Monday, December 7, 2015

মা খাদীজা (রাঃ)


মা খাদীজা (রাঃ) ছিলেন নবী সহধর্মিণীদের মধ্যে সর্বপ্রথমা ও সর্বশ্রেষ্ঠা, জান্নাতী মহিলাদের প্রধান হযরত ফাতিমাতুয যাহ্‌রার মহীয়সী মাতানবী মুহাম্মাদ (সা:)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এই মহীয়সী নারী সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেনতিনিই একমাত্র মহিলা যাঁকে দুনিয়া থেকেই জান্নাতের খোশ খবর জ্ঞাপন করা হয়েছিলজাহেলী যুগের কোন প্রকার অন্যায় বা পাপ তাকে স্পর্শ করেনি বিধায় বাল্যকালেই তিনি তাহেরা বা পবিত্রাউপাধিতে ভূষিতা হয়েছিলেন এবং এই নামেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন পরিচিতা ও খ্যাতনামারূপে-গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়সতী-সাধ্বী ও পতিব্রতা এই বিদুষী মহিলার গুণাবলী বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে বহু সংখ্যক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে


জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

 

হস্তী বর্ষের ১৫ বছর পূর্বে ৫৫৫ খৃষ্টাব্দে হযরত খাদীজা (রাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেনতাঁর কুনিয়াত উম্মে হিন্‌দ ও লকব ছিল ত্বাহেরাহপিতা ছিলেন খুওয়ালিদ বিন আসাদ বিন আব্দুল উয্‌বা বিন কুছাইতিনি কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন না বরং তার বিশ্বস্ততা, গাম্ভীর্য, সাহস আর দূরদর্শিতার কারণে সমগ্র কুরাইশের মধ্যে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রীমাতা ফাতিমা বিনতে যায়েদা আমের বিন লুআইএর বংশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেনতার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় নাতবে তিনি যে বহু গুণ সম্পন্না ছিলেন, তার কন্যা খাদীজার (রাঃ) অনন্য সাধারণ গুণবত্তা থেকে তা অনুমান করা যায়

 

শৈশব ও প্রাথমিক জীবনঃ

 

তৎকালীন প্রতিকুল পরিবেশে লেখা পড়ার কোন সুযোগ না পেলেও শৈশব কাল থেকেই হযরত খাদীজা (রাঃ) বুদ্ধিমতী ও নেকবখ্‌ত ছিলেনএজন্যই হয়তবা আরব সমাজের অন্যান্য পরিবারে যখন নারীর স্থান ছিল একেবারেই নিম্নে, খুওয়াইলিদ পরিবারে খাদীজার (রাঃ) স্থান ছিল তখন অতি উচ্চে

 

বিবাহঃ

 

রাসূলুল্লাহ্‌র (সা:) সঙ্গে বিয়ের আগে বিবি খাদীজার (রাঃ) দুবার বিয়ে সম্পন্ন হয়তাঁর প্রথম স্বামীর নাম আবু হালাহ হিন্‌দ বিন নাবাশ তামীমীআবু হালাহ্‌র ঔরসে তাঁর দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করেপ্রথম পুত্রের নাম হালাহ- যিনি জাহেলী যুগেই মৃত্যুবরণ করেনদ্বিতীয় পুত্রের নাম হিন্‌দ যিনি ছাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলে কোন কোন রেওয়ায়াতে পাওয়া যায়

 

আবু হালাহ্‌র ইন্তিকালের পর আতীক বিন আবেদ মাখযূমীর সাথে দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হনকিছুদিনের মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও মারা যানআর রেখে যান অগাধ ধন-সম্পদএর পর কিছুদিন তিনি একাকী থাকেনইতিমধ্যে দেশের অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বিয়ের পয়গাম পেয়েও সকল প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেনএ অবস্থায় তিনি কখনও কাবা গৃহে অতিবাহিত করেন, কখনও সমকালীন মহিলা গণকদের সাথে ব্যয় করে, কখনওবা তাদের সাথে তৎকালীন বিবিধ বিষয়ে আলোচনা করে সময় কাটাতেন।[1]

 

ব্যবসা-বাণিজ্যঃ

 

বার্ধক্যের কারণে এবং কোন পুত্র সন্তান না থাকায় খাদীজার (রাঃ) পিতা তাঁর সমস্ত ব্যবসায়িক দায়-দায়িত্ব কন্যার হাতে সোপর্দ করেন এবং চাচা আমর বিন আসাদের উপর তাঁর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব অর্পণ করে কিছুদিনের মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করেন

 

পিতা ও দ্বিতীয় স্বামীর অর্পিত ব্যবসায়িক দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করতে থাকেনএকদিকে সিরিয়া অন্যদিকে ইয়ামন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট ব্যবসা পরিচালনার জন্য তাঁর আরব, ইহুদী, খৃষ্টানসহ বহু কর্মচারী ও গোলাম ছিলএ সময় তিনি এমন একজন যোগ্য মানুষ খুঁজছিলেন, যার হাতে ব্যবসার সকল দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেনইবনে ইসহাক হতে বর্ণিত আছে যে, যখন বিবি খাদীজা রাসূলুল্লাহ (সা:)এর সত্যবাদিতা, উত্তম চরিত্র, সদাচার এবং আমানতদারী সম্পর্কে অবগত হলেন, তখন তিনি হযরতের (সা:) নিকট এক প্রস্তাব পেশ করলেন যে, তিনি তাঁর অর্থ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁর দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করতে পারেনতিনি স্বীকৃতিও প্রদান করেন যে, অন্যান্য ব্যবসায়ীগণকে যে হারে মুনাফা প্রদান করা হয়, তাঁকে তার চাইতে অধিক মাত্রায় মুনাফা প্রদান করা হবেহযরত (সা:) এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং তার অর্থ-সম্পদ নিয়ে দাস মায়সারার সঙ্গে শাম দেশে গমন করলেন।[2]

 

রাসূলের (সা:) সাথে বিবাহঃ

 

সিরিয়া থেকে যুবক নবীর (সা:) প্রত্যাবর্তনের পর হিসাব-নিকাশ করে আমানত সহ এত বেশী পরিমাণ অর্থ তিনি পেলেন, যা ইতিপূর্বে কোন দিনই পাননিঅধিকন্তু দাস মায়সারার কথাবার্তা থেকে হযরতের (সা:) মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, উন্নত চিন্তা-ভাবনা, আমানতদারী ইত্যাদি বিষয় অবগত হওয়ার পর তিনি এত বেশী প্রভাবান্বিত হন যে, নিজের দাসী নাফীসা বিনতে মুনাব্বিহ-এর মাধ্যমে হুযুরের (সা:) নিকট সরাসরি বিয়ের পয়গাম পাঠানরাসূলুল্লাহ (সা:) বিষয়টি পিতৃব্য আবু তালিবের সাথে আলোচনা করেনআবু তালিব এ ব্যাপারে হযরত খাদীজার (রাঃ) পিতৃব্যের সাথে আলোচনার পর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেনএক শুভক্ষণে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহপ্রাপ্ত দুই বান্দা ও বান্দী পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যানএই বিয়ের মোহরানা ছিল ২০টি উটএ সময় বিবি খাদীজার বয়স ছিল ৪০ বছর আর রাসূলুল্লাহ্‌র (সা:) বয়স ছিল ২৫ বছরখাদীজার (রাঃ) জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ্ (সা:) অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করেননি।[3]

 

সন্তান-সন্ততিঃ

 

রাসূলুল্লাহ (সা:)এর সন্তানদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ইবরাহীম ব্যতীত অন্যান্য সকলেই ছিলেন হযরত খাদীজার (রাঃ) গর্ভজাতনবী দম্পতির প্রথম সন্তান ছিলেন কাসেমঅতঃপর যথাক্রমে জন্মগ্রহণ করেন যয়নব, রুকাইয়াহ, উম্মে কুলছুম, ফাতিমা ও আব্দুল্লাহ্দুপুত্রই বাল্যাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেনতবে কন্যাদের মধ্যে সকলেই ইসলামের যুগ পেয়েছেন, মুসলমান হয়েছেন এবং মুহাজিরের মর্যাদা লাভ করেছেন।[4]

 

রাসূলের (সা:) জীবনে তাঁর অবদানঃ

 

রাসূলুল্লাহ্‌র (সা:) জীবনে হযরত খাদীজা (রাঃ) ছিলেন আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ নেয়ামত স্বরূপদীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবত আল্লাহ্‌র নবীকে (সা:) সাহচর্য দিয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে, বিপদাপদে সাহস ও শক্তি যুগিয়ে, অভাব-অনটনে সম্পদ দিয়ে, প্রয়োজন মত প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে শিশু ইসলামের লালন-পালনের ক্ষেত্রে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইসলামের ইতিহাসে তা তুলনাহীনতাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেন, ‘যে সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল তখন তিনিই আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, যখন অপরেরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন তিনিই আমার উপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন, যখন অন্যেরা আমাকে বঞ্চিত করেছিল, তখন তিনি আমাকে তাঁর সম্পদে অংশীদার করেছিলেন এবং আল্লাহ আমার অন্য সব স্ত্রীর মাধ্যমে আমাকে কোন সন্তান দেননিকিন্তু তাঁরই মাধ্যমে আমাকে সন্তান দ্বারা অনুগৃহীত করেছিলেন।[5]

 

নবুওয়াত লাভের কয়েক বছর পূর্ব থেকেই হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন স্বামী মুহাম্মাদ (সা:)কে তিনি খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেনসাংসারিক চিন্তামুক্ত রেখে তার সাধনায় যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, স্বয়ং ফিরিশতা জিবরাঈল তার স্বীকৃতি প্রদান করেছেনসহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীমের (সা:) নিকট আগমন করে বললেন যে, ‘হে আল্লাহ্‌র রাসূল! ইনি (খাদীজা) আগমন করছেনতার নিকট একটি পাত্র আছেযার মধ্যে তরকারী খাদ্যবস্তু ও পানীয় আছেযখন তিনি আপনার নিকট এসে পৌঁছবেন, তখন আপনি তাঁকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সালাম বলবেন এবং জান্নাতে মতির তৈরি একটি মহলের শুভ সংবাদ প্রদান করবেনযার মধ্যে কোন প্রকার হৈ চৈ থাকবে না, কোন প্রকার ক্লান্তি শ্রান্তি আসবে না

 

রাসূলের (সা:) প্রথম ওয়াহী প্রাপ্তির পর ভীত-সন্ত্রস্ত ও চিন্তিত স্বামীকে যেভাবে সান্ত্বনা আর অভয়বাণী শুনিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়করভয় জড়িত দুরু দুরু বক্ষে কম্পিত কণ্ঠে রাসূলুল্লাহ্ (সা:) যখন খাদীজাকে বলতে লাগলেন আমাকে চাদর মুড়ি দাও’ ‘আমাকে চাদর মুড়ি দাওতৎক্ষণাৎ খাদীজা স্বামীর আদেশ পালন করে চাদর জড়িয়ে দিলেন ও কিছুক্ষণ পরে কম্পন দূর হলে যখন তিনি খাদীজাকে বললেন, হে খাদীজা! আমার একি হল! অতঃপর সব ঘটনা শুনালেন ও বললেন, ‘আমি মৃত্যুর আশংকা করছিতখন খাদীজা দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন :

 

কখনোই নয়আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুনআল্লাহ্‌র কসম! আপনাকে আল্লাহ কখনোই লাঞ্ছিত করবেন নানিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন, অন্যের বোঝা বহন করেন, অতিথি সেবা করেন ও হক বিপদে সকলকে সাহায্য করেন।[6]

 

এতেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না বরং বিষয়টিকে তিনি এত বেশী গুরুত্ব দিলেন যে, সেই মূহুর্তে স্বামী মুহাম্মাদকে (সা:) সাথে নিয়ে নিজের অন্ধ ও বয়োবৃদ্ধ চাচাতো ভাই খৃষ্টান পণ্ডিত ওয়ারাকা বিন নওফেল এর কাছে গেলেনতিনি আরবী ভাষায় ইনজীললিখতেনসবকিছু শুনে তিনি বললেন, ‘এতো সেই ফেরেশতা যাঁকে আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর উপরে নাযিল করেছিলেন

 

এই সাথে তিনি এমন কিছু বললেন- যাতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, ‘অনতিবিলম্বে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা:) হতে যাচ্ছেনদীর্ঘ ১৫ বছর যাবত নবী জীবনের একান্ত সঙ্গিনী হিসাবে তাঁর গোপন বাহির সবকিছু খাদীজার নখদর্পণে ছিলনবী চরিত্রে কোন গোপন দুর্বলতা থাকলে সবার আগে তাঁর নযরে ধরা পড়তোবরং তিনি তাঁর শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও উন্নত চরিত্র মাধুর্য সম্পর্কে গভীর ভাবে অবগত ছিলেনআর সে কারণে ওয়াহীনাযিলের বিষয়টিকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে নবীকে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিলেনবলা বাহুল্য ঐ সময় খাদীজার মত আপনজনের জোরালো সমর্থন না পেলে নবী (সা:)-এর পক্ষে ধৈর্য ধারণ করা কষ্টকর হয়ে যেত

 

প্রথম ওয়াহী প্রাপ্তির তিন বৎসর পর যখন নবী মুহাম্মাদ (সা:) দ্বিতীয় দফায় সূরা মুদ্দাছছিরের মাধ্যমে ওয়াহী প্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি উদ্বেগাকুল কণ্ঠে স্ত্রী খাদীজাকে ডেকে বললেন, খাদীজা! আমার উপর হুকুম এসে গেছে মানুষকে হুঁশিয়ার করতে, তাদেরকে আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বান জানাতেবলো কাকে আমি আহ্বান জানাই, কে আমার যাকে সাড়া দেবে? স্বামীর কথার মর্ম উপলব্ধি করতে দেরী হল না তাঁরনির্দ্বিধায় দীর্ঘদিনের সংস্কার মুছে ফেলে পরিবেশের প্রতিকূলতা ও ভয়-ভীতির পরওয়া না করে স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমিই সাড়া দিচ্ছি সর্বপ্রথমআমি ঈমান আনছি আল্লাহ্‌র উপরেআমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহ্‌র রাসূল (সা:)আপনি যে বাণী এনেছেন সমস্তই আমি সত্য বলে বিশ্বাস করছিআবুল কাসেম! আপনি চিন্তা করবেন না, উদ্বিগ্ন হবেন না, আমি আপনার সঙ্গিনী।[7]

 

খাদীজার (রাঃ) এই আশ্বাস বাণী রাসূলের উদ্বেগাকুল মনে কতখানি আশার সঞ্চার করেছিল, তা কেবল হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়এরপর শুরু হল নবী দম্পতির সংগ্রামী জীবনসকল প্রকার আরাম-আয়েশ উপেক্ষা করে মা খাদীজা (রাঃ) ইসলামের গোপন প্রচার কার্যে রাসূলকে (সা:) পূর্ণ সহযোগিতা দিতে থাকেনএ সময় রাসূলের (সা:) উপর কাফিরদের নির্যাতনে তিনি দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হলেও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি বরং পরম ধৈর্যের সাথে স্বামীকে তার ব্রত পালনে সাহস যুগিয়েছেনঅমুসলিম আত্মীয়-স্বজনের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ ও উপহাসকে উপেক্ষা করে তিনি হক এর দাওয়াতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেনঅত্যাচারিত, কর্মচ্যুত ও সমাজচ্যুত নও-মুসলিমদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য তিনি তার সমস্ত ধন-সম্পদ ওয়াক্‌ফ করে দিয়েছেননবুওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশ মুশরিকরা বনু হাশিম ও বনু মুত্ত্বালিবকে শেবে আবি তালিবেঅবরোধ করেএই বিপদের সময় হযরত খাদীজাও (রাঃ) রাসূলের (সা:) সাথে থেকে পুরা তিনটি বছর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বরদাশত করেনমোটকথা সেই মহা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে খাদীজাতুল কুবরা শুধুমাত্র রাসূলের (সা:) দুঃখ-বিপদের সাথীই ছিলেন না বরং প্রতিটি বিপদ-আপদে তাঁকে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকতেনরাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেন, ‘আমি যখন কাফেরদের নিকট থেকে কোন কথা শুনতাম এবং আমার নিকট অসহনীয় মনে হ, তখন আমি তা খাদীজাকে (রাঃ) বলতামখাদীজা আমাকে এমনভাবে সাহস যোগাতো যে, আমার অন্তর শান্ত হয়ে যেতআমার এমন কোন দুঃখ ছিল না যা খাদীজার (রাঃ) কথায় হাল্কা হত না।[8]

 

রাসূলের জীবনের কঠোরতম সংকটময় সময়গুলিতে বিবি খাদীজার (রাঃ) এই সীমাহীন অবদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে এত বেশী ভালবাসতেন যে, বিবি আয়েশার মত পতিপ্রাণা, জ্ঞানী ও খোদাভীরু মহিলা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারেননিমা আয়েশা নিজেই বলেছেন, ‘আমি কখনই রাসূলের (সা:) অপর কোন সহধর্মিণীর প্রতি তেমন ঈর্ষাপরায়ণ ছিলাম নাযেমন ছিলাম হযরত খাদীজার প্রতিআমি অনেক সময় তাঁকে [রাসূল (সা:)] তাঁর (খাদীজার) প্রশংসা করতে শুনেছি এবং বলতে শুনেছি তাঁকে আল্লাহ বেহেশ্‌তে মণিমুক্তা খচিত একটি গৃহের শুভসংবাদ প্রদানের হুকুম দিয়েছেনআর যখনই তিনি [রাসূল (সা:)] কোন ছাগল জবাই করতেন, তখন তার থেকে একটি বড় অংশ তাঁর (খাদীজার) বান্ধবীদের নিকট হাদিয়া স্বরূপ প্রেরণ করতেন। -বুখারী

 

মৃত্যুঃ

 

নির্বাসিত জীবনের অকল্পনীয় দুঃখ কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নিলেও সে সময়ের অর্ধাহার, অনাহার, কু-আহার আর অনিয়ম হযরত খাদীজার (রাঃ) দেহকে ক্ষয়গ্রস্থ করে ফেলেছিলফলে সুস্থতা আর ফিরে পাননিনবুওয়াতের দশম বছরের রামাযান মাসে ৬৫ বছর বয়সে এই মহীয়সী মহিলা রাসূলকে (সা:) শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।[9](ইন্নালিল্লাহে…………….রাযিঊন)

 

উপসংহারঃ

 

পরিশেষে বলব, মা খাদিজা (রাঃ) ছিলেন রাসূলের (সা:) জীবনের সকল বিপদের বিশ্বস্ত সাথী, সংকট কালের সহগামিনী, নৈরাশ্যে আশার সঞ্চারিণী, আর দুঃখ-বেদনায় সান্ত্বনা দায়িনীআজ থেকে চৌদ্দ শত বৎসর পূর্বে তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেও অনাগত ভবিষ্যতের রমণীকুলের জন্য রেখে গেছেন এক চির উজ্জ্বল ও চির অম্লান আদর্শ, যা উম্মতে মুসলিমার মর্ম মুকুরে চির ভাস্বর হয়ে আছে এবং চিরদিন এরূপ সমুজ্জ্বল দ্বীপ্তি নিয়ে বিরাজমান থাকবে

 

তথ্যসূত্র :

 

[1] তালিবুল হাশেমী, মহিলা ছাহাবী (বঙ্গানুবাদ) পৃঃ ১৮

 

[2] ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম (বঙ্গানুবাদ) ১ম খণ্ড পৃঃ ১১৪, গৃহীতঃ সীরাতে ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড পৃঃ ১৮৭-৮৮

 

[3] আর রাহীক্ব পৃঃ ১১৫, গৃহীতঃ ইবনে হেশাম, ১ম খণ্ড ১৮৯ ও ১৯০

 

[4] আর রাহীক্ব ১১৬

 

[5] প্রাগুক্ত পৃঃ ২২৬; মুসনাদে আহমদ ৬ষ্ঠ খণ্ড পৃঃ ১১৮

 

[6] প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৭, গৃহীতঃ সহীহ বুখারী ওয়াহী নাযিলের বিবরণঅধ্যায়

 

[7] মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান, নবী সহধর্মিণী পৃঃ ৩৩

 

[8] মহিলা সাহাবী (বঙ্গানুবাদ) পৃঃ ২২

 

[9] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২২৫

No comments:

Post a Comment