Monday, December 7, 2015

হযরত আলী রা.


নাম আলী, লকব আসাদুল্লাহ, হায়দার ও মুরতাজা, কুনিয়াত আবুল হাসান ও আবু তুরাবপিতা আবু তালিব আবদু মান্নাফ, মাতা ফাতিমাপিতা-মাতা উভয়ে কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখার সন্তানআলী রাসূলুল্লাহর সা. আপন চাচাতো ভাই

 

রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির দশ বছর পূর্বে তাঁর জন্মআবু তালিব ছিলেন ছাপোষা মানুষচাচাকে একটু সাহায্য করার উদ্দেশ্যে রাসূল সা. নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন আলীকেএভাবে নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তিনি বেড়ে ওঠেনরাসূল সা. যখন নবুওয়াত লাভ করেন, আলীর বয়স তখন নয় থেকে এগারো বছরের মধ্যেএকদিন ঘরের মধ্যে দেখলেন, রাসূলে কারীম সা. ও উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রা. সিজদাবনতঅবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কি? উত্তর পেলেন, এক আল্লাহর ইবাদাত করছিতোমাকেও এর দাওয়াত দিচ্ছিআলী তাঁর মুরব্বির দাওয়াত বিনা দ্বিধায় কবুল করেনমুসলমান হয়ে যানকুফর, শিরক ও জাহিলিয়্যাতের কোন অপকর্ম তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি
 

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সর্ব প্রথম হযরত খাদীজাতুল কুবরা রা. নামায আদায় করেনএ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেইঅবশ্য আবু বকর, আলী ও যায়িদ বিন হারিসা- এ তিন জনের কে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। (তাবাকাতঃ ৩/২১) ইবন আব্বাস ও সালমান ফারেসীর রা. বর্ণনা মতে, উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার রা. পর আলী রা. সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেনতবে এ সম্পর্কে সবাই একমত যে, মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজা, বয়স্ক আযাদ পরুষদের মধ্যে আবু বকর, দাসদের মধ্যে যায়িদ বিন হারিসা ও কিশোরদের মধ্যে আলী রা. প্রথম মুসলমান

 

নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে রাসূলে কারীম সা. হুকুম দিলেন আলীকে, কিছু লোকের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করআবদুল মুত্তালিব খান্দানের সব মানুষ উপস্থিত হলআহার পর্ব শেষ হলে রাসূল সা. তাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমি এমন এক জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকরআপনাদের মধ্যে কে আমার সঙ্গী হবে? সকলেই নিরবহঠাৎ আলী রা. বলে উঠলেনঃ যদিও আমি অল্পবয়স্ক, চোখের রোগে আক্রান্ত, দুর্বল দেহ, আমি সাহায্য করবো আপনাকে

 

হিজরাতের সময় হলঅধিকাংশ মুসলমান মক্কা ছেড়ে মদীনা চলে গেছেনরাসূলে কারীম সা. আল্লাহর হুকুমের প্রতীক্ষায় আছেনএ দিকে মক্কার ইসলাম বিরোধী শক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাসূলে কারীমকে সা. দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ারআল্লাহ তাঁর রাসূলকে সা. এ খবর জানিয়ে দেনতিনি মদীনায় হিজরাতের অনুমতি লাভ করেনকাফিরদের সন্দেহ না হয়, এ জন্য আলীকে রাসূল সা. নিজের বিছানায় ঘুমাবার নির্দেশ দেন এবং সিদ্দীকে আকবরকে সঙ্গে করে রাতের অন্ধকারে মদীনা রওয়ানা হনআলী রা. রাসূলে কারীমের সা. চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে অত্যন্ত আনন্দ সহকারে ঘুমালেনতিনি জানতেন, এ অবস্থায় তার জীবন চলে যেতে পারেকিন্তু তাঁর প্রত্যয় ছিল, এভাবে জীবন গেলে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছু হবে নাসুবহে সাদিকের সময় মক্কার পাষণ্ডরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল, রাসূলে কারীমের সা. স্থানে তাঁরই এক ভক্ত জীবন কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হয়ে শুয়ে আছেতারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তাআলা আলীকে রা. হিফাজত করেন

 

এ হিজরাত প্রসঙ্গে হযরত আলী রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. মদীনা রওয়ানার পূর্বে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি মক্কায় থেকে যাব এবং লোকদের যেসব আমানত তাঁর কাছে আছে তা ফেরত দেবএ জন্যই তো তাঁকে আল-আমীনবলা হতোআমি তিনদিন মক্কায় থাকলামতারপর রাসূলুল্লাহর সা. পথ ধরে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লামঅবশেষে বনী আমর ইবন আওফ- যেখানে রাসূল সা. অবস্থান করছিলেন, আমি উপস্থিত হলামকুলসুম ইবন হিদ্‌মের বাড়ীতে আমার আশ্রয় হলঅন্য একটি বর্ণনায়, আলী রা. রবীউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি কুবায় উপস্থিত হনরাসূল সা. তখনো কুবায় ছিলেন। (তাবাকাতঃ ৩/২২)

 

মাদানী জীবনের সূচনাতে রাসূল সা. যখন মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে মুয়াখাতবা দ্বীনী-ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করছিলেন, তিনি নিজের একটি হাত আলীর রা. কাঁধে রেখে বলেছিলেন, ‘আলী তুমি আমার ভাইতুমি হবে আমার এবং আমি হব তোমার উত্তরাধিকারী’ (তাবাকাতঃ ৩/২২) পরে রাসূল সা. আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন। (তাবাকাতঃ ৩/২৩)

 

হিজরী দ্বিতীয় সনে হযরত আলী রা. রাসূলে কারীমের সা. জামাই হওয়ার গৌরব অর্জন করেনরাসূলুল্লাহর সা. প্রিয়তম কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমার রা. সাথে তাঁর বিয়ে হয়

 

ইসলামের জন্য হযরত আলী রা. অবদান অবিস্মরণীয়রাসূলে কারীমের সা. যুগের সকল যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় তিনি দেনএ কারণে হুজুর সা. তাঁকে হায়দারউপাধিসহ যুল-ফিকারনামক একখানি তরবারি দান করেন

একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া সকল যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেনবদরে তাঁর সাদা পশমী রুমালের জন্য তিনি ছিলেন চিহ্নিতকাতাদা থেকে বর্ণিতবদরসহ প্রতিটি যুদ্ধে আলী ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পতাকাবাহী। (তাবাকাতঃ ৩/২৩) উহুদে যখন অন্যসব মুজাহিদ পরাজিত হয়ে পলায়নরত ছিলেন, তখন যে কজন মুষ্টিমেয় সৈনিক রাসূলুল্লাহকে সা. কেন্দ্র করে ব্যুহ রচনা করেছিলেন, আলী রা. তাঁদের একজনঅবশ্য পলায়নকারীদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা ঘোষিত হয়েছে

 

ইবন ইসহাক থেকে বর্ণিতখন্দকের দিনে আমর ইবন আবদে উদ্দ বর্ম পরে বের হলসে হুংকার ছেড়ে বললোঃ কে আমর সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? আলী উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর নবী, আমি প্রস্তুতরাসূল সা. বললেনঃ এ হচ্ছে আমর তুমি বস’ ’আমর আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলঃ আমার সাথে লড়বার মত কেউ নেই? তোমাদের সেই জান্নাত এখন কোথায়, যাতে তোমাদের নিহতরা প্রবেশ করবে বলে তোমাদের ধারণা? তোমাদের কেউই এখন আমার সাথে লড়তে সাহসী নয়? আলী রা. উঠে দাঁড়ালেনবললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি প্রস্তুতরাসূল সা. বললেনঃ বসতৃতীয় বারের মত আহ্‌বান জানিয়ে আমর তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলোআলী রা. আবারো উঠে দাঁড়িয়ে আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি প্রস্তুতরাসূল সা. বললেনঃ সে তো আমরআলী রা. বললেনঃ তা হোকএবার আলী রা. অনুমতি পেলেনআলী রা. তাঁর একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমরের দিকে এগিয়ে গেলেনআমর জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি কে? বললেনঃ আলীসে বললোঃ আবদে মান্নাফের ছেলে? আলী বললেনঃ আমি আবু তালিবের ছেলে আলীসে বললোঃ ভাতিজা, তোমার রক্ত ঝরানো আমি পছন্দ করিনেআলী বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমি কিন্তু তোমার রক্ত ঝরানো অপসন্দ করিনেএ কথা শুনে আমর ক্ষেপে গেলনিচে নেমে এসে তরবারি টেনে বের করে ফেললোসে তরবারি যেন আগুনের শিখাসে এগিয়ে আলীর ঢালে আঘাত করে ফেঁড়ে ফেললোআলী পাল্টা এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেললেনএ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সা. তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠেনতারপর আলী নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ফিরে আসেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসীর ৪/১০৬)

 

সপ্তমি হিজরীতে খাইবার অভিযান চালানো হয়সেখানে ইয়াহুদীদের কয়েকটি সুদৃঢ় কিল্লা ছিলপ্রথমে সিদ্দীকে আকবর, পরে ফারুকে আজমকে কিল্লাগুলি পদানত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়কিন্তু তারা কেউই সফলকাম হতে পারলেন নানবী সা. ঘোষণা করলেনঃ কাল আমি এমন এক বীরের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দেব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্রতারই হাতে কিল্লাগুলির পতন হবেপরদিন সকালে সাহাবীদের সকলেই আশা করছিলেন এই গৌরবটি অর্জন করারহঠাৎ আলীর ডাক পড়লোতাঁরই হাতে খাইবারের সেই দুর্জয় কিল্লাগুলির পতন হয়

 

তাবুক অভিযানে রওয়ানা হওয়ার সময় রাসূল সা. আলীকে রা. মদীনায় স্থলাভিষিক্ত করে যানআলী রা. আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যাচ্ছেন, আর আমাকে নারী ও শিশুদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন? উত্তরে রাসূল সা. বললেনঃ হারুন যেমন ছিলেন মূসার, তেমনি তুমি হচ্ছো আমার প্রতিনিধিতবে আমার পরে কোন নবী নেই। (তাবাকাতঃ ৩/২৪)

 

নবম হিজরীতে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে প্রথম ইসলামী হজ্জ্ব অনুষ্ঠিত হয়এ বছর হযরত সিদ্দীকে আকবর রা. ছিলেন আমীরুল হজ্জ্বতবে কাফিরদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিল ঘোষণার জন্য রাসূল সা. আলীকে রা. বিশেষ দূত হিসেবে পাঠান

 

দশম হিজরীতে ইয়ামনে ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত খালিদ সাইফুল্লাহকে পাঠানো হয়মাস চেষ্টার পরও তিনি সফলকাম হতে পারলেন নাফিরে এলেনরাসূলে করীম সা. আলীকে রা. পাঠানোর কথা ঘোষণা করলেনআলী রা. রাসূলুল্লাহর সা. কাছে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ আপনি আমাকে এমন লোকদের কাছে পাঠাচ্ছেন যেখানে নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে অথচ বিচার ক্ষেত্রে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেইউত্তরে রাসূল সা. বললেনঃ আল্লাহ তোমাকে সঠিক রায় এবং তোমার অন্তরে শক্তিদান করবেনতিনি আলীর রা. মুখে হাত রাখলেনআলী বলেনঃ অতঃপর আমি কক্ষনো কোন বিচারে দ্বিধাগ্রস্ত হইনিযাওয়ার আগে রাসূল সা. নিজ হাতে আলীর রা. মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দুআ করেনআলী ইয়ামনে পৌঁছে তাবলীগ শুরু করেনঅল্প কিছুদিনের মধ্যে সকল ইযামনবাসী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হামাদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে যায়রাসূল সা. আলীকে রা. দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েনতিনি দুআ করেনঃ আল্লাহ, আলীকে না দেখে যেন আমার মৃত্যু না হয়হযরত আলী বিদায় হজ্জের সময় ইয়ামন থেকে হাজির হয়ে যান

 

রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর তাঁর নিকট-আত্মীয়রাই কাফন-দাফনের দায়িত্ব পালন করেনহযরত আলী রা. গোসল দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনমুহাজির ও আনসাররা তখন দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন

 

হযরত আবু বকর, হযরত উমার ও হযরত উসমানের রা. খিলাফত মেনে নিয়ে তাঁদের হাতে বাইয়াত করেন এবং তাঁদের যুগের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শরীক থাকেনঅত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতেও হযরত উসমানকে পরামর্শ দিয়েছেনযেভাবে আবু বকরকে সিদ্দীক’, উমারকে ফারুকএবং উসমানকে গণীবলা হয়, তেমনিভাবে তাঁকেও আলী মুরতাজাবলা হয়হযরত আবু বকর ও উমারের যুগে তিনি মন্ত্রী ও উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেনহযরত উসমানও সব সময় তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। (মরুজুজ জাহাবঃ ২/২)

 

বিদ্রোহীদের দ্বারা হযরত উসমান ঘেরাও হলে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে আলীই রা. সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করেনসেই ঘেরাও অবস্থায় হযরত উসমানের রা. বাড়ীর নিরাপত্তার জন্য তিনি তাঁর দুই পুত্র হাসান ও হুসাইনকে রা. নিয়োগ করেন। (আল-ফিত্‌নাতুল কুবরাঃ ড. ত্বাহা হুসাইন)

 

হযরত উমার রা. ইনতিকালের পূর্বে ছজন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের অসীয়াত করে যানআলীও ছিলেন তাঁদের একজনমৃত্যুর পূর্বে তিনি আলীর রা. সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ লোকেরা যদি আলীকে খলীফা বানায়, তবে সে তাদেরকে ঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে। (আল-ফিত্‌নাতুল কুবরা) হযরত উমার তাঁর বাইতুল মাকদাসসফরের সময় আলীকে রা. মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান

 

হযরত উসমানের রা. শাহাদাতের পর বিদ্রোহীরা হযরত তালহা, যুবাইর ও আলীকে রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দেয়প্রত্যেকেই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানানবিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, হযরত আলী রা. বার বার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে থাকেনঅবশেষে মদীনাবাসীরা হযরত আলীর রা. কাছে গিয়ে বলেন, খিলাফতের এ পদ এভাবে শূণ্য থাকতে পারে নাবর্তমানে এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি নেইআপনিই এর হকদারমানুষের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হনতবে শর্ত আরোপ করেন যে, আমার বাইয়াত গোপনে হতে পারবে নাএজন্য সর্বশ্রেণীর মুসলমানের সম্মতি প্রয়োজনমসজিদে নববীতে সাধারণ সভা হলোমাত্র ষোল অথবা সতেরো জন সাহাবা ছাড়া সকল মুহাজির ও আনসার আলীর রা. হাতে বাইয়াত করেন

 

অত্যন্ত জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে হযরত আলীর রা. খিলাফতের সূচনা হয়খলীফা হওয়ার পর তাঁর প্রথম কাজ ছিল হযরত উসমানের রা. হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করাকিন্তু কাজটি সহজ ছিল নাপ্রথমতঃ হত্যাকারীদের কেউ চিনতে পারেনিহযরত উসমানের স্ত্রী হযরত নায়িলা হত্যাকারীদের দেখেছিলেনকিন্তু তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেননিমুহাম্মাদ বিন আব আবু বকর হত্যার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেনকিন্তু হযরত উসমানের এক ক্ষোভ-উক্তির মুখে তিনি পিছটান দেনমুহাম্মাদ বিন আবু বকরও হত্যাকারীদের চিনতে পারেননিদ্বিতীয়তঃ মদিনা তখন হাজার হাজার বিদ্রোহীদের কব্জায়তারা হযরত আলীর রা. সেনাবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েছেকিন্তু তাঁর এই অসহায় অবস্থা তৎকালীন অনেক মুসলমানই উপলব্ধি করেননিতাঁরা হযরত আলী রা. নিকট তক্ষুনি হযরত উসমানের রা. কিসাসদাবী করেনএই দাবী উত্থাপনকারীদের মধ্যে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা রা. সহ তাল্‌হা ও যুবাইরের রা. মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও ছিলেনতাঁরা হযরত আয়িশার রা. নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সহ মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেনসেখানে তাঁদের সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশীআলীও রা. তাঁর বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছেনবসরার উপকণ্ঠে বিরোধী দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়হযরত আয়িশা রা. আলীর রা. কাছে তাঁর দাবী পেশ করেনআলীও রা. তাঁর সমস্যাসমূহ তুলে ধরেনযেহেতু উভয় পক্ষেই ছিল সততা ও নিষ্ঠা তাই নিষ্পত্তি হয়ে যায়হযরত তালহা ও যুবাইর ফিরে চললেনআয়িশাও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করলেনকিন্তু হাংগামা ও অশান্তি সৃষ্টিকারীরা উভয় বাহিনীতেই ছিলতাই আপোষ মীমাংসায় তারা ভীত হয়ে পড়েতারা সুপরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে এক পক্ষ অন্য পক্ষের শিবিরে হামলা চালিয়ে দেয়ফল এই দাঁড়ায়, উভয় পক্ষের মনে এই ধারণা জন্মালো যে, আপোষ মীমাংসার নামে ধোঁকা দিয়ে প্রতিপক্ষ তাঁদের ওপর হামলা করে বসেছেপরিপূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়আলীর রা. জয় হয়তিনি বিষয়টি হযরত আয়িশাকে রা. বুঝাতে সক্ষম হনআয়িশা রা. বসরা থেকে মদীনায় ফিরে যান

 

যুদ্ধের সময় আয়িশা উটের ওপর সওয়াব ছিলেনইতিহাসে তাই এ যুদ্ধ উটের যুদ্ধনামে খ্যাতহিজরী ৩৬ সনের জামাদিউস সানী মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়আশারায়ে মুবাশ্‌শারার সদস্য হযরত তাল্‌হা ও যুবাইরসহ উভয় পক্ষে মোট তের হাজার মুসলমান শহীদ হনঅবশ্য এ ব্যাপারে মতভেদ আছেহযরত আলী রা. পনের দিন বসরায় অবস্থানের পর কুফায় চলে যানরাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয়

 

এই উটের যু্দ্ধ ছিল মুসলমানদের প্রথম আত্মঘাতী সংঘর্ষঅনেক সাহাবী এ যুদ্ধে কোন পক্ষেই যোগদান করেননিএই আত্মঘাতী সংঘর্ষের জন্য তাঁরা ব্যথিতও হয়েছিলেনআলীর রা. বাহিনী যখন মদীনা থেকে রওয়ানা হয়, মদীনাবাসীরা তখন কান্নায় ভেংগে পড়েছিলেন

 

হযরত আয়িশার রা. সাথে তো একটা আপোষরফায় আসা গেলকিন্তু সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়ার রা. সাথে কোন মীমাংসায় পৌঁছা গেল নাহযরত আলী রা. তাঁকে সিরিয়ার গভর্ণর পদ থেকে বরখাস্ত করেনহযরত মুয়াবিয়া রা. বেঁকে বসলেনআলীর রা. নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেনতাঁর বক্তব্যের মূলকথা ছিল, ‘উসমান রা. হত্যার কিসাস না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে রা. খলীফা বলে মানবেন না

 

হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে সিফ্‌ফীননাম স্থানে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার রা. বাহিনীর মধ্যে এক সংঘর্ষ ঘটে যায়এ সংঘর্ষ ছিল উটের যুদ্ধ থেকেও ভয়াবহউভয় পক্ষে মোট ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) মুসলমান শাহাদাত বরণ করেনতাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আম্মার বিন ইয়াসীর, খুযাইমা ইবন সাবিত, ও আবু আম্মারা আল-মাযিনীও ছিলেনতাঁরা সকলেই আলীর রা. পক্ষে মুয়াবিয়ার রা. বাহিনীর হাতে শহীদ হনউল্লেখ্য যে, আম্মার বিন ইয়াসির সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছিলেনঃ আফসুস, একটি বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে’ (সহীহুল বুখারী) সাতাশ জন প্রখ্যাত সাহাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেনহযরত মুয়াবিয়াও হাদীসটির একজন বর্ণনাকারীঅবশ্য হযরত মুয়াবিয়া রা. হাদীসটির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেনএত কিছুর পরেও বিষয়টির ফায়সালা হলো না

 

সিফ্‌ফীনের সর্বশেষ সংঘর্ষে, যাকে লাইলাতুল হারবলা হয়, হযরত আলীর রা. জয় হতে চলেছিলহযরত মুয়াবিয়া রা. পরাজয়ের ভাব বুঝতে পেরে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মীমাংসার আহ্‌বান জানালেনতাঁর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে উঁচু করে ধরে বলতে থাকে, এই কুরআন আমাদের এ দ্বন্দ্বের ফায়সালা করবেযুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলোহযরত আলীর রা. পক্ষে আবু মুসা আশয়ারী রা. এবং হযরত মুয়াবিয়ার রা. পক্ষে হযরত আমর ইবনুল আস হাকাম বা সালিশ নিযুক্ত হলেনসিদ্ধান্ত হলো, এই দুইজেনের সম্মিলিত ফায়সালা বিরোধী দুপক্ষই মেনে নেবেনদুমাতুল জান্দালনামক স্থানে মুসলমানদের বড় আকারের এক সম্মেলন হয়কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করলে যে সিদ্ধান্তটি পাওয়া যায় তা হলো, হযরত আমর ইবনুল আস রা. হযরত আবু মুসা আশয়ারীর রা. সাথে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে তা থেকে সরে আসায় এ সালিশী বোর্ড ‍শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়দুমাতুল জান্দাল থেকে হতাশ হয়ে মুসলমানরা ফিরে গেলঅতঃপর আলী রা. ও মুয়াবিয়া রা. অনর্থক রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে সন্ধি করলেনএ দিন থেকে মূলতঃ মুসলিম খিলাফত দুভাগে ভাগ হয়ে যায়

 

এ সময় খারেজীনামে নতুন একটি দলের জন্ম হয়প্রথমে তারা ছিল আলী সমর্থককিন্তু পরে তারা এ বিশ্বাস প্রচার করতে থাকে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোন মানুষকে হাকামবা সালিশ নিযুক্ত করা কুফরী কাজআলী রা. আবু মুসা আশয়ারীকে রা. হাকামমেনে নিয়ে কুরআনের খেলাফ কাজ করেছেনসুতরাং হযরত আলী তাঁর আনুগত্য দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেনতারা হযরত আলী থেকে পৃথক হয়ে যায়তারা ছিল অত্যন্ত চরমপন্থীতাদের সাথে আলীর রা. একটি যুদ্ধ হয় এবং তাতে বহু লোক হতাহত হয়

 

এই খারেজী সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি আবদুর রহামান মুলজিম, আল-বারাক ইবন আবদিল্লাহ ও আমের ইবন বকর আত-তামীমী, নাহরাওয়ানের যুদ্ধের পর এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়দীর্ঘ আলোচনার পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মুসলিম উম্মার অন্তর্কলহের জন্য দায়ী মূলতঃ আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা.সুতরাং এ তিন ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবেসিদ্ধান্ত মুতাবিক মুলজিম দায়িত্ব নিল আলীর রা. এবং আল-বারাক ও আমর দায়িত্ব নিল যথাক্রমে মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসের রা.তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, মারবে নয় তো মরবেহিজরী ৪০ সনের ১৭ রমজান ফজরের নামাযের সময়টি এ কাজের জন্য নির্ধারিত হয়অতঃপর ইবন মুলজিম কুফা, আল-বারাক দিমাশ্‌ক ও আমর মিসরে চলে যায়

 

হিজরী ৪০ সনের ১৬ রমজান শুক্রবার দিবাগত রাতে আততায়ীরা আপন আপন স্থানে ওৎ পেতে থাকেফজরের সময় হযরত আলী রা. অভ্যাসমত আস-সালাত বলে মানুষকে নামাযের জন্য ডাকতে ডাকতে যখন মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, পাপাত্মা ইবন মুলজিম শাণিত তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে আহত করেআহত অবস্থায় আততায়ীকে ধরার নির্দেশ দিলেনসন্তানদের ডেকে অসীয়াত করলেনচার বছর নয় মাস খিলাফত পরিচালনার পর ১৭ রমজান ৪০ হিজরী শনিবার কুফায় শাহাদাত বরণ করেন

 

একই দিন একই সময় হযরত মুয়াবিয়া যখন মসজিদে যাচ্ছিলেন, তাঁরও ওপর হামলা হয়কিন্তু তা ব্যর্থ হয়তিনি সামান্য আহত হনঅন্য দিকে আমর ইবনুল আস অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদে যাননিতার পরিবর্তে পুলিশ বাহিনী প্রধান খারেজ ইবন হুজাফা ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেনতাঁকেই আমর ইবনুল আস মনে করে হত্যা করা হয়এভাবে মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা. প্রাণে রক্ষা পান। (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাঃ খিদরী বেক)

 

হযরত আলীর রা. নামাযে জানাযার ইমামতি করেন হযরত হাসান ইবন আলী রা.কুফা জামেমসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হযতবে অন্য একটি বর্ণনা মতে নাজফে আশরাফে তাঁকে সমাহিত করা হয়‍মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর

 

আততায়ী ইবন মুলজিমকে ধরে আনা হলে আলী রা. নির্দেশ দেনঃ সে কয়েদীতার থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করআমি বেঁচে গেলে তাঁকে হত্যা অথবা ক্ষমা করতে পারিযদি আমি মারা যাই, তোমরা তাকে ঠিক ততটুকু আঘাত করবে যতটুকু সে আমাকে করেছেতোমরা বাড়াবাড়ি করো নাযারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না’ (তাবাকাতঃ ৩/৩৫)

 

হযরত আলী রা. পাঁচ বছর খিলাফত পরিচালনা করেনএকমাত্র সিরিয়া ও মিসর ছাড়া মক্কা ও মদীনাসহ সব এলাকা তাঁর অধীনে ছিলতাঁর সময়টি যেহেতু গৃহযুদ্ধে অতিবাহিত হয়েছে এ কারণে নতুন কোন অঞ্চল বিজিত হয়নি

 

হযরত আলী রা. তাঁর পরে অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যাননিলোকেরা যখন তাঁর পুত্র হযরত হাসানকে রা. খলীফা নির্বাচিত করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল; তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তোমাদের নির্দেশ অথবা নিষেধ কোনটাই করছিনাঅন্য এক ব্যক্তি যখন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আপনার প্রতিনিধি নির্বাচন করে যাচ্ছেন না কেন? বললেনঃ আমি মুসলিম উম্মাহকে এমনভাবে ছেড়ে যেতে চাই যেমন গিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.

 

হযরত আলীর রা. ওফাতের পর দারুল খিলাফা’- রাজধানী কুফার জনগণ হযরত হাসানকে রা. খলীফা নির্বাচন করেতিনি মুসীলম উম্মার আন্তঃকলহ ও রক্তপাত পছন্দ করলেন নাএ কারণে, হযরত মুয়াবিয়া ইরাক আক্রমণ করলে তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে মুয়াবির রা. হাতে খিলাফতের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে করলেনএভাবে হযরত হাসানের নজীরবিহীন কুরবানী মুসলিম জাতিকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি দেয়খিলাফত থেকে তাঁর পদত্যাগের বছরকে ইসলামের ইতিহাসে আমুল জামায়াহ’- ঐক্য ও সংহতির বছর নামে অভিহিত করা হয়পদত্যাগের পর হযরত হাসান কুফা ত্যাগ করে মদীনা চলে আসেন এবং নয় বছর পর হিজরী পঞ্চাশ সনে ইনতিকাল করেনমাত্র ছয়টি মাস তিনি খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন

 

হযরত উমার রা. আলী রা. সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের  মধ্যে সর্বোত্তম ফায়সালাকারী আলীএমন কি রাসূল সা.ও বলেছিলেন, ‘আকদাহুম আলী- তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিচারক আলীতাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত লক্ষ্য করে হযরত উমার রা. একাধিকবার বলেছেনঃ লাওলা আলী লাহালাকা উমার- আলী না হলে উমার হালাক হয়ে যেত

 

আলী রা. নিজেকে একজন সাধারণ মুসলমানের সমান মনে করতেন এবং যে কোন ভুলের কৈফিয়তের জন্য প্রস্তুত থাকতেনএকবার এক ইয়াহুদী তাঁর বর্ম চুরি করে নেয়আলী বাজারে বর্মটি বিক্রি করতে দেখে চিনে ফেলেনতিনি ইচ্ছা করলে জোর করে তা নিতে পারতেনকিন্তু তা করেননিআইন অনুযায়ী ইয়াহুদীর বিরুদ্ধে কাজীর আদালতে মামলা দায়ের করেনকাজীও ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারকতিনি আলী রা. দাবীর সমর্থনে প্রমাণ চাইলেনআলী রা. তা দিতে পারলেন নাকাজী ইয়াহুদীর পক্ষে মামলার রায় দিলেনএই ফায়সালার প্রভাব ইয়াহুদীর ওপর এতখানি পড়েছিল যে, সে  মুসলমান হয়ে যায়সে মন্তব্য করেছিল, ‘এতো নবীদের মত ইনসাফআলী রা. আমীরুল মুমিনীন হয়ে আমাকে কাজীর সামনে উপস্থিত করেছেন এবং তাঁরই নিযুক্ত কাজী তাঁর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেনতিনি ফাতিমার সাথে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলে কারীমের সা. পরিবারের সাথেই থাকতেনবিয়ের পর পৃথক বাড়ীতে বসবাস শুরু করেনজীবিকার প্রয়োজন দেখা দিলকিন্তু পুঁজি ও উপকরণ কোথায়? গতরে খেটে এবং গনীমতের হিস্‌সা থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেনহযরত উমারের রা. যুগে ভাতা চালু হলে তাঁর ভাতা নির্ধারিত হয় বছরে পাঁচ হাজার দিরহামহযরত হাসান বলেন, মৃত্যুকালে একটি গোলাম খরীদ করার জন্য জমা করা মাত্র সাত শদিরহাম রেখে যান। (তাবাকাতঃ ৩/৩৯)

 

জীবিকার অনটন আলীর রা. ভাগ্য থেকে কোন দিন দূর হয়নিএকবার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহর সা. সময়ে ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে থেকেছি। (হায়াতুস সাহাবাঃ ৩/৩১২) খলীফা হওয়ার পরেও ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সাথে তাকে লড়তে হয়েছেতবে তাঁর অন্তরটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্তকোন অভাবীকে তিনি ফেরাতেন নাএজন্য তাঁকে অনেক সময় সপরিবারে অভুক্ত থাকতে হয়েছেতিনি ছিলেন দারুণ বিনয়ীনিজের হাতেই ঘর-গৃহস্থালীর সব কাজ করতেনসর্বদা মোটা পোশাক পরতেনতাও ছেঁড়া, তালি লাগানোতিনি ছিলেন জ্ঞানের দরজাদূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর কাছে এসে দেখতে পেত তিনি উটের রাখালী করছেন, ভূমি কুপিয়ে ক্ষেত তৈরী করছেনতিনি এতই অনাড়ম্বর ছিলেন যে, সময় সময় শুধু মাটির ওপর শুয়ে যেতেনএকবার তাঁকে রাসূল সা. এ অবস্থায় দেখে সম্বোধন করেছিলেন, ‘ইয়া আবা তুরাব’- ওহে মাটির অধিবাসী প্রাকৃতজনতাই তিনি পেয়েছিলেন, ‘আবু তুরাবলকবটিখলীফা হওয়ার পরও তাঁর এ সরল জীবন অব্যাহত থাকেহযরত উমারের রা. মত সবসময় একটি দুররা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন, লোকদের উপদেশ দিতেন। (আল-ফিতনাতুল কুবরা)

 

হযরত আলী রা. ছিলেন নবী খান্দানের সদস্য, যিনি নবীর সা. প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধঅনে শিক্ষা লাভ করেনরাসূল সা. বলেছেনঃ আনা মাদীনাতুল ইল্‌ম ওয়া আলী বাবুহা’- আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী সেই নগরীর প্রবেশদ্বার। (তিরমিযী) তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিজ এবং একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসিরকিছু হাদীসও সংগ্রহ করেছিলেনতবে হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেনকেউ তাঁর কাছে কোন হাদীস বর্ণনা করলে, বর্ণনাকারীর নিকট থেকে শপথ নিতেন। (তাযকিরাতুল হুফ্‌ফাজঃ ১/১০) তিনি রাসূলুল্লাহর সা. বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে বহু বিখ্যাত সাহাবী এবং তাবেঈ হাদীস বর্ণনা করেছেনপূর্ববর্তী খলীফাদের যুগে মুহাজিরদের তিনজন ও আনসারদের তিনজন ফাতওয়া দিতেনযথাঃ উমার, উসমান, আলী উবাই বিন কা, মুয়াজ বিন জাবাল ও যায়িদ বিন সাবিতমাসরুক থেকে অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে ফাতওয়া দিতেনঃ আলী, ইবন মাসউদ, যায়িদ, উবাই বিন কা, আবু মূসা আল-আশয়ারী। (তাবাকাতঃ ৪/১৬৭, ১৭৫)

 

আলী ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালো কবি। (কিতাবুল উমদাঃ ইবন রশীকঃ ১/২১) তাঁর কবিতার একটি দিওয়ানআমরা পেয়ে থাকিতাতে অনেকগুলি কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছেগবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেকগুলি কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছেতবে তিনি যে তৎকালীন আরবী কাব্য জগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল, তাতে পণ্ডিতদের কোন সংশয় নেইনাহজুল বালাগানামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। (তারীখূল আদাব আল-আরাবীঃ ডঃ উমার ফাররুখ, ১/৩০৯)

 

খাতুনে জান্নাত নবী কন্যা হযরত ফাতিমার রা. সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়যতদিন ফাতিমা জীবিত ছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ে করেননিফাতিমার মৃত্যুর পর একাধিক বিয়ে করেছেনতাবারীর বর্ণনা মতে, তার চৌদ্দটি ছেলে ও সতেরটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করেহযরত ফাতিমার গর্ভে তিন পুত্র হাসান, হুসাইন, মুহসিন এবং দুকন্যা যয়নাব ও উম্মু কুলসুম জন্মলাভ করেনশৈশবেই মুহসীন মারা যায়ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে, মাত্র পাঁচ ছেলে হাসান, হুসাইন, মুহাম্মাদ (ইবনুল হানাফিয়্যা), আব্বাস, এবং উমার থেকে তাঁর বংশ ধারা চলছে

 

ইমাম আহমাদ র. বলেন, আলী রা. মর্যাদা ও ফজীলাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে যত কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে তা হয়নি। (আল-ইসাবাঃ ২/৫০৮) ইতিহাসে তাঁর যত গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে তার কিয়দংশও তুলে ধরা সম্ভব নয়রাসূল সা. অসংখ্যবার তাঁর জন্য ও তাঁর সন্তানদের জন্য দুআ করেছেনরাসূল সা. বলেছেনঃ একমাত্র মুমিনরা ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না এবং একমাত্র মুনাফিকরা ছাড়া কেউ তোমাকে হিংসা করবে না

 

হযরত আলী এক সাথী হযরত দুরার ইবন দামরা আলী কিনানী একদিন হযরত মুয়াবিয়ার কাছে এলেনমুয়াবিয়া তাঁকে আলীর রা. গুণাবলী বর্ণনা করতে অনুরোধ করেনপ্রথমে তিনি অস্বীকার করেনকিন্তু মুয়াবিয়ার চাপাচাপিতে দীর্ঘ এক বর্ণনা দান করেনতাতে আলীর রা. গুণাবলী চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেঐতিহাসিকরা বলছেন এ বর্ণনা শুনে মুয়াবিয়া সহ তার সাথে বৈঠকে উপস্থিত সকলেই কান্নায় ভেংগে পড়েছিলেনঅতঃপর মুয়াবিয়্যা মন্তব্য করেনঃ আল্লাহর কসম, আবুল হাসান (হাসানের পিতা) এমনই ছিলেন’ (আল-ইসতিয়াবঃ ৩/৪৪)

No comments:

Post a Comment