার আলো জেগে ওঠে। এভাবে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিক প্রশান্তির কথা বলেছেন। জীবিতাবস্থায় যিনি মানুষের কল্যাণে ছিলেন আত্মনিবেদিতশহীদ হয়েও তিনি যে অমরত্মের আধ্যাত্মিক শক্তিবলে একইভাবে মানব-কল্যাণ করে যাবেন-তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে!

ইমাম রেজা (আ.)'র যুগে মুসলমানরা গ্রিক দর্শনসহ ইসলাম-বিরোধী নানা মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এ সময় মুসলমানদের শাসক ছিলেন আব্বাসিয় খলিফা মামুন। সে ছিল আব্বাসিয় শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে ধূর্ত ও জ্ঞানী। সমসাময়িক নানা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। আমরা আগেই বলেছি মামুন ইমাম রেজা (আ.)-কে ইরানের মার্ভ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন। মার্ভ শহর ছিল মামুনের রাজধানী। সে এই মহান ইমামের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে জ্ঞানের নানা বিষয়ে অনেক বৈঠক করতেন। বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতদের দিয়ে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করাই ছিল এইসব বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) নানা ধরনের কঠিন প্রশ্ন ও জটিল বিতর্কের এইসব আসরে বিজয়ী হতেন এবং বিতর্ক শেষে ওইসব পণ্ডিত ও জ্ঞানীরা ইমামের শ্রেষ্ঠত্বও অকাট্য যুক্তির কথা স্বীকার করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।

খলিফা মামুন হযরত ইয়াহিয়া (আ.)'র অনুসারী হওয়ার দাবিদার তথা সাবেয়ি ধর্মের এক  বিখ্যাত পণ্ডিতকে একবার নিয়ে আসেন এ ধরনের এক বিতর্কের আসরে। সেখানে ইহুদিখ্রিস্টান ও অগ্নি-উপাসকদের পণ্ডিতরাও উপস্থিতি ছিল। এই আসরে ইমাম রেজা (আ.) ইসলামের বিরোধিতা সম্পর্কে কারো কোনো বক্তব্যযুক্তি বা প্রশ্ন থাকলে তা তুলে ধরার আহ্বান জানান এবং তিনি এর জবাব দেবেন বলে ঘোষণা করেন। ইমরান নামের ওই সাবেয়ি পণ্ডিত অবজ্ঞাভরে বলল: "তুমি যদি না চাইতে তবে তোমার কাছে আমি প্রশ্ন করতাম না। আমি কুফাবসরাসিরিয়া ও আরব দেশে গিয়েছি এবং তাদের সব দার্শনিক বা যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বিতর্ক করেছি। কিন্তু তাদের কেউই প্রমাণ করতে পারেনি যে আল্লাহ এক ও তিনি ছাড়া অন্য কোনো খোদা নেই এবং তিনি এই একত্বের মধ্যে বহাল রয়েছেন। এ অবস্থায় আমি কি তোমার কাছে প্রশ্ন করতে পারিইমাম রেজা (আ.) বললেনযত খুশি প্রশ্ন করতে পার। ফলে সে ইমামকে বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু প্রশ্ন করে। ইমাম রেজা (আ.)ও বহু সংখ্যক পণ্ডিত ও বিপুল দর্শকদের উপস্থিতিতে একে-একে ইমরানের সব প্রশ্নের এত সুন্দর জবাব দিলেন যে ওই সাবেয়ি পণ্ডিত সেখানেই মুসলমান হয়ে যান।

ইমাম রেজা (আ.) বিতর্কে অংশগ্রহণকারী পণ্ডিতদের ধর্ম-বিশ্বাস ও মতবাদে উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকেই তাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। একবার খলিফা মামুন বিখ্যাত খ্রিস্টান পণ্ডিত জাসলিককে বললেন ইমাম রেজা (আ.)র সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে। জাসলিক বললেনআমি কিভাবে তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হব যখন তাঁর ধর্মগ্রন্থ তথা কুরআন ও এর দলিল-প্রমাণের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই এবং তিনি যেই নবীর বক্তব্যকে দলিল-প্রমাণ হিসেবে পেশ করবেন তাঁর প্রতিও আমার ঈমান নেই। ইমাম রেজা (আ.) বললেনযদি ইঞ্জিল তথা বাইবেল থেকে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরি তাহলে কি আপনি তা গ্রহণ করবেনজাসলিক বললেনহ্যাঁ। আসলে ইমাম উভয়-পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে জাসলিকের সঙ্গে বিতর্ক করলেন। বিতর্কে জাসলিক এতটা প্রভাবিত হলেন যে তিনি বললেন: খ্রিস্ট বা ঈসার কসমআমি কখনও ভাবিনি যে মুসলমানদের মধ্যে আপনার মত কেউ থাকতে পারেন।

ইমাম রেজা (আ.)ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত-এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যেমুসা (আ.)র নবী হওয়ার দলিল বা প্রমাণ কীরাস উল জালুত বললেন,
তিনি এমন মুজিজা বা অলৌকিক নিদর্শন এনেছেন যে তাঁর আগে আর কেউই তেমনটি আনতে পারেনি। ইমাম প্রশ্ন করলেন: কেমন সেই মোজেজাজালুত বললেন: যেমনসাগরকে দুই ভাগকরে মাঝখানে পথ সৃষ্টি করাহাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করাপাথরে ওই লাঠি দিয়ে আঘাত করে কয়েকটি ঝর্ণা বইয়ে দেয়াহাত সাদা করা এবং এ রকম আরো অনেক মুজিজাবা অলৌকিক নিদর্শনআর অন্যরা এর মোকাবেলায় কিছু করতে পারত না ও এখনও তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা কারো নেই।

জবাবে ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  এটা ঠিকই বলেছেন যেহযরত মুসা (আ.)র আহ্বানের সত্যতার প্রমাণ হলতিনি এমন কিছু কাজ করেছেন যা অন্যরা করতে পারেনিতাই কেউ যদি নবুওতের দাবিদার হনও এমন কিছু কাজ করেন যা অন্যরা করতে পারেন নাএ অবস্থায় তাঁর দাবিকে মেনে নেয়া কি আপনার জন্য ওয়াজিব বা অপরিহার্য নয়?

ইহুদি আলেম বললেন: নাকারণ আল্লাহর কাছে উচ্চ অবস্থান ও নৈকট্যের দিক থেকে কেউই মুসা নবীর সমকক্ষ নয়। তাই কেউ যদি মুসা নবীর মত মুজিজা বা অলৌকিক নিদর্শন দেখাতে না পারেন তাহলে তাকে নবী হিসেবে মেনে নেয়া আমাদের তথা ইহুদিদের জন্য ওয়াজিব নয়।

ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  তাহলে মুসা নবী (আ.)র আগে যে নবী-রাসূলবৃন্দ এসেছেন তাঁদের প্রতি কিভাবে ঈমান রাখছেনতাঁরা তো মুসা (আ.)র অনুরূপ মুজিজা আনেননি। 

রাস উল জালুত  এবার বললেনওই নবী-রাসূলবৃন্দ যদি তাঁদের নবুওতের সপক্ষে মুসা নবীর মুজেজার চেয়ে ভিন্ন ধরনের মুজিজা দেখাতে পারেন তাহলে তাদের নবুওতকে স্বীকৃতি দেয়ায়ও ওয়াজিব বা জরুরি।

ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  তাহলে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)র প্রতি কেন ঈমান আনছেন নাঅথচ তিনি তো মৃতকে জীবিত করতে পারতেনঅন্ধকে দৃষ্টি দান করতেনচর্ম রোগ সারিয়ে দিতেনকাদা দিয়ে পাখি বানিয়ে তাতে ফু দিয়ে জীবন্ত পাখিতে পরিণত করতেন। 

রাস উল জালুত এবার বললেনতিনি এইসব কাজ করতেন বলে বলা হয়ে থাকেতবে আমরা তো দেখিনি।
ইমাম রেজা (আ.) বললেনআপনারা কি মুসা নবী (আ.)রমুজিজা দেখেছেনএইসব মুজিজার খবর কি আপনাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে পৌঁছেনি?
-   জি হ্যাঁঠিক তাই। বললেন রাস উল জালুত
-   ইমাম রেজা (আ.) বললেন, "ভালো কথাতাহলে ঈসা (আ.)র মুজিজাগুলোর  নির্ভরযোগ্য খবরও তো আপনাদের কাছে বলা হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় আপনারা মুসা নবী (আ.)-কে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলেও  ঈসা (আ.)র প্রতি ঈমান আনছেন না। "তিনি আরো বললেন, "বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)র নবুওতসহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের নবী (সা.)র অন্যতম মুজিজা হল এটা যে তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র ইয়াতিম ও রাখালের কাজ করে পারিশ্রমিক নিতেন। তিনি কোনো পড়াশুনা করেননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছেও আসা-যাওয়া করেননি। কিন্তু তারপরও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবী-রাসূলদের কাহিনী ও ঘটনাগুলোর হুবহু বিবরণ। এতে রয়েছে অতীতের লোকদের খবর এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুদূর ভবিষ্যতের খবর। এ বই  অনেক নিদর্শন ও  অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরেছে।"

এভাবে রাস উল জালুতের সঙ্গে ইমাম রেজা (আ.)র আলোচনা চলতে থাকে। সংলাপ এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত ইমাম রেজা (আ.)-কে বললেন: 
"আল্লাহর কসম! হে মুহাম্মদের সন্তান (বংশধর)! ইহুদি জাতির ওপর আমার নেতৃত্বের পথে যদি বাধা হয়ে না দাঁড়াত তাহলে আপনার নির্দেশই মান্য করতাম। সেই খোদার কসম দিয়ে বলছিযে খোদা মুসার ওপর নাজেল করেছেন তাওরাত ও দাউদের ওপর নাজেল করেছি যাবুর। এমন কাউকে দেখিনি যিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল আপনার চেয়ে ভালো তিলাওয়াত করেন এবং আপনার চেয়ে ভালোভাবে ও মধুরভাবে এইসব ধর্মগ্রন্থের তাফসির করেন।"

এভাবে ইমাম রেজা (আ.) তাঁর অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে সবার জন্য সর্বোত্তম ও বোধগম্যভাবে ইসলামের বিশ্বাসগুলো তুলে ধরেছিলেন। আর তিনি এত গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী এবং সেসবের প্রচারক ও বিকাশক ছিলেন বলেই  তাঁকে আলেমে আলে মুহাম্মাদ’ বা বিশ্বনবী (সা.)র আহলে বাইতের আলেম শীর্ষক উপাধি দেয়া হয়েছিল।

এই মহাপুরুষের কয়েকটি বাণী শুনিয়ে ও সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করব তাঁর জন্মদিনের আলোচনা। ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,

১."জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত সম্পদের মত যার চাবি হলপ্রশ্ন। আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোককারণ প্রশ্নের মাধ্যমে চার গ্রুপ তথা প্রশ্নকারীশিক্ষার্থীশ্রবণকারী ও প্রশ্নের উত্তর-দাতা সবাই-ই সাওয়াব বা পুরস্কার লাভ করেন।"
২।মুমিন ক্রোধান্বিত হলেওক্রোধ তাকে অপরের অধিকার সংরক্ষণ থেকে বিরত করে না।
৩। কিয়ামতে সেই ব্যক্তি আমাদের সর্বাধিক নিকটবর্তী হবেযে সদাচরণ করে এবং তার পরিবারের সাথে সদ্ব্যবহার করে।
৪। যদি কেউ কোন মুসলমানকে প্রতারণা করেতবে সে আমাদের কেউ নয়।
৫। তিনটি কাজ সবচেয়ে কঠিন :
এক. ন্যায়-পরায়নতা ও সত্যবাদিতা যদিও এর ফল নিজের বিরুদ্ধে যেয়ে থাকে। দুই. সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে থাকা।
তিন. ঈমানদার ভাইকে নিজ সম্পদের অংশীদার করা।

9.     হযরত ইমাম মুহাম্মদ ত্বাফী (আ) : আব্বাসীয় খলিফাদের সবাই ইমামগণের কর্মকাণ্ডের প্রতি ভীত ছিল। তাদের ভয় ছিল খেলাফতী চলে যাবে। সকল ধরনের কৌশল এবং ষড়যন্ত্র তারা ইমামগণকে হত্যা করার জন্য চালিয়েছে। ক্ষমতালোভী বস্তুবাদী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফাগণ হত্যাজিনামদ্যপান,লুণ্ঠনসম্পদের অপব্যয় সকল কিছু করেছে। ইসলামের নামে তারা ছিল মোনাফেক মুসলিম। ক্ষমতালোভী আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর নির্দেশে তাকে ২২০ হিজরীতে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয় ।
হিজরি জিলক্বাদ মাসের শেষ দিন নবীজীর আহলে বাইতের ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর শাহাদাতবার্ষিকী। ২২০ হিজরির এই দিনে ইমাম জাওয়াদ (আ) খোদার দিদারে চলে যান আর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ইমামকে হারানোর ব্যথায় শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। নবীজীকে রেসালাতের যে মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেননবীজীর অবর্তমানে সেই মহান দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় তাঁর আহলে বাইত ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালান। নবীজীর চিন্তার সেই গভীর জ্ঞানের আলো দিয়ে তাঁরা মুসলিম উম্মাহর সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনায়ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। আমরা যদি একবার নবীজীর আহলে বাইতের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করিতাহলে দেখতে পাবো ইসলামের মৌলিক ভিত্তিকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন।

তাঁরা সবসময় কায়েমি স্বার্থবাদীদের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন যাতে ইসলামের মহান স্বরূপ সর্বদা অটুট থাকে। ইমাম জাওয়াদ (আ) নবীজীর আহলে বাইতের একজন ইমাম যিনি তাঁর ১৭ বছরের ইমামতিকালে সবসময় ইসলামের প্রচার-প্রসারে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মহান এই ইমামের বেদনাঘন শাহাদাতবার্ষিকীতে তাই আপনাদের জানাচ্ছি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা। তাঁর জীবন থেকে খানিকটা আলোচনা করে আমরা সমৃদ্ধ করবো আমাদের জীবন।

ইমাম জাওয়াদ (আ) তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন,'মানুষ যদি তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে। একটি হলো-আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। দুই,মানুষের সাথে নম্র আচরণ করা এবং তিন,বেশি বেশি দান-সদকা করা।ইমাম জাওয়াদ (আ) মানুষের সেবা করাকে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হবার কারণ বলে মনে করেন। এ ব্যাপারে কেউ যদি কৃপণতা করে তাহলে তাহলে আল্লাহর নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন: আল্লাহর নিয়ামত যখন কারো ওপর নাযিল হয়তার কাছে মানুষের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। মানুষের এই প্রয়োজনীয়তা মেটানোর চেষ্টা যে না করে,সে নিজেকে আল্লাহর নিয়ামত হারানোর আশঙ্কার মুখে ঠেলে দেয়।

ইমাম জাওয়াদ (আ) ইমাম রেযা (আ) এর সন্তান ছিলেন। ১৯৫ হিজরিতে তিনি মদিনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর জীবনযাপন করেন। এই স্বল্পকালীন জীবনে তিনি মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও উন্নয়নে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর ও সন্দেহজনক। এই সন্দেহের কারণ হলো বহু মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়কে কেবল তার বাহ্যিক এবং বস্তুগত মানদণ্ডেই বিচার-বিবেচনা করে থাকে। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তিমায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি আল্লাহর সর্বশক্তিমান ক্ষমতারই নিদর্শন।

ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণেধৈর্য ও সহনশীলতায়ইবাদত-বন্দেগিতেসচেতনতায়,কথাবার্তায় বিস্ময়কর উন্নত পর্যায়ের। ইতিহাসে এসেছে একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদিনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। এরকম জবাব পাবার ফলে জাওয়াদ (আ) এর ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে গেল। ইমাম জাওয়াদ (আ) বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের সাথে এমন এমন তর্ক-বাহাসে অংশ নিতেন যা কিনা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। এসব বিতর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যেত। কেবল তাই নয় তাঁর দেওয়া যুক্তির ফলে জ্ঞানের বহু জটিল বিষয়ও সহজ হয়ে যেত।

এ কারণে জ্ঞানীজনেরা এমনকি তাঁর বিরোধীরাও তাঁর জ্ঞানের গভীরতার বিষয়টি এবং তাঁর উন্নত আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বিষয়টি অস্বীকার করতেন না। একদিন আব্বাসীয় খলিফা মামুন ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করার জন্যে একটি মজলিসের আয়োজন করে। সেখানে তৎকালীন জ্ঞানী-গুণীজনদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঐ মজলিসে তৎকালীন নামকরা পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবনে আকসাম ইমামকে একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল এই: যে ব্যক্তি হজ্জ্ব পালনের জন্যে এহরাম বেঁধেছে,সে যদি কোনো প্রাণী শিকার করে,তাহলে এর কী বিধান হবে?ইমাম জাওয়াদ (আ) এই প্রশ্নটিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে মূল প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট ২২টি দিক তুলে ধরে উত্তরের উপসংহার টানেন। উত্তর দেওয়ার এরকম স্টাইল ছিল তাঁর জ্ঞানের বিস্ময়কর গভীরতার নিদর্শন। উত্তর পেয়ে উপস্থিত জ্ঞানীজনেরা ইমামের জ্ঞানের বিষয়টি কেবল স্বীকারই করলেন না বরং তাঁর জ্ঞানের প্রশংসাও করলেন।

২০৩ হিজরি থেকে ২২০ হিজরি পর্যন্ত মোট সতেরো বছরের ইমামতিকালে শাসক ছিলেন দুইজন আব্বাসীয় খলিফা। একজন হলেন মামুন আরেকজন মু'তাসিম। এরা আল্লাহর বিধি-নিষেধগুলোকে তেমন একটা মানতেন না এবং অনেক সময় ইসলামকে নিজেদের স্বার্থানুকূলে ব্যবহার করতেন। ইমাম জাওয়াদ (আ) এসব দেখে চুপ করে থাকতে পারলেন না।তিনি সেসবের বিরোধিতা করলেন। সমাজে তাঁর এই বিরোধিতার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আব্বাসীয় খলিফারা ইমামকে হয়রানীর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে অবরোধ কঠোরতরো করে। ইমাম মামুনের পীড়াপীড়িতে মদিনা ছেড়ে আব্বাসীয় খিলাফতের তৎকালীন মূল কেন্দ্র বাগদাদে যেতে বাধ্য হন। তা সত্ত্বেও ইমাম জনগণের সাথে বিভিন্ন কৌশলে যোগাযোগ রক্ষা করে তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তো বটেই এমনকি স্বয়ং আব্বাসীয়দের হুকুমতের ভেতরেই আহলে বাইতের প্রতি বহু ভক্ত অনুরক্ত ছিল। ইমাম তাদেরকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে অনেক অবদান রেখেছিলেন।

জাওয়াদ শব্দের অর্থ হলো দয়ালু বা উদার। এই উপাধিটি থেকেই প্রমাণিত হয় যে ইমাম জাওয়াদ ছিলেন অসম্ভব উদার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর আসল নাম ছিল মুহাম্মাদ তাকি। তাঁর পিতা ইমাম রেযা (আ) জনগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার স্বার্থে যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন,সেসবের মধ্যে একটি ছিল নিজের কাছে কিছু টাকা-পয়সা রাখা যাতে মানুষের প্রয়োজনে দান করতে পারেন। বাবার এই উপদেশ পালন করতে গিয়েই তিনি জাওয়াদ উপাধিতে ভূষিত হন। একবার একটি কাফেলা অনেক দূর থেকে ইমামের জন্যে বহু উপহার নিয়ে আসছিলো। পথিমধ্যে সেগুলো চুরি হয়ে গেল। কাফেলার পক্ষ থেকে ঘটনাটা ইমামকে লিখে জানানো হলো। ইমাম উত্তরে লিখলেন: আমাদের জান এবং মাল আল্লাহর দেওয়া আমানত। এসব থেকে যদি উপকৃত হওয়া যায় তো ভালোআর যদি এগুলো হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত।কেননা তাতে সওয়াব রয়েছে। সঙ্কটে যে ভেঙ্গে পড়ে তার প্রতিফল বিফলে যায়।

ইমামের জীবনের শেষ দু'বছরে আব্বাসীয় শাসক ছিলো মুতাসিম। মুতাসিম জনগণের মাঝে ইমামের জনপ্রিয়তায় উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইমামের বক্তব্যে জনগণের মাঝে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুতাসিমের ভেতর ঈর্ষার আগুণ জ্বলতে থাকে। তাই ইমামের বিরুদ্ধে শুরু করে বিচিত্র ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের ফলেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইমাম শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে তাই আবারো আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক সমবেদনা। ইমামের একটি বাণী উচ্চারণ করে শেষ করবো আজকের আলোচনা

"বাজে লোকের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকোকেননা তার বন্ধুত্ব হলো তলোয়ারের মতোযার বাহ্যিক দিকটা বেশ চকচকে আর কাজটি খুবই জঘন্য।" 

10.  হযরত ইমাম নাক্বী (আ) অত্যাচারী ও ধনসম্পদ আত্মসাৎকারী বস্তুবাদী খলিফাদের সাথে রাসুলের (স.) বংশের সংগ্রাম ও বিরোধীতা ছিল ইতিহাসের এক রক্তিম অধ্যায়। আমাদের ইমামগণ কখনও এই সমস্ত খলিফাদের নিকট আত্মসমর্পন করেন নাই। তাঁরা সত্যের জন্য এবং ইসলামকে সঠিক অবস্থানে রাখার জন্য জীবনকেই  উৎসর্গ করে গেছেন। অথচ আমাদের বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মুসলমান  এই সমস্ত খেলাফতীদের রচিত বিকৃত ধর্মীয় ইতিহাস বিশ্বাস করছে আর তাদেরই উত্তরসূরীরূপে আহ্‌লে বাইতের অনুসারী অলি আল্লাদের বিরোধীতা করছে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে অবশেষে মোতাসেমের খেলাফতকালে ২৫৪ হিজরীর ৩রা রজব তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
ইমাম হাদী (আ.)'র দু'টি মো'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা "
আজ হতে ১২২০ চন্দ্র-বছর আগে ২১২ হিজরির (বা খৃষ্টীয় ৮২৮ সালের) এই দিনে (১৫ ই জিলহজ্) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে-বাইতে জন্ম নেয়া দশম ইমাম হযরত আলী বিন মুহাম্মাদ আন নাকী বা আল হাদী (আ.) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
২২০ হিজরিতে পিতা ইমাম জাওয়াদ (আ.)র শাহাদতের পর তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব নেন। উম্মতের জন্য সুপথ বা হেদায়াতের দিশারি ছিলেন বলেই তাঁর উপাধি ছিল হাদী। তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইমাম হাদী (আ.) আবদুল আজিম হাসানিসহ ১৮৫ জন ছাত্রকে উচ্চ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করেছিলেন এবং তারা সবাই ছিল সে যুগের নানা জ্ঞানে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ।
ইমাম হাদী (আ.) সাত জন আব্বাসীয় খলিফার সমসাময়িক ছিলেন। এই সাতজন হল যথাক্রমে খলিফা মামুনমুতাসিম,ওয়াসিকমোতাওয়াক্কিলমুন্তাসিরমোস্তাইন এবং মুতাজ। খলিফা মুতাসিম ইমাম হাদী (আ.)র পিতাকে বাগদাদে বিষ প্রয়োগে শহীদ করেছিল। এ সময় ইমাম হাদী (আ.) মদীনায় ছিলেন। 
ইমাম হাদী(আ.)'র যুগে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুতাওয়াক্কিল নিজ পুত্রের হাতে নিহত হয় এবং এরপর আরো ৩ জন আব্বাসিয় শাসক ক্ষমতাসীন হয়। এরাও মুতাওয়াক্কিলের মতো ইমাম হাদী (আ.)কে তাদের শাসন ক্ষমতার পথে কাঁটা হিসেবে দেখতে পায়। এ অবস্থায় ২৫৪ হিজরির ২৬ শে জমাদিউস সানি বা তেসরা রজব আব্বাসীয় খলিফা মুতাজ ৪১ বছর বয়সের ইমাম হাদী (আ.)কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করেন। ফলে বিশ্ববাসী তাঁর উজ্জ্বল নূর থেকে বঞ্চিত হয়।
খলিফা মোতাওয়াক্কিল ইমাম হাদী (আ.)কে জব্দ ও অপমানিত করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। ইমামকে সম্মান প্রদর্শনের নামে মোতাওয়াক্কিল তাঁকে নিজ দরবারে হাজির করে অপমানিত এবং কখনও কখনও হত্যারও চেষ্টা করেছে।
মদীনায় নিযুক্ত মোতাওয়াক্কিলের গভর্নর ইমাম হাদী(আ.)'র নামে কিছু মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে খলিফা মোতাওয়াক্কিলের কাছে চিঠি লেখে। ইমাম হাদী (আ.)'র পথ নির্দেশনায় জনগণ শাসকদের অত্যাচার অবিচার ও তাদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অযোগ্যতার কথা খুব অচিরেই বুঝে ফেলবে ও এভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে বলেও মদীনার গভর্নর তার চিঠিতে উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় মুতাওয়াক্কিল ইমামকে কৌশলে তৎকালীন রাজধানী সামেরা শহরে নিয়ে আসে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইমাম হাদী (আ.) সামেরা শহরেও প্রকৃত ইসলাম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখেন।
ইমাম হাদী (আ.)'র জ্ঞানপ্রজ্ঞাদানশীলতাসদাচরণঅধ্যবসায়সত্যের পথে জিহাদপরোপকার ও খোদা-ভীতির মত মহৎ গুণাবলী আজও মুসলমানদের জন্যে মানবীয় পূর্ণতা লাভের আদর্শ।
ইমাম হাদী(আ.)'র দু'টি মো'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল:
আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল ইমামের সাহচর্য পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে এবং তাঁর প্রতি ভালবাসাসম্মান প্রদর্শন ও আনুগত্যের কথা বলে এই মহান ইমামকে ইরাকের সামেরা শহরে আসতে বাধ্য করেন। ইমাম মোতাওয়াক্কিলের চালাকি বোঝা সত্ত্বেও সামেরায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। সামেরা সফরে ইমাম হাদী (আ.)'র সঙ্গী ছিলেন ইয়াহিয়া ইবনে হারসামা। ইমাম সামেরার উপকণ্ঠে পৌঁছলে মোতাওয়াক্কিল ইমামকে অপমান করার জন্য শহরে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে 'খানুস সায়ালিকনামের এক অনুপযুক্ত স্থানে তাঁকে থাকার নির্দেশ দেয়। এখানে থাকত ভিক্ষুকরা। মোতাওয়াক্কিল পরের দিন এখানে ইমামের জন্য একটি আলাদা ঘর বরাদ্দ করে। সালেহ ইবনে সাইদ নামের এক ব্যক্তি ইমামের সেবা করার জন্য সেখানে আসেন। তিনি ইমামকে বলেন যেজালিম মোতাওয়াক্কিল সব ক্ষেত্রে আপনার নুর নিভিয়ে দিতে চায় এবং অগ্রাহ্য করতে চায় আপনার মর্যাদাকে। আর এ জন্যই আপনাকে নিম্নমানের এই সরাইখানায় উঠিয়েছে (যেখানে ফকিররা থাকে)। ইমাম একদিকে ইশারা করে বললেন: হে সাইদ! ওই দিকে দেখ। সাইদ বর্ণনা করেন: আমি চেয়ে দেখলাম একটি সুসজ্জিত বাগান যা ছিল নানা রকম ফলে ভরাছিল প্রবাহিত ঝর্ণাধারা,বেহেশতি হুর ও গিলমান। এ দৃশ্য দেখে আমি বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে যাই। ইমাম হাদী (আ.) বললেন: আমরা যেখানেই থাকি এগুলো আমাদের খেদমতে নিয়োজিত থাকে। হে ইবনে সাইদআমরা খানুস সায়ালিকে থাকি না।
* * *
সুন্নি আলেম শেখ সুলাইমান কানদুজি 'ইয়া নাবী আল মুয়াদ্দাশীর্ষক বইয়ে লিখেছেন: "(ঐতিহাসিক) মাসউদি বর্ণনা করেছেনএকদিন আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল তার প্রাসাদের আঙ্গিনায় তিনটি হিংশ্র পশু আনে এবং এরপর ইমাম হাদী (আ.)-কে দাওয়াত করে। যখনই ইমাম প্রাসাদের অঙ্গনে প্রবেশ করলেন তখনই মোতাওয়াক্কিল প্রাসাদের দরজা বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল হিংশ্র পশুগুলো ইমামের চারপাশে পায়চারি করছিল এবং ইমামের প্রতি বিনয় প্রকাশ করল। আর ইমাম(আ.) জামার আস্তিন দিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। এরপর ইমাম উপরে মোতাওয়াক্কিলের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আবার নীচে নেমে আসেন। ইমাম প্রাসাদ অঙ্গন থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত হিংশ্র পশুগুলো আবারও বিনয় প্রকাশ করছিল। পরবর্তীতে মোতাওয়াক্কিল ইমামের জন্য এক বিশাল উপহার পাঠায়। দরবারিরা মোতাওয়াক্কিলকে বলল: ইমাম হাদী (আ.) পশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন তাতো দেখলে। এবার তুমিও ওই একই কাজ কর। মোতাওয়াক্কিল বলল: তোমরা কি আমাকে মারতে চাও! আর বললএ ঘটনা কাউকে বলো না।"

11.  হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ) : বস্তুবাদী লোভী আব্বাসীয় খলিফা মোতামেদ ছিল ভোগ বিলাসীও জুলুম অত্যাচারকারী। সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। আমাদের ধর্মীয় মোল্লা-মৌলভীগণ এই সমস্ত খলিফাদের ধর্মের বোঝা মস্তিষ্কে ধারণ করে মাদ্রাসা শিক্ষকতা এবং মসজিদের ইমামতি করছে। মানুষের জন্মমৃত্যুবিবাহএই সমস্ত মোল্লাদের ছাড়া চলেনা। নবী পরিবারের দুশমনদের রীতিনীতি অনুসরণ করে তারা মহাধার্মিক সেজে আছে। ইমাম সাহেবকে কয়েকবার বন্দী করা হয়। অবশেষে খলিফা মোতামেদ বুঝতে পারে বন্দী করেও ইমামের প্রতি মানুষের ভালবাসা কমানো যাবেনা। তাই তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি ২৬০ হিজরীর ৮ রবিউল আওয়াল বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদাত বরণ করেন।
হিজরি আটই রবিউল আউয়াল ইসলামের ইতিহাসের একটি বেদনাবিধুর দিন। হিজরি ২৬০ সালের এইদিনে হযরত ইমাম মাহদি (আ.)'র পিতা নবীবংশের নিষ্পাপ ইমাম হযরত হাসান আসকারি (আ.) শহীদ হয়েছিলেন অত্যাচারী আব্বাসীয় শাসকের হাতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে। অবশ্য তাঁর মাত্র ছয় বছরের ইমামত বা নেতৃত্ব ইসলামকে দিয়েছে আরো একটি গৌরবময় সোনালী অধ্যায়। জালিম শাসকদের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও তাদের সৃষ্ট অসংখ্য বাধা আর শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁর ধর্মের সংরক্ষকদের মাধ্যমে ইসলামের আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সত্য-সন্ধানী ও খোদা-প্রেমিক মানুষদের অন্তরে। এই মহান ইমামের শাহাদতের বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র বাবা ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ও দশম ইমাম হযরত হাদী (আ.)। মা ছিলেন মহিয়সী নারী হুদাইসা। 
ইমাম হাসান আসকারি (আ.) জন্ম নিয়েছিলেন পবিত্র মদিনায়। কিন্তু সমকালীন শাসক গোষ্ঠী খাঁটি ইসলামের ধারক-বাহকদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও জনপ্রিয়তার ব্যাপারে এতই আতঙ্কিত ছিল যে তাঁদের অনেকেরই জন্মভূমিতে জীবন কাটানোর সুযোগ হয়নি। আব্বাসীয় শাসকদের আদেশে ইমাম আসকারি (আ.) বাধ্য হয়েছিলেন পিতা ইমাম হাদী (আ.) এর সাথে প্রিয় মাতৃভূমি মদিনা শহর ছেড়ে আব্বাসীয়দের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র সামেরায় চলে যেতে। সামেরা শহরে ততকালীন শাসকদের সশস্ত্র বাহিনীর অন্যতম প্রধান সামরিক কেন্দ্র তথা 'আসকারঅঞ্চলে কঠোর নজরদারির মধ্যে এই ইমামকে বসবাস করতে হয়েছিল বলে তিনি আসকারি নামে খ্যাতি অর্জন করেন। কঠোর প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ইমাম হাসান আসকারি (আ.) অশেষ ধৈর্য নিয়ে তাঁর অনুসারিদেরকে জ্ঞানগত,সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকসহ নানা ক্ষেত্রে পথনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর কারণআল্লাহ নিজেই বলেছেন যেতিনি ইসলামের আলোকে ছড়িয়ে দেবেন।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র যুগে জালিম আব্বাসীয় শাসকরা সব ক্ষেত্রেই ন্যায় নীতি থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। তারা জনগণের সম্পদ শোষণের পাশাপাশি মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ছড়াতেও সহায়তা করেছে। কিন্তু জনগণের কানে এ খবর পৌঁছে গিয়েছিল যেইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র সন্তান ইমাম মাহদির (আ.) মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জুলুম আর অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি পাবে। শাসক গোষ্ঠীও এই খবরের কথা জানতো। তাই তারা ইমাম ও জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির চেষ্টা জোরদারের জন্য নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা তীব্রতর করে এবং ইমামের যেন কোনো সন্তান জন্ম নিতে না পারে সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়। ফলে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) নিজেও বিশেষ বিশেষ দিনে আব্বাসীয় শাসকদের দরবারে উপস্থিত হতে বাধ্য হতেন। কিন্তু এতসব বাধা সত্ত্বেও ইমাম হাসান আসকারির (আ.)'র সন্তান তথা মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদি (আ.) জন্ম গ্রহণ করেন মহান আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় ঠিক যেভাবে ফেরাউনের বাধা সত্ত্বেও মুসা (আ.)'র জন্মগ্রহণকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

ইমাম মাহদি (আ.)'র জন্মের পর ইমাম হাসান আসকারি (আ.) মুসলিম সমাজকে ভবিষ্যত নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলার জন্য দিক-নির্দেশনা দেন। এ ছাড়াও ইমাম নানা কুপ্রথা ও ভুল চিন্তাধারা সম্পর্কে মুসলমানদের সন্দেহ দূর করেন এবং খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের চিন্তাধারা তুলে ধরেন। ইমাম হাসান আসকারি (আ.) জ্ঞান-পিপাসুদেরকে জ্ঞানের স্বচ্ছ ও বাস্তব ঝর্ণাধারায় পরিতৃপ্ত করতেন। জ্ঞানগত বিতর্কে তাঁর যুক্তি ছিল এমন অকাট্য ও মোক্ষম যে ইয়াকুব বিন ইসহাক কিন্দির মত প্রখ্যাত বস্তুবাদী দার্শনিক এই মহান ইমামের সঙ্গে বিতর্কের পর বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হন এবং ধর্মীয় কোনো কোনো বিষয়ের সমালোচনা করে যে বই তিনি লিখেছিলেন তা নিজেই পুড়ে ফেলেন।

আহমাদ বিন খাক্বান নামের আব্বাসীয়দের একজন সরকারি মন্ত্রী ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র যোগ্যতাগুণ ও কারামত সম্পর্কে বলেছেন: 'সামারায় হাসান বিন আলীর মত কাউকে দেখিনি। বিনম্রতাচারিত্রিক ও নৈতিক পবিত্রতা এবং মহানুভবতার মত ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের মধ্যে তাঁর মত আর কাউকে দেখিনি। তিনি একজন যুবক হওয়া সত্ত্বেও বনি হাশিম তাঁকে বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিত। তিনি এত উচ্চ সম্মানের অধিকারী যে শত্রু ও বন্ধু সবাই তাঁর প্রশংসা করতেন।'

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) তাঁর সম্মানিত পূর্বপুরুষদের মত ইবাদত-বন্দেগিতে আদর্শস্থানীয় ছিলেন। নামাজের সময় হলে তিনি সব কাজ বাদ দিয়ে প্রথমেই নামাজ আদায় করতেন। আবু হাশেম জাফরি বলেছেনএকবার ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র সাক্ষাতে হাজির হলাম। তিনি কোনো একটা বিষয়ে লেখায় মগ্ন ছিলেন। এমন সময় নামাজের সময় হল। তিনি এক মুহূর্ত বিলম্ব না করেই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র নামাজের উচ্চ পর্যায়ের ধরন বা কোয়ালিটি অন্যদেরকে আল্লাহর ইবাদতে আকৃষ্ট করত। ইমাম যখন সালেহ ইবনে ওয়াসিফ-এর কারাগারে বন্দি ছিলেন ততকালীন শাসক কারাপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছিল যাতে সে ইমামের সঙ্গে খুব কর্কশ আচরণ করে ও কঠোর শাস্তি দেয়। এ জন্য নিকৃষ্ট দুই জল্লাদকে নিয়োগ দেয় কারা-প্রধান। কিন্তু তারা ইমামের পুত-পবিত্র চরিত্রের সংস্পর্শে সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে পাকা নামাজি হয়ে যায়। 
কারাপ্রধান ওই দুই জল্লাদকে ডেকে তাদেরকে এ ব্যাপারে তিরস্কার করায় তারা বলল:
আমরা কি করবএই ব্যক্তি সারা দিন রোজা রেখে সারা রাত নামাজে মগ্ন থাকেন এবং ইবাদত ছাড়া অন্য কিছুই করেন না। যখনই তিনি আমাদের দিকে তাকাতেন আমরা নিজের অজান্তেই কাঁপতে থাকতাম ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতাম।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) এর চারিত্রিক পবিত্রতা ও ব্যক্তিত্বের মাধুর্য তাঁর অনুসারীদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করতো। অন্যদিকে মুনাফিক এবং বিচ্যুতরা বিকর্ষিত হত। ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী তাঁর জনপ্রিয়তা এবং আকর্ষণ সম্পর্কে বলেছেনঃ 'আমার নেতা ইমাম হাসান আসকারি (আ.) একজন নজিরবিহীন মানুষ এবং অসম্ভব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মতো আর কাউকে আমি দেখি নি। যখনি তিনি কোনো এলাকা দিয়ে যেতেন জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়তো। জনতার কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতো ঐ এলাকা। ইমাম জনতার সামনে এলেই পরিবেশটা সবার অজান্তে নীরব হয়ে যেত। ইমামের নূরানি স্বরূপতাঁর আচার- আচরণ সবাইকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো। জনগণ পরম শ্রদ্ধাভরে রাস্তা করে দিতেন যাতে ইমাম যেতে পারেন।'

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ইমামতির ছয় বছরে আব্বাসীয় শাসকদের তিনজনকে পেয়েছিলেন। এরা ছিল মোতায,মোহতাদি এবং মোতামেদ। ইমাম এদের স্বেচ্ছাচারিতা চুপ করে সহ্য করেন নিযার ফলে তারা ইমামের ওপর রুষ্ট হয়ে পড়ে। সে কারণে তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও ইমাম বলদর্পি শাসকদের কাছে মাথানত করেননি। অবশেষে জালিম মোতামেদ বুঝতে পারে যেবন্দী রেখেও ইমাম হাসান আসকারির প্রতি জনগণের আগ্রহ ও ভালবাসার ক্রমবর্ধমান জোয়ার ঠেকিয়ে রাখা যাবে নাবরং তাঁর বন্দীদশা সরকারের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবেতাই সে ইমামকে বন্দী রাখার সাহস হারিয়ে ফেলে এবং ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করে। অবশেষে ইমামকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে মোতামেদ। ফলে ইমাম ২৬০ হিজরির ৮ ই রবিউল আউয়াল শাহাদত বরণ করেন মাত্র ২৮ বছর বয়সে। মোতামেদ এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিল যাতে গণ-বিদ্রোহ দেখা না দেয়।

ইমামের মৃত্যু সংবাদ যখন ছড়িয়ে পড়ল তখন সমগ্র সামেরার অলি-গলিরাস্তাঘাট জনতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সর্বত্র কান্না ও চিতকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাজারে দোকান পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বনি হাশিমপ্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীসেনা ও কমান্ডারশহরের বিচারপতিকবি-সাহিত্যিকসহ আপামর জনসাধারণ শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। সামেরা যেন সেদিন কিয়ামতের মাঠে পরিণত হয়েছিল।

ইমামের শাহাদতের পর তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় ইমামের ভাই জাফর জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ইমাম মাহদি (আ.) আবির্ভূত হয়ে জাফরকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই পিতার জানাজার নামাজ পড়ান।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) নানা প্রেক্ষাপটে নিজের অনুসারী ও সহযোগীদের চিঠি লিখে দিক-নির্দেশনা দিতেন। কোমের মহান আলেম ও ফকিহ আলী ইবনে হুসাইন ইবনে বাবুইয়েকে লেখা এক চিঠিতে তিনি যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি:

মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম দাতা ও দয়ালুসব প্রশংসা তাঁর জন্য যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। পরকালের মঙ্গল মুত্তাকি বা খোদাভীরুদের জন্যবেহেশত একত্ববাদীদের জন্য ও দোযখের আগুন কাফির বা মুর্তাদদের জন্য। প্রকাশ্য শত্রুতা ও যুদ্ধ শুধু জালিমদের জন্য। আল্লাহ ছাড়া কোনো উত্তম সৃষ্টিকর্তা নেই। মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর দরুদ এবং আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছিতিনি তোমাকে একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। নামাজ কায়েম করাযাকাত আদায় করা ও পরহিজগারিতার জন্য তোমাকে আদেশ করছি (কারণ,যাকাত না দিলে তার নামাজ কবুল হয় না)। তোমাকে আরও আদেশ করছি যে মানুষের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে দিবে,নিজের ক্রোধ দমন করবেআত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেতাদের সুসময়ে ও দুঃসময়ে সহযোগিতা করবে। অজ্ঞ ও মূর্খদের প্রতি নম্র ও সহনশীল থাকবেসচ্চরিত্রতাসত কাজের আদেশ ও অসত কাজের নিষেধ করে যাবে। মহান আল্লাহ বলেছেন:
একমাত্র যারা মানুষকে সদকাসত কাজ ও আত্মসংশোধনের আদেশ দেয় তারা ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কথায় কোনো মঙ্গল নেই। সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকবেতাহাজ্জদ নামাজ পড়বে ঠিক যেমনটি মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে তাহাজ্জদ নামাজ পড়ার জন্য জোর দিয়ে বলতেনআমিও তোমাকে তার ওপর জোর দিচ্ছি। হে আলী তাহাজ্জদ নামাজের প্রতি যত্নবান হওতাহাজ্জদ নামাজের প্রতি যত্নবান হওতাহাজ্জদ নামাজের প্রতি যত্নবান হও। যে ব্যক্তি তাহাজ্জত নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেয় না সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়। অতএব আমার নির্দেশিকা মত আমল কর এবং ঠিক যেভাবে তোমাকে আমল করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি আমার অনুসারীদেরকেও সেভাবে আমল করতে বল। ধৈর্য ধারণ কর এবং শেষ ইমাম মাহদি (আ.)'র আবির্ভাবের প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষায় থাকবেএ ব্যাপারে মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেনআমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ আমল হল 'ইমাম মাহদি (আ.)'র জন্য প্রতীক্ষা করা। আমার সন্তান ইমাম কায়েম তথা ইমাম মাহদি (আ.)'র আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত আমাদের অনুসারীগণ দুঃখ বেদনায় নিমজ্জিত থাকবে। এরপর যেমন রাসূল (সা.) সুখবর দিয়েছেন জুলুম নির্যাতনে ভরপুর পৃথিবীকে ইমাম মাহদি ন্যায় বিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করবে।

হে আমার বিশ্বাসভাজন মহান আবুল হাসাননিজেও ধৈর্য ধর এবং আমার অনুসারীদেরও ধৈর্যের পরামর্শ দাও,আল্লাহর জমিনে তাঁর বান্দাহদেরই রাজত্ব আসবে। পরকালের শান্তি পরহিজগারদের জন্যই। আমার সালাম,আল্লাহর শান্তি ও বরকত আমার অনুসারী এবং তোমার ওপর বর্ষিত হোক। 
ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র অনেক মুজেজা ও অদৃশ্য কর্মকাণ্ডের কথা জানা যায়। যেমনতিনি মানুষের মনের অনেক গোপন কথা বা বাসনা জেনে তাদের সেইসব বাসনা পূরণ করেছেনঅদৃশ্যের অনেক খবর দিয়েছেননানা ভাষাভাষী ভৃত্যদের সঙ্গে তাদের নিজ নিজ ভাষায় কথা বলেছেন। ইমামের একটি মু'জিজার ঘটনা এরূপ যেমুহাম্মাদ ইবনে আইয়াশ বলেন,

একদিন আমরা কয়েকজন একত্রে বসে ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র মু'জেজা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমাদের মাঝে অবস্থানরত এক এক নাসেবি তথা বিশ্বনবী (সা,)'র আহলে বাইতের বিদ্বেষী বলল: আমি কয়েকটা প্রশ্ন কালিবিহীন কলম দিয়ে লিখব। যদি ইমাম জবাব দিতে পারেন তাহলে বিশ্বাস করব যে তিনি সত্যিকারের ইমাম। আমরা সে কথা মত কতগুলো বিষয় লিখলাম নাসেবির কালিবিহীন কলমে। আর নাসেবি তার প্রশ্নগুলো লিখল একই কলমে। আমরা সেগুলো ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র কাছে পাঠালাম। ইমাম সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠালেন এবং নাসেবির কাগজের ওপর তার নামতার বাবার নাম ও তার মায়ের নাম লিখে পাঠালেন। নাসেবি তা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তাঁর হুশ ফিরে আসার পর সে ইমামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল ও ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে শামিল হল। 

ইমাম হাসান আসকারী (আ) এর মূল্যবান কিছু বাণী দিয়ে শেষ করবো আজকের এই আলোচনা। তিনি বলেছেন :
১ - মিতব্যয়ী হও এবং অপচয় ও অপব্যয় করো না।
২ - ঝগড়াঝাটি করোনা তাহলে মানসম্মান থাকবেনাঠাট্টা করো না তাহলে সাহস পেয়ে যাবে।
৩ - যখন মন উৎফুল- থাকে তখন জ্ঞানার্জন করআর যখন বিষনড়ব থাকে তখন বিরত থাকো।
৪ - শোকার্ত লোকের সমানে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করা অভদ্রতার লক্ষণ।
৫ - যে ব্যক্তি কউকে গোপনে উপদেশ দেয় সে তাকে অলংকৃত করলোআর যে ব্যক্তি সকলের সামনে প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করলো শুধু তার বদনামই করলো সংশোধন করতে পারলো না।
৬ - সংযমেরও একটা সীমা আছে যদি তা অতিক্রম করা হয় তাহলে বিপদের আশংকা আছে।

সবাইকে আরো একবার গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে শেষ করছি আজকের আলোচনা। অসংখ্য দরুদ ও রহমত বর্ষিত হোক ইমাম হাসান আসকারি (আ.)'র ওপর।  
[উল্লেখ্য,  শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের অনেক ধর্মীয় নেতা ও চিন্তাবিদ মনে করেন মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদি (আ.) প্রায় ১২০০ বছর আগে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি বিশ্বনবী (সা.)র পবিত্র আহলে বাইতের বংশ ধারায় হযরত ইমাম হুসাইন-আ.র নবম অধস্তন বংশধর। অন্য কথায় তিনি ১১ তম ইমাম হযরত ইমাম হাসান আসকারি (আ.)র পুত্র এবং মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি হযরত ঈসা (আ.)র মত অদৃশ্য হয়ে যান। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বব্যাপী অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধের লক্ষ্যে তিনি আবার আবির্ভূত হবেন পবিত্র মক্কায় এবং হযরত ঈসা নবী (আ.) তাঁর পেছনে নামাজ পড়বেন। অবশ্য ঠিক কখন তিনি আবারও আবির্ভূত হবেন তা মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না,  (কোনো ইমাম তা জেনে থাকলেও মহান আল্লাহর নির্দেশিত গোপন বিষয় হিসেবে তারা তা প্রকাশ করেননি) যদিও তাঁর আবির্ভূত হওয়ার প্রাক্কালের কিছু লক্ষণ বা আলামতের কথা হাদিসে এসেছে। তিনি সারা বিশ্বে ইসলাম ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। মহান আল্লাহ তাঁর পুনরাবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন।]#

12.  হযরত ইমাম মাহদী (আ) : আহলে বাইত অস্বীকারকারী মাওলাইয়াত বিরোধী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খলিফারা এমন কোন অপকর্ম বাদ রাখেন নাই যা তারা করে নাই। অত্যাচারনির্যাতনজুলুমমানুষ হত্যা,জেল-জরিমানানারীভোগ এবং সকল ধরনের নেশায় তারা ডুবে ছিল। ওদের রাজত্বকালটা মুসলমানরূপী মোনাফেক মুসলমানের রাজত্ব। হত্যাঅত্যাচারনির্যাতনের মাধ্যমে জনসমর্থন তাদের পক্ষে নিয়েছিলঅবশেষে জনসমর্থনের অভাবে ২৭৩ হিজরী সনে তিনি গায়েব হয়ে যান।
নবী করিম (স.) একবার মাত্র হজ্ব করেছেন যাকে বিদায় হজ্ব বলা হয়। বিদায় হজ্ব শেষে চলার পথে গাদিরে খুম নামক জায়গায় ১৮ই জিলহজ্ব তারিখে তিনি যাত্রা বিরতি করেন। উটের উপর মিম্বর বানিয়ে মাওলা আলী (আ.) এর প্রতিনিধিত্ব ঘোষণা করেন। উম্মতগণের হেদায়েত এবং পরিচালনার দায়িত্ব মাওলার নিকট অর্পণ করেন। উপস্থিত উম্মতগণ এই অভিষেক ক্রিয়া সুন্দর ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক মোনাফেক মুসলমান হিংসার কারণে  মাওলার প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করতে পারে নাই। রাসুলের (স.) উপস্থিতিতে স্বীকার করে নিলেও পরবর্তীতে অস্বীকার করে। রাসুল (স.) বিদায়ের আগে লিখিত আকারে রেখে যেতে চাইলেন কিন্তু মোনাফেক ও আহলে বাইত বিরোধী চক্রের বাধার কারণে তাও পারেন নাই।  মাওঁলার বিরোধী চক্র রাসুলের দেহ মোবারক দাফন না করে বনি সাকিফায় চলে যায়।   মাওঁলাকে বাদ দিয়ে একটি ক্ষুদ্র নির্বাচনের মাধ্যমে খলিফা নির্বাচন করা হয়। ফলে খেলাফতের সৃষ্টি হয়। মাওলাইয়াৎ অস্বীকার হল। নবুয়ত শেষবেলায়েতের শুরু। এই বেলায়েতের ধারক-বাহক ছিলেন মাওলা আলী (আ.) । তিনি কাবা ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন। সর্বপ্রথম অল্প বয়সে রাসুলের (স.) নিকট নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিমরূপে আত্নপ্রকাশ করেন। সবসময় রাসুলের (স.) সঙ্গেই ছিলেন। তিনি ছিলেন পাক পাঞ্চাতনের অন্যতম সদস্য মা ফাতেমার স্বামীহাসান ও হোসাইনের পিতা। রাসুল (স.) বলেছেন “ আমি জ্ঞানের নগরী আর মাওলা আলী সেই নগরীর দরজা।
মাওলা আলীর (আ.) সঙ্গে তুলনীয় কোন সাহাবী ছিল না।  কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। মুসলমানের রূপ ধরে মোনাফেকগণ আরব্য জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর ছিল। তারা পবিত্র ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। তাদের চরিত্রেআচার-আচরণে রাসুলের আদর্শ কিছুই ছিল না। তাদের মুখে ছিল ধর্মের কথাঅন্তরে ছিল মোনাফেকী ভাব। এদের হাতেই শিশু ইসলাম নিয়ন্ত্রীত হয় । ফলে জেহাদী ভাবধারা পরিবর্তন করে যুদ্ধের সৃষ্টি করে। মোজাহেদ বাহিনীর পরিবর্তে সেনাবাহিনীর প্রচলন হয়। এমনিভাবে সালাত জাকাতরোজা,হজ্জকোরবানী,খুম্‌স প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক বিধানগুলোর পরিবর্তিত ভাব ধারা সমাজে প্রকাশ করে। আর এতেই বিশ্বাস করে মানুষ ধর্ম বিশ্বাসী মুসলামন হয়ে আছে। এই সমস্ত আনুষ্ঠানিক বিধান গুলিতে আধ্যাত্ববাদের ভাব ধারা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। রাসুলের(স) বিদায়ের আড়াইশ বছরের পর হাদিস সংগ্রহ করা হয়। এই সমস্ত হাদিসগুলো ও বিভিন্ন প্রকারের যেমন- সহি,জইফ,গরীবহাসানুন গরীবুন,নাকেস ইত্যাদি। যখন কোন সাহাবী তাবে তাবেয়ীন কেহ জীবিত ছিলেন না তখন হাদিসগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল। রাসুলের (স) নামে বহু মিথ্যা হাদিস রচনা করা হয়। হাদিস গ্রন্থগুলি পর্যালোচনা করলে অসংখ্য মিথ্যা হাদিস পাওয়া যায়। আর এই সমস্ত হাদিস গ্রন্থ শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছে মোল্লামৌলভীগন এবং তাদের দায়িত্বে মাদ্রাসা ও মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে । জন্মমৃত্যু এবং বিবাহ তাদের ছাড়া অচল। এক কথায় সমাজের সহজ সরল অর্ধ শিক্ষিত মুসলমানগণ তাদের হাতে বন্ধি। তারা ধর্মীয় বিধানগুলো যেভাবে প্রকাশ করে সমাজ ও তা সহজ ভাবে মেনে নিচ্ছে ।অলি আল্লাহসাধকআল্লাহ  প্রেমিকগনের অবস্থান সমাজে থাকেনা। সমাজে তাঁরা থাকতে চাইলে ও হামলা ,ভাংচুর,অত্যাচার নির্যাতনের সম্মুখীন হন। এ সমস্ত অন্যায় কাজে সমাজের বস্তুবাদী মাতব্বরগণ সহযোগিতা করে থাকে। তাদের অন্তরালে নেতৃত্বে থাকে এজিদি শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরূপি মোল্লাগন। ইসলামের নামে ধর্মের দোহাই দিয়ে চলছে মানবতাবিরোধী সন্ত্রাস। পাক পাঞ্চাতনের সদস্য এবং আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমামগনকে হত্যাঅত্যাচারনির্যাতনকারীরাই ধর্মীয় প্রচার কেন্দ্র গুলো প্রতিষ্ঠা এবং দখল করে বিকৃত ধর্মীয় বিধান চালু করেছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফারাই ইসলামের মধ্যে বিভ্রান্তি,বিকৃত ইতিহাস এবং রাজকীয় তফসির প্রকাশ করে মুসলামান জাতিকে অন্ধকারের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বহুদলে ও পথে বিভক্ত হয়ে পড়েছে মুসলিম সম্প্রদায়।তাই বর্তমানে মুসলমানগণ বিশ্বে সন্‌্ত্রাসি জাতি হিসেবে চিহিৃত।
আমাদের ধর্মীয় দলগুলি নিজেদের সত্য এবং সঠিক বলে ফতোয়া দিচ্ছে। অহাবী,খারিজিশিয়াসুন্নীআলকায়দা,তালেবানজামায়াতশিবিরহরকাতুল জিহাদকাদিয়ানীইসলামীফ্রন্ট,ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনখেলাফত মজলিসআহলে হাদিসহেজবুল্লাহইসলামী ঐক্যজোট আহলে সুন্নাতুল ওয়াল জামায়াত লঙ্কর-ই-তৈয়বা,ছাত্রসেনালাহাদিস ইত্যাদি।  এতসব ধর্মীয় দলের মধ্যে সাধারণ সহজ সরল মুসলমান সত্য ও সঠিক পথ খুঁজে পেতে হিমসিম খাচ্ছেন। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। জ্ঞানের র্চ্চা হচ্ছে। টিভি,বি.সি.আর .ইন্টারনেট প্রভৃতির মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার ঘটছে। সুতারং সঠিক ও সত্য পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। হিংসা,হানাহানিতে লিপ্ত না হয়ে মানুষকে সত্য পথ খুঁজে পেতে সহযোগিতা করা মানবিক দায়িত্ব।
হযরত জাবের (রা) হইতে বর্ণিত আছে যেবিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূল পাক (দ.) ঘোষণা করিয়াছিলেন, “ইয়া আয়্যুহান্নাছু ইন্নি তারাকতু ফি কুম মা ইন্‌ আখাজতুম লান তাদেল্লু বায়দি আউয়ালুহা কেতাবাল্লাহে ওয়া এতরাতি আহলে বায়াতি।
অর্থাৎ, “ হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের নিকট যাহা রাখিয়া যাইতেছি তাহা যদি আঁকড়িয়ে থাক তবে পথভ্রষ্ট হইবে না। প্রথমটি আল্লাহর কেতাবদ্বিতীয়টি আমার আহলে বায়াত।
হযরত আনাস (রা.) হইতে বর্ণিত আছে রাসুল পাক (দ.) বলিয়াছেন, “ আ হেব্বুনী লে- হুব্বিল্লা ওয়া আহেব্বু আহলে বায়াতী লেহুব্বি।
অর্থাৎ,“ আমাকে ভালবাসিতে হইবে আল্লাহর ভালবাসা পাইবার জন্য এবং আহ্‌লে বাইতকে ভালবাসিতে হইবে আমার ভালবাসা পাইবার জন্য।” – (তিরমিজি)
হযরত ইবনে আববাস (রা) বলেন, “ মহানবী  (স) বলেছেনআমার আহলে বাইতের উদাহরণ হযরত নূহ (আ.) এর নৌকার মত। যারা নৌকায় আরোহন করলতারাই রক্ষা পেল। আর যারা তা করলনা তারাই সবাই ডুবে মরল।
তারীখুল খুলাফা
(জালালুদ্দিন আস সুয়ুতী পৃ: ৩০৭)



পাক পাঞ্চাতনে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন যাঁরা সারা সৃষ্টিজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তাঁদের নিয়েই সৃষ্টি। পাঁচজন সদস্য হলেন – ১. নবী করিম (স.)২. মাওলা আলী (আ.),  ৩. মা ফাতেমা (সালামাল্লাহে)৪. মাওলা হুসাইন (আ.)৫. মাওলা হাসান (আ.)। রাসূল (স.) পাক পাঞ্চাতনের চারজন সদস্যকে আহ্‌লে বাইত’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের উপর দরুদ পড়া এবং নিজের প্রাণের চেয়ে অধিকপ্রিয় মনের মধ্যে জায়গা না দিতে পারলে এবাদতের পরিপূর্ণতা আসেনা।
পাক পাঞ্জাতন বা আহলে বায়েত নুহের (.) কিস্তি' ফলক:
১৯৫১ সালের জুলাই মাসে একদল গবেষক কোয়েকাফ পাহাড়ে মাটি জরিপ করতে গিয়ে একটি ফলক দেখতে পান;এরপর বহু গবেষণায় (১৯৫২তারা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যেএটি নুহ (.) এর নৌকা ছিল (যা জোদায়পাহাড় হতে) উক্ত ফলকে প্রাচীন ভাষায় কিছু লিখা রয়েছে। ফলে তাদের আগ্রহ আরো বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ারঅধিনে নিম্নলিখিত ভাষাবিদদের সমম্বয়ে কমিটি করে গবেষণা শুরু করা হয় প্রফেসর ছোলেনফমস্কোইউনিভারসিটি প্রফেসর ইফাহান খেনুলুলহান কলেজচীনএম আহমদকোলাড জিট কোমেন রিসার্সএসোসিয়েশন...... মেজর কটলোকস্ট্যালিন কলেজউক্ত  সাত জন্ গবেষক দীর্ঘ আট মাস গবেষণা করারপর এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে ফলকটি নুহ (.) জাহাজ তৈরী করার সময় ব্যবহার করছিলেন।ফলকটিতে পাঞ্জার মতো ছবি খোদাই করা এবং ছামানী ভাষায় লেখা- “হে আমার প্রভুআমার সাহায্যকারীআমার হাত করুণা  রহমতের সংগে ধর তোমার পাক-পবিত্র প্রিয় বান্দাদের ওসিলায়” মোহাম্মদ (সা.) এলিয়া(আলীসাব্বির (ইমাম হোসাইনসাব্বার (ইমাম হাসানফাতেমা যারা সয়ম্ভু  সম্মানী বিশ্বচরাচর তাদেঁর জন্যসৃষ্টি হয়েছেতাদেঁর নামের ওসিলায় আমাকে সাহায্য করো।
 ফলক আজও রাশিয়ার মস্কোতে প্রাচীন ফসিল গবেষণা কেন্দ্রে রক্ষিত আছে।
আহলে বায়েতের সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর হাদিস থেকে- "আমার আহলে বায়েত নুহ (.) এর কিস্তির ন্যায়,যারা এই কিস্তিতে আহরোণ করলো তারা নাজাত পেলআর যারা আহরোণ করল না তারা ধ্বংস হলো।"
অন্য হাদিসে "আমি তোমাদের মধ্যে দুটি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি ; যদি সে দুটিকে আঁকড়ে ধর তবে আমারপর কখনই বিভ্রান্ত হবে না। এদের একটি অপরটি উপর প্রাধান্য রাখেএকটি আল্লাহর কিতাব কুরআন।কুরআন হলো আসমান হতে জমিন পযর্ন্ত ঝুলন্ত রশির ন্যায় এবং আরেকটি হলো আমার বংশধরএরা হাওজেকাওসার পযন্ত আলাদা হবে না। সুতরাং এদিকে দৃষ্টি রেখ (সাবধান হওসতর্ক হওখেয়াল রেখআমার পরেতোমরা  দুটির সাথে কিরূপ আচরণ করবে।

No comments:

Post a Comment