রুহের হাকিকত
ইসলামি জ্ঞানের সমুদ্র বলে যাঁকে সবাই একবাক্যে মেনে নেন সেই বিশ্ববিখ্যাত হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালির এহিয়ায়ে উলুমউদ্দিন নামক বিশাল কেতাবের একস্থানে তিনি যে জনৈক মুসলমান ব্যক্তিকে হজরত বাবা জুন্নুন মিসরির মাজারে গিয়ে চাইবার কথাটি বলেছেন,উহাকে ওহাবি ফেরকার অনুসারী আলেম-উলামারা বিভিন্ন বিদ্রুপের ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। ওহাবি আলেম-উলামাদের জানা নেই যে আল াহ পাক জিন এবং মানুষের নিকটেই জাতরূপে অবস্থান করেন।
আল াহ্র এই জাতরূপটি যখন কোনো ওলি নির্জনে বছরের পর বছর ধ্যানসাধনা করে উদ্ভাসিত করেন, তথা আল াহ্র জাত নুর নিজের ভিতরে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন জুন্নুন মিসরির কাছে চাওয়া আর আল াহ্র কাছে চাওয়া একই কথা। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি তাই বলে গেছেন যে, আল াহ্র কার্যকলাপ আল াহ নিজেই করে যাচ্ছেন, কিন্তু মনে হয়
মানুষই করছে।
যারা রুহকে নুরানি মাখলুক বলে তথা নুরময় সৃষ্টি বলে জানতে চায়, বুঝতে চায় তারা এই ওলিদের রহস্যের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারে না এবং বুঝতে পারে না। কারণ রুহ সৃষ্টি নয় তথা মাখলুক নয়। এদেরকে হাজার দলিল-প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেও বুঝতে পারে না। যেমনÑ হাজার দলিল দিয়েও একটি শিয়া ফেরকার মুসলমানকে সুন্নি ফেরকায় নিয়ে আসা যায় না। ইহাই হলো জন্মই আমার আজন্ম তকদির। সুতরাং এই তকদির নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদেরই বা কী দোষ দেব?
বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী লেখক জর্জ বার্নার্ড শ একটি কথা বার বার বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন এই বলে যে, ‘যাদের আল াহ আকাশে থাকে তাদের থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা ক'রো, কারণ এরা নিষ্ঠুর এবং ভয়ঙ্কর। এরা যে কোনো নিষ্ঠুর কাজ করতে দ্বিধা বোধ করবে না।'
রুহকে সৃষ্টির মধ্যে এনে পাঁচ ভাগ করে ফেলে। যেমন : (১) রুহে জামাদি, (২) রুহে নাবাতি, (৩) রুহে হায়ওয়ানি, (৪) রুহে ইনসানি, (৫) রুহে বাতেনি। রুহ কী করে এবং কেমন করে পশুর মাঝে অবস্থান করে ইহা আমার জানা নাই এবং কোরান-এর একটি আয়াতেও রুহে হায়ওয়ানি তথা জানোয়ারের রুহ বলে উলে খ করা হয় নাই। আসলে রুহ এক, অনাদি, নিত্য, অসীম। রুহের কোনো ভাগ হয় না এবং ভাগ করা যায় না। যেমন রক্তের শ্বেত কণিকাকে তথা হোয়াইট ব াড সেলকে ভাগ করা যায় না। অথচ রক্তের লৌহকণিকা তথা রেড ব াড সেলকে অনেক রকম ভাগ করা যায় এবং এই ভাগের মধ্য দিয়েই রোগটি ধরা পড়ে। নফ্স তথা প্রাণকে নফ্স বলাই ভালো। নফ্সের কয়েকটি ভাগ করা যায়, যেমন নফ্সে আম্মারা, নফ্সে লাউয়ামা, নফ্সে মোতমায়েন্না, নফ্সে মুলহেমার এবং নফ্সে ওয়াহেদাতান। অথচ কোনো অবস্থাতেই রুহ তথা পরমাÍাকে ভাগ করা যায় না। রুহের এই রকম পাঁচ প্রকার ভাগগুলো দেখলে অবাক হতে হয়। ফেরেশতা জিবরিলের আরেকটি নাম হলো রুহুল আমিন। ফেরেশতাদেরকে নফ্স ও রুহ তথা জীবাÍা ও পরমাÍার একটিও দেওয়া হয় নি। ফেরেশতারাÑ অনেকটা বোঝাতে গিয়ে রূপক ভাষায় বলতে হচ্ছে যে- ফেরেশতারা হলো নফ্স এবং রুহ ছাড়া এক ধরনের রোবট। রোবট এই জন্য বললাম যে, এরা মানুষের রূপ ধরতে পারে। কিন্তু যতই মানুষের আকৃতি ধারণ করুক না কেন, রুহের রহস্য সবার পক্ষে বোঝালেও বোঝা সম্ভবপর নয়। রুহের রহস্য ধ্যানসাধনার মাধ্যমে পরিচয় হয়। এই রুহের পরিচয়টি আকাশেও পাওয়া যায় না, মাটিতেও পাওয়া যায় না। এই যদি ইসলাম গবেষণার মারভেলাস ফসল হয় তা হলে এদের জ্ঞানের বহরও মারভেলাস। এবং মারভেলাসভাবে সাধারণ মুসলমানদেরকে ঠকানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ মুসলমানেরাও আসল মনে করে ইমিটেশন খরিদ করছে।
ইমাম গাজ্জালির এহিয়ায়ে উলুমউদ্দিন বইটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদক গোলাবি ওহাবি হওয়ার দরুন অনেক কথার অনুবাদ করে নি। সরল পাঠকের পক্ষে এই বিকৃত, মনগড়া এবং বানোয়াট অনুবাদটি ধরবার সম্ভাবনা থাকে না। এই অনুবাদগুলোকে বলা যেতে পারে এহিয়ায়ে কলুমউদ্দিন, এহিয়ায়ে ছলিমউদ্দিন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানী নিউটনের একটি সূত্র হলো : প্রতিটি কাজের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আজাজিল ফেরেশতাদের ইমাম তথা সরদার ছিলেন। এই জন্য আজাজিলকে ইমামে মালাইকা বলা হতো। আল াহ্র একটিমাত্র আদেশ, আদমকে সেজদা করার হুকুমটি,অমান্য করে বলে ফেললো যে আজাজিল আদম হইতে উত্তম। আল াহ্র আদেশ অমান্য করার শাস্তি আল াহ নিজেই দিলেন এবং চারটি নাম দেওয়া হলো। আজাজিলের প্রথম নামটি হলো ইবলিস তথা অহঙ্কারী, তারপর শয়তান তথা যতো আকাম-কুকামের নেতা, তারপর মরদুদ, তারপর খান্নাস। শয়তানের কাজটি হলো আদম সন্তানদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়া এবং জাহান্নামের পথ দেখিয়ে দেওয়া।
শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আদম সন্তানেরা হরহামেশা প্রতারিত হচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু একটি বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়, আর সেই প্রশ্নটি হলো যে, শয়তানের আগে তো কোনো শয়তানই ছিলো না, তাহা হইলে আজাজিলকে কে শিখিয়ে দিলো যে সে আদম হইতে উত্তম? এই প্রশ্নের উত্তরটি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেলাম। কেননা যা কিছুই আল াহ করেছেন তার মূল উদ্দেশ্যটি হলো আদম সন্তানদেরকে পরীক্ষা করা। তাই আমরা দেখতে পাই যে আল াহ এক নিমেষেই পৃথিবীর সব মানুষকে এক উম্মতে পরিণত করতে পারতেন, কিন্তু এটাই যদি করা হতো তা হলে পরীক্ষা নামক শব্দটির আর এক পয়সাও মূল্য থাকে না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) যতোগুলো হাদিস প্রকাশিত করেছেন তার চেয়ে গোপন রাখার রহস্যময় হাদিসগুলো মোটেই কম ছিলো না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত আবু জর গিফারি (রা.) এবং হজরত হুজায়ফা (রা.)-এর বেলায়ও একই কথা কমবেশি খাটে। তাই দেখা যায়, পৃথিবীর বিখ্যাত ওলি-আল াহদের লিখনির রহস্য বুঝতে না পেরে যা-তা গালাগালি করে। ওহাবি আলেম-উলামারা নিজেদের মন মতো মাপতে চায় এবং মাপতে গেলেই বিরাট বিরাট ভুল করে বসে, অথচ দোষটি চাপিয়ে দেয় আল াহ্র ওলিদের উপর।
তাই গাউসুল আজম, ইবনুল আরাবি, আহমদ রেফাই, জালাল উদ্দিন রুমি এবং ইমাম গাজ্জালিকে ‘খামসায়ে কাফেরে আকবর' তথা পাঁচ শ্রেষ্ঠ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছে।
বোড়া সাপ বেদের বীণের সুরে নাচতে পারে না, তাই জাতি সাপদের নাচানাচিটা দেখে বোড়া সাপেরা হি হি করে হাসে আর ‘ভণ্ডামি করছে' বলে অপবাদ দেয়। আমরা বোড়া সাপেরও দোষ দেখতে পাচ্ছি না, কারণ বোড়া সাপের তকদিরে নৃত্য করার কথাটি লিখা নাই।
সুতরাং জাতি সাপের নৃত্য দেখে অবাক হবারই তো কথা। তা হলে চরম পর্যায়ে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় যে, আল াহ পাকের সৃষ্টিতে কোথাও বিন্দুমাত্র ভুল নাই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সৃষ্টিরাজ্যের রহস্য দেখতে গিয়ে ভুল পাওয়া তো দূরের কথা, বরং চোখ বিস্ফারিত হয়ে নিজের কাছেই ফেরত আসে।
মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করা নিউট্রন তারকাটির এক চায়ের চামচ বস্তু পৃথিবীতে এনে মাপতে গেলে ওজনটি দাঁড়ায় একশত কোটি টন। বিজ্ঞানীরা থতমত খেয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা চিৎকার দিয়ে বলতে চায় : আল াহ পাক,
তোমার সৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র ভুল পাওয়া তো দূরের কথা, বরং চোখ, জ্ঞান বিস্ফারিত হয়ে নিজেদের কাছেই ফেরত আসে। কোরান-এর সুরা মূলক-টি পড়ে দেখুন তো, অধম লিখকের এই কথাগুলো কতোটা সত্যতা বহন করে!
অথচ এই নিউট্রন তারার ভেতরে যা কিছু আছে এবং যত শক্তিশালী হোক না কেন এবং যত অদ্ভুত এবং বিস্ময়করই হোক না কেন,সবই কিন্তু আল াহ্র সেফাত মাত্র অথবা সেফাতের সেফাত এভাবে অনেক বিবর্তনের কর্মফল মাত্র। এই বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো আমাদের চমকায়, আমাদেরকে অবাক করে, আমাদেরকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। কিন্তু এই বিজ্ঞানের সম্ভবত কোনোই ক্ষমতা নেই আল াহকে দর্শন দেবার জন্য। কারণ যদিও সেফাতগুলো আল াহ পাক হতেই আগত, কিন্তু সেফাত জাত নয়। আল াহ্র জাতরূপটি মানুষের ভেতরেই রুহরূপে অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে বিরাজ করছে।
এই বীজরূপ রুহকে যিনি বা যাঁরা যতটুকু জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন প্রকারভেদে তাঁরা সে রকমই ওলি। যদিও একই আলো অনেক মোমবাতিতে শোভা পাচ্ছে, কিন্তু মোমবাতির আয়তন যত বড় হবে আলোও তত বেশি দেখা যাবে। আলো বেশি দেখা যাওয়া এবং কম দেখা যাওয়ার মধ্যে বাহিরের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারা যায় যে, একই আলো বড় এবং ছোট
মোমবাতিতে অবস্থান করছে। সুতরাং আল াহ্র সমগ্র সৃষ্টিরাজ্যের মধ্যে কেবলমাত্র জিন এবং মানুষের সঙ্গেই আল াহ্র জাতরূপে অবস্থান করার কথাটি কোরান-এ অন্যভাবেও বলা হয়েছে, যেমন : ‘আমরা তোমাদের শাহারগের (তথা জীবনরগের) নিকটেই আছি।' একটু লক্ষ করে দেখুন তো, কোনো জীবজন্তু, কোনো নদী-নালা-সাগর, কোনো পাহাড়-পর্বত, কোনো গ্রহ-নক্ষত্রÑ কোথাও ‘তোমাদের শাহারগের নিকটেই আছি' বলে একটি বারও কোরান-এ বলা হয় নি।
ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করা নিউট্রন তারাটির এক চায়ের চামচ উপাদান পৃথিবী গ্রহে মাপতে গেলে ওজন হয় একশত কোটি টন। এক চামচ উপাদানের ওজন একশত কোটি টন! কে না অবাক হবে? কে না বিস্ময় প্রকাশ করবে? কিন্তু এই অবাক বিস্ময় আল াহ্র অবস্থানটির কথা জানিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু নিজের ভেতরেই যে আল াহ রুহরূপে বিরাজ করছে এবং পনেরটি বছর নির্জনে ধ্যানসাধনার মাধ্যমে যে আল াহ্র পরিচয় জানা যাবে, ইহা মহানবি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন এবং বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, তোমরাও আমার মতো পনের বছর যদি ধ্যানসাধনায় মগ্ন হতে পারো তো আল াহ্র জাতরূপ তোমারই মাঝে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। সত্যি বলতে কি এই জাতরূপটি যখন সাধকের মধ্যে প্রকাশিত এবং বিকশিত হয়ে ওঠে সেই বিকশিত রূপটির নাম রুহুল আমিন। যদিও জিবরাইল নামক ফেরেশতার নামও রুহুল আমিন। আমরা সবাই একটু লক্ষ করলেই জানতে পারি যে কোনো ফেরেশতাকেই, এমনকি সে যত বড় ফেরেশতাই হোক না কেন, সেই ফেরেশতাকে নফ্সও দেওয়া হয় নি, রুহও দেওয়া হয় নি। এককথায় সমস্ত ফেরেশতারা হলো নফ্স-ও রুহ-বর্জিত ফেরেশতা।
নফ্স ও রুহের অবস্থান যেহেতু জিন ও মানুষের মধ্যে, তাই জিন ও মানুষের মাঝেই ভালো এবং মন্দ উভয়টাই দেখতে পাই।
ফেরেশতাদের মাঝে নফ্সও নাই রুহও নাই, সুতরাং ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও নাইÑ যদিও আল াহ্র শেখানো কিছু কথা, কিছুপ্রশ্ন, কিছু জিজ্ঞাসা আমরা দেখতে পাই। আসলে আল াহ্র সমস্ত ফেরেশতারা হলো আল াহ্র রহমতের চাবি দেওয়া রহমতের রোবট (?)।
এই প্রভেদটুকু যদি কোনো ধর্ম-গবেষক, যদি কোনো পীর-ফকির, যদি কোনো আলেম-উলামা বুঝতে না পারে তা হলে তাদেরই বাকী দোষ দেব? কারণ সব খেলাই যে তকদিরের খেলা।
অনেক সময় কিছুটা গালাগালি মনের অজান্তে যে করি না তা নয়। কিন্তু চরম পর্যায়ে আর কোনো গালি থাকে না। তাই বড় বড়আল াহ্র ওলিদের কথায় আমরা দেখতে পাই যে, মহাপাপীকেও গালি না দিয়ে আল াহ্র হাতে ছেড়ে দেবার কথাটি বলেছেন।আল াহ্র পূর্ণ পরিচয় যখন কোনো সাধক আপনার ভেতর দেখতে পান তখন আপন নফ্সটি এমনভাবে হারিয়ে যায় যে খুঁজতেও কষ্ট হয়। আগুনের তাপে কালো লোহা গরম হতে হতে যখন জলের মতো তরল হয় তখন কালো লোহাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবলতরল আগুনই দেখতে পাওয়া যায়। তখনই মনসুর হাল াজ বলে ফেলেন : ‘আনাল হক', তখনই জুনায়েদ বোগদাদি বলে ফেলেন : ‘লাইসা ফি জুব্বাতি সেওয়া আল াহ তায়ালা', তখনই সুলতানুল হিন্দ হাজা হাবিব ুল াহ মাতা ফি হুব্বুল াহ শাহেনশাহে ওলি আফতাবে ওলি হিন্দালওলি আতায়ে রসুল সৈয়দ মাওলানা মঈনুদ্দীন হাসান সানজারি বলে ফেলেন : ‘ইমানাম ইয়ারাম কি আনদার নুরে হক ফানি সুদাম,মাতলায়ে আনোয়ারে জাতে সুবহানি সুদাম', তখনই খাজা উসমান হারুনি, যিনি খাজা বাবার পীর, তিনি বলে ফেলেন : ‘চু জুমলা ফানা গাসতে বতু হে চুনা মুনদাহ খাহে কে আনাল াহে বগু খাহে কে হুয়াল াহ।' ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি ধ্যানসাধনার মাধ্যমে মোকামে জাবরুতের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আল াহকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন : ‘আল াহ আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।' উত্তরে আল াহ
বললেন : ‘প্রকৃত সন্তুষ্টির বাক্যটি অন্যরকম। সুতরাং আরও কিছু দিন ধ্যানসাধনা করো, তা হলেই আসল সন্তুষ্টির বাক্যটি তোমার মুখে শোভা পাবে।' ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি আবার কঠোর ধ্যানসাধনায় নিমগ্ন হলেন। সাধনার একটি চরম পর্যায়ে এসে ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি বলে ফেললেন : ‘আনা সুবহানি' তথা আমিই সুবহানি, ‘মা আজিমুশ্ শানি' তথা সব শান আমারই। আজ হতে প্রায় আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে জমদগ্নি মুনি বলে ফেললেন : ‘সোহহম সোহ্মি'Ñ তিনিই আমি। ভগবান শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব সাধনার এক পর্যায়ে বলে ফেললেন : ‘তুই মুই, মুই তুই।'
যেহেতু এই অতি উচ্চ স্তরের কথাগুলো সাধারণের পক্ষে বোঝাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় তাই না বুঝে কিছু একটা বলে ফেললে তাকেই বা কী দোষ দেব?
চেরাগে জান শরীফ
ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল-সুরেশ্বরী
ইসলামি জ্ঞানের সমুদ্র বলে যাঁকে সবাই একবাক্যে মেনে নেন সেই বিশ্ববিখ্যাত হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালির এহিয়ায়ে উলুমউদ্দিন নামক বিশাল কেতাবের একস্থানে তিনি যে জনৈক মুসলমান ব্যক্তিকে হজরত বাবা জুন্নুন মিসরির মাজারে গিয়ে চাইবার কথাটি বলেছেন,উহাকে ওহাবি ফেরকার অনুসারী আলেম-উলামারা বিভিন্ন বিদ্রুপের ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। ওহাবি আলেম-উলামাদের জানা নেই যে আল াহ পাক জিন এবং মানুষের নিকটেই জাতরূপে অবস্থান করেন।
আল াহ্র এই জাতরূপটি যখন কোনো ওলি নির্জনে বছরের পর বছর ধ্যানসাধনা করে উদ্ভাসিত করেন, তথা আল াহ্র জাত নুর নিজের ভিতরে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তখন জুন্নুন মিসরির কাছে চাওয়া আর আল াহ্র কাছে চাওয়া একই কথা। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি তাই বলে গেছেন যে, আল াহ্র কার্যকলাপ আল াহ নিজেই করে যাচ্ছেন, কিন্তু মনে হয়
মানুষই করছে।
যারা রুহকে নুরানি মাখলুক বলে তথা নুরময় সৃষ্টি বলে জানতে চায়, বুঝতে চায় তারা এই ওলিদের রহস্যের বিন্দুবিসর্গও জানতে পারে না এবং বুঝতে পারে না। কারণ রুহ সৃষ্টি নয় তথা মাখলুক নয়। এদেরকে হাজার দলিল-প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেও বুঝতে পারে না। যেমনÑ হাজার দলিল দিয়েও একটি শিয়া ফেরকার মুসলমানকে সুন্নি ফেরকায় নিয়ে আসা যায় না। ইহাই হলো জন্মই আমার আজন্ম তকদির। সুতরাং এই তকদির নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদেরই বা কী দোষ দেব?
বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী লেখক জর্জ বার্নার্ড শ একটি কথা বার বার বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন এই বলে যে, ‘যাদের আল াহ আকাশে থাকে তাদের থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা ক'রো, কারণ এরা নিষ্ঠুর এবং ভয়ঙ্কর। এরা যে কোনো নিষ্ঠুর কাজ করতে দ্বিধা বোধ করবে না।'
রুহকে সৃষ্টির মধ্যে এনে পাঁচ ভাগ করে ফেলে। যেমন : (১) রুহে জামাদি, (২) রুহে নাবাতি, (৩) রুহে হায়ওয়ানি, (৪) রুহে ইনসানি, (৫) রুহে বাতেনি। রুহ কী করে এবং কেমন করে পশুর মাঝে অবস্থান করে ইহা আমার জানা নাই এবং কোরান-এর একটি আয়াতেও রুহে হায়ওয়ানি তথা জানোয়ারের রুহ বলে উলে খ করা হয় নাই। আসলে রুহ এক, অনাদি, নিত্য, অসীম। রুহের কোনো ভাগ হয় না এবং ভাগ করা যায় না। যেমন রক্তের শ্বেত কণিকাকে তথা হোয়াইট ব াড সেলকে ভাগ করা যায় না। অথচ রক্তের লৌহকণিকা তথা রেড ব াড সেলকে অনেক রকম ভাগ করা যায় এবং এই ভাগের মধ্য দিয়েই রোগটি ধরা পড়ে। নফ্স তথা প্রাণকে নফ্স বলাই ভালো। নফ্সের কয়েকটি ভাগ করা যায়, যেমন নফ্সে আম্মারা, নফ্সে লাউয়ামা, নফ্সে মোতমায়েন্না, নফ্সে মুলহেমার এবং নফ্সে ওয়াহেদাতান। অথচ কোনো অবস্থাতেই রুহ তথা পরমাÍাকে ভাগ করা যায় না। রুহের এই রকম পাঁচ প্রকার ভাগগুলো দেখলে অবাক হতে হয়। ফেরেশতা জিবরিলের আরেকটি নাম হলো রুহুল আমিন। ফেরেশতাদেরকে নফ্স ও রুহ তথা জীবাÍা ও পরমাÍার একটিও দেওয়া হয় নি। ফেরেশতারাÑ অনেকটা বোঝাতে গিয়ে রূপক ভাষায় বলতে হচ্ছে যে- ফেরেশতারা হলো নফ্স এবং রুহ ছাড়া এক ধরনের রোবট। রোবট এই জন্য বললাম যে, এরা মানুষের রূপ ধরতে পারে। কিন্তু যতই মানুষের আকৃতি ধারণ করুক না কেন, রুহের রহস্য সবার পক্ষে বোঝালেও বোঝা সম্ভবপর নয়। রুহের রহস্য ধ্যানসাধনার মাধ্যমে পরিচয় হয়। এই রুহের পরিচয়টি আকাশেও পাওয়া যায় না, মাটিতেও পাওয়া যায় না। এই যদি ইসলাম গবেষণার মারভেলাস ফসল হয় তা হলে এদের জ্ঞানের বহরও মারভেলাস। এবং মারভেলাসভাবে সাধারণ মুসলমানদেরকে ঠকানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ মুসলমানেরাও আসল মনে করে ইমিটেশন খরিদ করছে।
ইমাম গাজ্জালির এহিয়ায়ে উলুমউদ্দিন বইটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদক গোলাবি ওহাবি হওয়ার দরুন অনেক কথার অনুবাদ করে নি। সরল পাঠকের পক্ষে এই বিকৃত, মনগড়া এবং বানোয়াট অনুবাদটি ধরবার সম্ভাবনা থাকে না। এই অনুবাদগুলোকে বলা যেতে পারে এহিয়ায়ে কলুমউদ্দিন, এহিয়ায়ে ছলিমউদ্দিন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানী নিউটনের একটি সূত্র হলো : প্রতিটি কাজের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আজাজিল ফেরেশতাদের ইমাম তথা সরদার ছিলেন। এই জন্য আজাজিলকে ইমামে মালাইকা বলা হতো। আল াহ্র একটিমাত্র আদেশ, আদমকে সেজদা করার হুকুমটি,অমান্য করে বলে ফেললো যে আজাজিল আদম হইতে উত্তম। আল াহ্র আদেশ অমান্য করার শাস্তি আল াহ নিজেই দিলেন এবং চারটি নাম দেওয়া হলো। আজাজিলের প্রথম নামটি হলো ইবলিস তথা অহঙ্কারী, তারপর শয়তান তথা যতো আকাম-কুকামের নেতা, তারপর মরদুদ, তারপর খান্নাস। শয়তানের কাজটি হলো আদম সন্তানদেরকে বিপথে নিয়ে যাওয়া এবং জাহান্নামের পথ দেখিয়ে দেওয়া।
শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আদম সন্তানেরা হরহামেশা প্রতারিত হচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু একটি বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়, আর সেই প্রশ্নটি হলো যে, শয়তানের আগে তো কোনো শয়তানই ছিলো না, তাহা হইলে আজাজিলকে কে শিখিয়ে দিলো যে সে আদম হইতে উত্তম? এই প্রশ্নের উত্তরটি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেলাম। কেননা যা কিছুই আল াহ করেছেন তার মূল উদ্দেশ্যটি হলো আদম সন্তানদেরকে পরীক্ষা করা। তাই আমরা দেখতে পাই যে আল াহ এক নিমেষেই পৃথিবীর সব মানুষকে এক উম্মতে পরিণত করতে পারতেন, কিন্তু এটাই যদি করা হতো তা হলে পরীক্ষা নামক শব্দটির আর এক পয়সাও মূল্য থাকে না।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) যতোগুলো হাদিস প্রকাশিত করেছেন তার চেয়ে গোপন রাখার রহস্যময় হাদিসগুলো মোটেই কম ছিলো না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত আবু জর গিফারি (রা.) এবং হজরত হুজায়ফা (রা.)-এর বেলায়ও একই কথা কমবেশি খাটে। তাই দেখা যায়, পৃথিবীর বিখ্যাত ওলি-আল াহদের লিখনির রহস্য বুঝতে না পেরে যা-তা গালাগালি করে। ওহাবি আলেম-উলামারা নিজেদের মন মতো মাপতে চায় এবং মাপতে গেলেই বিরাট বিরাট ভুল করে বসে, অথচ দোষটি চাপিয়ে দেয় আল াহ্র ওলিদের উপর।
তাই গাউসুল আজম, ইবনুল আরাবি, আহমদ রেফাই, জালাল উদ্দিন রুমি এবং ইমাম গাজ্জালিকে ‘খামসায়ে কাফেরে আকবর' তথা পাঁচ শ্রেষ্ঠ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছে।
বোড়া সাপ বেদের বীণের সুরে নাচতে পারে না, তাই জাতি সাপদের নাচানাচিটা দেখে বোড়া সাপেরা হি হি করে হাসে আর ‘ভণ্ডামি করছে' বলে অপবাদ দেয়। আমরা বোড়া সাপেরও দোষ দেখতে পাচ্ছি না, কারণ বোড়া সাপের তকদিরে নৃত্য করার কথাটি লিখা নাই।
সুতরাং জাতি সাপের নৃত্য দেখে অবাক হবারই তো কথা। তা হলে চরম পর্যায়ে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় যে, আল াহ পাকের সৃষ্টিতে কোথাও বিন্দুমাত্র ভুল নাই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সৃষ্টিরাজ্যের রহস্য দেখতে গিয়ে ভুল পাওয়া তো দূরের কথা, বরং চোখ বিস্ফারিত হয়ে নিজের কাছেই ফেরত আসে।
মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করা নিউট্রন তারকাটির এক চায়ের চামচ বস্তু পৃথিবীতে এনে মাপতে গেলে ওজনটি দাঁড়ায় একশত কোটি টন। বিজ্ঞানীরা থতমত খেয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা চিৎকার দিয়ে বলতে চায় : আল াহ পাক,
তোমার সৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র ভুল পাওয়া তো দূরের কথা, বরং চোখ, জ্ঞান বিস্ফারিত হয়ে নিজেদের কাছেই ফেরত আসে। কোরান-এর সুরা মূলক-টি পড়ে দেখুন তো, অধম লিখকের এই কথাগুলো কতোটা সত্যতা বহন করে!
অথচ এই নিউট্রন তারার ভেতরে যা কিছু আছে এবং যত শক্তিশালী হোক না কেন এবং যত অদ্ভুত এবং বিস্ময়করই হোক না কেন,সবই কিন্তু আল াহ্র সেফাত মাত্র অথবা সেফাতের সেফাত এভাবে অনেক বিবর্তনের কর্মফল মাত্র। এই বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো আমাদের চমকায়, আমাদেরকে অবাক করে, আমাদেরকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। কিন্তু এই বিজ্ঞানের সম্ভবত কোনোই ক্ষমতা নেই আল াহকে দর্শন দেবার জন্য। কারণ যদিও সেফাতগুলো আল াহ পাক হতেই আগত, কিন্তু সেফাত জাত নয়। আল াহ্র জাতরূপটি মানুষের ভেতরেই রুহরূপে অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে বিরাজ করছে।
এই বীজরূপ রুহকে যিনি বা যাঁরা যতটুকু জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন প্রকারভেদে তাঁরা সে রকমই ওলি। যদিও একই আলো অনেক মোমবাতিতে শোভা পাচ্ছে, কিন্তু মোমবাতির আয়তন যত বড় হবে আলোও তত বেশি দেখা যাবে। আলো বেশি দেখা যাওয়া এবং কম দেখা যাওয়ার মধ্যে বাহিরের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারা যায় যে, একই আলো বড় এবং ছোট
মোমবাতিতে অবস্থান করছে। সুতরাং আল াহ্র সমগ্র সৃষ্টিরাজ্যের মধ্যে কেবলমাত্র জিন এবং মানুষের সঙ্গেই আল াহ্র জাতরূপে অবস্থান করার কথাটি কোরান-এ অন্যভাবেও বলা হয়েছে, যেমন : ‘আমরা তোমাদের শাহারগের (তথা জীবনরগের) নিকটেই আছি।' একটু লক্ষ করে দেখুন তো, কোনো জীবজন্তু, কোনো নদী-নালা-সাগর, কোনো পাহাড়-পর্বত, কোনো গ্রহ-নক্ষত্রÑ কোথাও ‘তোমাদের শাহারগের নিকটেই আছি' বলে একটি বারও কোরান-এ বলা হয় নি।
ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করা নিউট্রন তারাটির এক চায়ের চামচ উপাদান পৃথিবী গ্রহে মাপতে গেলে ওজন হয় একশত কোটি টন। এক চামচ উপাদানের ওজন একশত কোটি টন! কে না অবাক হবে? কে না বিস্ময় প্রকাশ করবে? কিন্তু এই অবাক বিস্ময় আল াহ্র অবস্থানটির কথা জানিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু নিজের ভেতরেই যে আল াহ রুহরূপে বিরাজ করছে এবং পনেরটি বছর নির্জনে ধ্যানসাধনার মাধ্যমে যে আল াহ্র পরিচয় জানা যাবে, ইহা মহানবি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন এবং বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, তোমরাও আমার মতো পনের বছর যদি ধ্যানসাধনায় মগ্ন হতে পারো তো আল াহ্র জাতরূপ তোমারই মাঝে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। সত্যি বলতে কি এই জাতরূপটি যখন সাধকের মধ্যে প্রকাশিত এবং বিকশিত হয়ে ওঠে সেই বিকশিত রূপটির নাম রুহুল আমিন। যদিও জিবরাইল নামক ফেরেশতার নামও রুহুল আমিন। আমরা সবাই একটু লক্ষ করলেই জানতে পারি যে কোনো ফেরেশতাকেই, এমনকি সে যত বড় ফেরেশতাই হোক না কেন, সেই ফেরেশতাকে নফ্সও দেওয়া হয় নি, রুহও দেওয়া হয় নি। এককথায় সমস্ত ফেরেশতারা হলো নফ্স-ও রুহ-বর্জিত ফেরেশতা।
নফ্স ও রুহের অবস্থান যেহেতু জিন ও মানুষের মধ্যে, তাই জিন ও মানুষের মাঝেই ভালো এবং মন্দ উভয়টাই দেখতে পাই।
ফেরেশতাদের মাঝে নফ্সও নাই রুহও নাই, সুতরাং ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও নাইÑ যদিও আল াহ্র শেখানো কিছু কথা, কিছুপ্রশ্ন, কিছু জিজ্ঞাসা আমরা দেখতে পাই। আসলে আল াহ্র সমস্ত ফেরেশতারা হলো আল াহ্র রহমতের চাবি দেওয়া রহমতের রোবট (?)।
এই প্রভেদটুকু যদি কোনো ধর্ম-গবেষক, যদি কোনো পীর-ফকির, যদি কোনো আলেম-উলামা বুঝতে না পারে তা হলে তাদেরই বাকী দোষ দেব? কারণ সব খেলাই যে তকদিরের খেলা।
অনেক সময় কিছুটা গালাগালি মনের অজান্তে যে করি না তা নয়। কিন্তু চরম পর্যায়ে আর কোনো গালি থাকে না। তাই বড় বড়আল াহ্র ওলিদের কথায় আমরা দেখতে পাই যে, মহাপাপীকেও গালি না দিয়ে আল াহ্র হাতে ছেড়ে দেবার কথাটি বলেছেন।আল াহ্র পূর্ণ পরিচয় যখন কোনো সাধক আপনার ভেতর দেখতে পান তখন আপন নফ্সটি এমনভাবে হারিয়ে যায় যে খুঁজতেও কষ্ট হয়। আগুনের তাপে কালো লোহা গরম হতে হতে যখন জলের মতো তরল হয় তখন কালো লোহাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবলতরল আগুনই দেখতে পাওয়া যায়। তখনই মনসুর হাল াজ বলে ফেলেন : ‘আনাল হক', তখনই জুনায়েদ বোগদাদি বলে ফেলেন : ‘লাইসা ফি জুব্বাতি সেওয়া আল াহ তায়ালা', তখনই সুলতানুল হিন্দ হাজা হাবিব ুল াহ মাতা ফি হুব্বুল াহ শাহেনশাহে ওলি আফতাবে ওলি হিন্দালওলি আতায়ে রসুল সৈয়দ মাওলানা মঈনুদ্দীন হাসান সানজারি বলে ফেলেন : ‘ইমানাম ইয়ারাম কি আনদার নুরে হক ফানি সুদাম,মাতলায়ে আনোয়ারে জাতে সুবহানি সুদাম', তখনই খাজা উসমান হারুনি, যিনি খাজা বাবার পীর, তিনি বলে ফেলেন : ‘চু জুমলা ফানা গাসতে বতু হে চুনা মুনদাহ খাহে কে আনাল াহে বগু খাহে কে হুয়াল াহ।' ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি ধ্যানসাধনার মাধ্যমে মোকামে জাবরুতের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আল াহকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন : ‘আল াহ আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।' উত্তরে আল াহ
বললেন : ‘প্রকৃত সন্তুষ্টির বাক্যটি অন্যরকম। সুতরাং আরও কিছু দিন ধ্যানসাধনা করো, তা হলেই আসল সন্তুষ্টির বাক্যটি তোমার মুখে শোভা পাবে।' ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি আবার কঠোর ধ্যানসাধনায় নিমগ্ন হলেন। সাধনার একটি চরম পর্যায়ে এসে ইমামুল আউলিয়া বায়েজিদ বোস্তামি বলে ফেললেন : ‘আনা সুবহানি' তথা আমিই সুবহানি, ‘মা আজিমুশ্ শানি' তথা সব শান আমারই। আজ হতে প্রায় আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে জমদগ্নি মুনি বলে ফেললেন : ‘সোহহম সোহ্মি'Ñ তিনিই আমি। ভগবান শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব সাধনার এক পর্যায়ে বলে ফেললেন : ‘তুই মুই, মুই তুই।'
যেহেতু এই অতি উচ্চ স্তরের কথাগুলো সাধারণের পক্ষে বোঝাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় তাই না বুঝে কিছু একটা বলে ফেললে তাকেই বা কী দোষ দেব?
চেরাগে জান শরীফ
ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল-সুরেশ্বরী
No comments:
Post a Comment