**আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে মাইজভান্ডারী সূর সংগীতের প্রভাব
ইসলাম হচ্ছে সর্ব কালের সকল জিজ্ঞাসার জবাব। সকল সমস্যার সমধান। তা হচ্ছে একটি বিপ্লবী ঘোষনা। একটি সদা-সক্রিয় সু-সংগঠিত ও জীবন- আন্দোলন। মুসলমানরা হচ্ছে এ আন্দোলনের মুজাহিদ। বাহ্যিক ও আত্মিক দুটি ধারা প্রবাহে রয়েছে এ আন্দোলনের সার্থকতা এবং উভয় ধারার সমন্বয়ে মানব জাতির দিক দর্শন ও সংস্কার কার্যে যিনি আত্মোৎসর্গ করেন তিনি মুসলিম মনীষী রুপে ইসলামী সমাজে সমাদৃত। কুরআন সুন্নাহ,ইজমা কিয়াস এর ভিত্তিতে পরিচালিত উক্ত আন্দোলন বা পথ ও মতের কর্মধারা হবে ইসলামী সংস্কৃতির বাহন। এক্ষেত্রে তৌহিদ,ঈমান,নামাজ,রোজা,হজ্ব,যাকাত,জিহাদ ঈদুল-আযহা,ঈদুল ফিতর উদযাপন,শবে মে’রাজ,শবে বরাত,শবে কদ্বর,ঈদে মিলাদুন্নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,আশুরা,ওরশ শরীফ,ওয়াজ মাহফিল,দরুদ,মীলাদ,জিকির-আযকার,জন্ম,মৃত্যু,কুরবানী,বিবাহ,খৎনা,ইসলামী সংগঠন ইত্যাদি যেমন ইসলামী সংস্কৃতির ধারক বাহক ও বাস-ব রূপ,তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা,সাহিত্য,সং্গীত চর্চা,বক্তৃতা,চিত্রকলা,স’াপত্য,ভাস্কর্য,নৃত্য নাটক ইত্যাদিও ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন’ী নয় বরং তা যদি ইসলামী নীতিমালার গন্ডীর ভিতরে থাকে তাহলে তা ইসলামী সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গও বটে। সংগীতের বেলায়ও যে সংগীত বা গান বাদ্য রাসূলে করীম (দঃ) কর্তৃক সমর্থিত,আউলিয়ায়ে কেরাম কর্তৃক আমলকৃত,যা ইসলামী ভাবধারায় প্রস্ফুটিত এবং আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) এর প্রেম বর্ধক তা ইসলামী সংগীত হিসেবে ইসলামী সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান। উদ্দেশ্য ভেদে সংগীত বৈধ ও অবৈধ হওয়া ন্যায় সঙ্গত। কিন’তকে সম্পূর্ণ রুপে হারাম বা নিষিদ্ধ বলা যায় না। কেননা বহু সহীহ হাদীস শরীফে গান বাদ্য সম্পর্কে অনেক বর্ণনা রয়েছে। বহু আউলিয়ায়ে কেরাম নির্মল সংগীত প্রিয় ছিলেন। যে সংগীত বা গান বাদ্যের দ্বারা মন গলে,বিনয় ও নম্রভাব,আল্লাহ তায়ালঅর নৈকট্য ও সাক্ষাত মিলন লাভের আগ্রহ,তার বিরহ,অসন’ষ্টি ও আজাবের ভয় অন-রে উদিত হয় উপরন’আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) এর প্রতি মহব্বত বাড়ায় দুনিয়ার মহব্বত কমিয়ে দেয় এবং পবিত্র আনন্দ দান করে এরূপ সংগীত বা গান গজল বৈধ ও উত্তম। আর এরূপ গানের সাথে বাজনাও বিধেয়। পক্ষান-রে যে সংগীত বা গান বাজনার দ্বারা আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) প্রতি ভাব হতে বিরত বিরত রাখে,এবং অন-রে কু-ভাব,কু-ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে বিপথগামী করে তথা অশ্লীতাপূর্ণ তা সর্ববাদী সম্মত অবৈধ ও হারাম। আর সঙ্গত কারনেই ঐ রূপ গানের সাথে বাজনাও হারাম। কেননা নিয়ত বা উদ্দেশ্য ও প্রযোগ বিধি অনুসারে প্রত্যেক কাজ কর্মেরই উত্তম অধম,ভাল-মন্দ,হালাল হারাম দিক রয়েছে। তাই হাদীস শাস্ত্রের সর্ব প্রথম গ্রন’বুখারী শরীফের সর্ব প্রথম হাদীসে পাক হলোঃ ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়াত” অর্থাৎ অবশ্যই কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে একটি সাধারন আইন হলোঃ আল ইমুরু বে মাক্বাদ্বেদেহা” অর্থাৎ “সমস- কার্যের হুকুম নিয়ত বা উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে। সুতরাং সৎ উদ্দেশ্যে সংগীত বা গান বাজনা হালাল এবং অসৎ উদ্দেশ্যে হারাম। অসৎ উদ্দেশ্যে শুধু গান বাজনা কোন কোরআন তিলাওয়াতও হারাম। (এহইয়াউলুমুদ্দিন,ইমাম গাজ্জালী) এমন কি ফরজ ইবাদত,নামাজ,রোজা ও শরীয়তের কারণ বা অবস’া মোতাবেক কখনো কখনো হারাম হয়ে যায়। মাইজভান্ডারী সংগীত বলতে ইসলামী মরমী বা ভক্তি মূলক সংগীতকে বুঝায়। আল্লাহ রাসুল ও পীর অলীদের শানে এবং তত্ত্ব জ্ঞানপূর্ণ ইসলামের মর্মকথা সূর ছন্দে প্রকাশ করাই মাইজভান্ডারী সংগীতের মূল বৈশিষ্ট। মাইজভান্ডারী সংগীত স্রষ্টা প্রেম,নবী প্রেম,মুর্শিদ প্রশানিত্ম ও ভক্ত প্রাণের অন-র মথিত করা আকুতি বিধৃত। মূলতঃ “ইশকে হাকীকী” তথা খোদা প্রেমের আবেগ সংগীতগুলো সংকৃত। মাইজভান্ডার গ্রাম থেকে মাইভান্ডার শরীফ,মাইজভান্ডার শরীফ থেকে মাইভান্ডারী ত্বরীকা,মাইজভান্ডারী ত্বরীকা থেকে মাইজভান্ডারী সংগীত যে দুইজন আধ্যাত্ম মহা পুরুষের বদৌলতে উদ্ভাবিত হয়েছে তারা হলেন লক্ষ কোটি আশেক ভক্তের প্রাণের ধন,প্রাণের কেবলা,গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী শাহসূফী মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ আল হাসানী প্রকাশ হযরত কেবলা আল মাইজভান্ডারী (কঃ) ও গাউছুল আজম শায়খে ফা’য়াল শাহসূফী মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী প্রকাশ বাবাভান্ডারী কেবলা (কঃ)। এই যুগে শ্রেষ্ট দুই মহান সাধকের বিস্ময়কর সৃষ্টি মাইজভান্ডারী ত্বরীকা এবং বিস্ময়কর প্রভাব ও সম্মোহনী শক্তি স্বরূপ মাইজভান্ডারী সংগীত আপামর জন সাধারনকে স্রষ্টার প্রেমে উজ্জীবিত এং আত্ম সম্পূর্ণ ও আত্ম সংশোধন ও আত্মার বিপ্লব সাধনের মহা মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে। মাইজভান্ডারী সংগীত আজ হতে প্রায় ‘শ’ দেড়শ বছর পূর্বের নতুন ও অপরিচিত কোন বিষয় নয়। মাইজভান্ডারী সংগীত তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সূর,তাল-ছন্দ নিয়ে সংগীত অঙ্গনে আলোময় স’ান করে নিয়েছেন। সূরের দেশ,গানের দেশ,বাউলের দেশ এই বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামল পল্লীর দেশ ও দেশের মানুষের চলন,বলন ও মননের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমপূর্ণ ইসলামী ও আত্যাত্মিক ভাব ধারায় মাইজভান্ডারী সংগীত বাংলাদেশের সংস্কৃতির এমন কি ইসলামী সংস্কৃতির এক মহা সম্পদে পরিণত হয়েছে। মাইজভান্ডারী সংগীত কিভাবে মানুষকে আল্লাহর প্রেম মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলে এবং মাইজভান্ডারী সংগীত মানুষের মনে কেন এবং কিরূপ প্রভাব পড়ে তা সুদুর প্রসারী আলোচনা প্রয়াস রাখে। মূলতঃ সঙ্গীত বলতে গান এবং বাদ্য যন্ত্রাদীর ঝংকারের মসষ্টিকে বুঝায়। তাল মান লয়সহ বিভিন্ন সূরের বাহনে ভাবের বহিঃপ্রকাশই সঙ্গীত। সাধারনত দুটি শ্রেণীতে সঙ্গীতকে বিভক্ত করা হয়েছে।
(১) কন্ঠ সঙ্গীতঃ এই সঙ্গীতে কণ্ঠস্বর প্রাধান্য লাভ করে। কিন’বাদ্য যন্ত্রের ধ্বনি কণ্ঠস্বরের সাহায্যকারী হিসেবে থাকতে পারে। (২) যন্ত্র সংগীতঃ এই সঙ্গীতে কণ্ঠস্বর নেই,শুধু আছে বাদ্য যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত ভাবে সূরের অপূর্ব খেলা। কন্ঠের যা যন্ত্রের আওয়াজ বিশেষ ভঙ্গিতে উচ্চ এবং নিম্ন ক্রমে আল্পুত ভাবে প্রকাশই সূরের খেলা। গানের প্রাণ হলো সূর। নিত্য-নতুন মহিমার অধিপতি জগতে স্রষ্টার অপূর্ব কৌশলে মানবের হৃদয় সাগরে প্রতি নিয়ত যে কত রূপ ভাব তরঙ্গের উত্থান-পতন হচ্ছে তার কোন সীমা সংখ্যা নেই। সাগর তরঙ্গ সংকুলান না হলে স্বভাবতই তাতে যেমন একটি কল্লোলের বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় তদ্রুপ মানবের হৃদয় সাগরেও ঐ সকল ভাব তরুঙ্গের উত্থান-পতনের যে কল্লোল বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাকেই সূর বরা হয়। আর সূরের ধর্ম হলো স্বীয় সম্মোহীন শক্তি দ্বারা অনত্মরকে আকৃষ্ট করা। বিভিন্ন ভাবানত্মরের সৃষ্টি করে। এ জন্যই দেখা যায় কোন কোন সূর সঙ্গীত পরিবেশনে শ্রোতা আনন্দিত হয়,কোনটিতে অশ্রু বর্ষণ করে,আবার কোনটিতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। আবার কোন কোন সূর সঙ্গীতে শ্রোতা ভাবে বিভোর হয়। তাছাড়াও লক্ষ করা যায় অনত্মরাত্মা যখন দু:খ তরঙ্গে আলোড়িত হয় তখন কষ্ট দিয়ে যে সূর নির্গত হয় তা দু:খ ব্যঞ্জক,আর হৃদয় সুখ তরঙ্গে উদ্বেলিত হলে তখন যে সূর নির্গত হয় তা মনোহর ও আনন্দ চিত্ত হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই সূর প্রিয়। সুন্দর ফুল দেখলে দৃষ্টি যেমন সে দিকে নিবন্ধ হয়,সূর শ্রবণে অনত্মরও তেমন আকৃষ্ট হয়। পবত্র কোরআনে করীমও সুন্দর,সুললীত,মার্জিত সূরে পাঠ করার নির্দেশ রয়েছে। যেমন হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেঃ “লাইছা মিন্না মানলাম ইয়াতাগান্না বিল কোরআন” অর্থাৎ যে কোরআনকে সুললীত সূরে পাঠ না করে সে আমাদের দলভূক্ত নয়।” অর্থাৎ তোমরা কোআনকে তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা অলংকৃত কর। পবিত্র কোরআন শরীফের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তা কবিতার ছন্দে বর্ণিত এবং ছন্দ ও সূরের মাধ্যমে পাঠ করার নির্দেশ দানের উদ্দেশ্য হলো;সূর বিহীন কর্কশ ষ।ভলৈ কালঅমে পাক পাঠ করলে শ্রোতার মন বিষায়িত হয়ে উঠতে পারে এবং পাক কালামের সৌন্দর্য্য এবং মহাত্ম খর্ব তথা অবমাননা করা হবে। মানব হৃদয়ের সাথে সূরের বন্ধন খুব অমীয় ও নিবিড়। মানব মাত্রই বিরহী বিরহ থেকে আসে ভাব এবং ভাবের বহি:প্রকাশই হলো সূর। সূফী কুল শিরমনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রাহঃ) বিশ্ব বিখ্যত “মসনবী” শরীফের সূচনা করেছেন মানব বিরহের কাহিনী কর্ণনার মাধ্যমে। যেমন মসনবী শরীফের প্রথম শ্লোক হচ্ছে:অর্থাৎ বাঁশরী কি অবস’া বর্ণনা করতেছে কান পেতে শুন! সে বাঁশী বিরহ বিচ্ছেদের অভিযোগ করতেছে।” এখানে বাঁশী বলতে মানুষের রূহকে বুঝানো হয়েছে। রূহ হলো পবিত্র ও নূরানী জিনিস। তাঁর আদি বাস “আলমে আরওয়াহ” রুহের জগতে বিরহ বিচ্ছেদ বলতে রুহের জগত হতে মানব দেহে অবস’ানের কথা বলা হয়েছে। রুহ চিল সম্পূর্ণ পুতঃপবিত্র ও স্বাধীন। কিন’মানব দেহে এসে পার্থিব কামনা বাসনা তথা দুনিয়ার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে বন্দী হয়েছে এবং উর্ধ্ব জগত হতে তথা ঐশী সত্ত্বার সান্নিধ্য হতে রুহ নিম্ন জগতে তথা এ ধরাধামে অবতরণ করেছে। সূফী সাধক,পূণ্যাত্মা মহা মনীষীগণ যাদের অন-র দৃষ্টি প্রখর ও কামেল পীরের দিক্ষা ও ছোহবতে অন-র হতে গাফলতির পর্দ্দা অপসারিত হয়েছে তারাই হৃদয় বা আত্মার বিরহ বিচ্ছেদ অনুভব করতে পারেন। আর যে মানব তা উপলদ্ধি করতে পারে না তাকে ধিক্কার দিয়ে সূফী সম্রাট রুমী (রহঃ) বলেন বাশীর (আত্মার) এই সূর অগ্নি সুলঙ্গ;মৃদু সমীরণ নহে,এই অগ্নি যার মধ্যে নেই তার মৃত্যু শ্রেয়।” সূফী সম্রাট রুমী (রহঃ) মানবাত্নাকে বাশীর সাথে তুলনা করার একাধিক কারণ রয়েছে। যেমন তিনি আহলে ছেমা বা গান বাদ্য প্রিয় ছিলেন। বাশীর সূর শুনলেই তার আজদ বা ভাবাবেশ অবস’া দেখা দিত এই অবস’ায় তিনি ইন্দ্রীয় জ্ঞান বর্হিভূত অনেক কিছু দেখতে,জানতে ও শুনতে পেতেন। তার থেকে প্রবর্তিত ত্বরীকার জ্ঞান হলো:মৌলভীয়া তরীকা’ এই তরীকায়ও গান বাদ্যের মাধ্যমে ঐশী প্রেমে বিভোর হওয়ার প্রচলন আছে। তাছাড়া মানবাত্মাকে বাশীর সাথে তুলনা করার বিশেষ বিশেষ কারণ হচ্ছে;বাশী ছয় ছিদ্র বিশিষ্ট হয়ে থাকে এই ছয় ছিদ্র দিয়ে ছয় প্রকার রাগ বা সূর নির্গত হয়। এক একটি রাগ এক একটি জিকিরের সমতালে ধ্বনিত হয়। তদ্রুপ মানুষের হৃদয় রাজ্যে ছয়টি লতিফা রয়েছে। ক্বলব,রুহ,ছের,খকি,আখফা ও নফছ এই ছয়টি লতিফা বা ষড় পদ্ম মানুষের অভ্যন-রে বিরাজমান আছে। ত্বরীকত সাধনা ও মুর্শিদের সাহায্যে লতিফা গুলোর পরিশুদ্ধি লাভ করে জিকির জারি হয়ে থাকে। সঙ্গীতের ছয় রাগ তা সূরের সাথে ছয় জিকিরের গল মিলে বলেই সঙ্গীত শ্রবণে হৃদয়বান মানুষের হৃদয় অপূর্ব অবস’ার প্রকাশ পায়। শিশু সন-ান যেমন পিতাকে খুজে না পেলে বাবা,বাপ,আব্বা ইত্যাদি বলে ক্রন্দন সুরে ডেকে তালাশ করতে থাকে। আল্লাহ প্রেমিক হৃদয়বান মানুষও তদ্রুপ আল্লাহ তায়ালা হতে বিচ্ছেদের অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার পর হৃদয়ে বিরহ অনল সতেজ হয়ে তাদের হৃদয়সি’ত ছয় লতিফা হতে আল্লাহ সম্বোধন সূচক ছয়টি জিকির ছয় রাগের সহিত সমতালে ঘোষিত হয়ে থাকে। আর এ জন্যই মাওলানা রুমী (রাঃ) মানবাত্মা বা হৃদয়কে খোদায়ী বাশরী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা বাশী যেমন ফুৎকারের মাধ্যমে তার ক্রিয়া প্রকাশ করে তদ্রুপ আল্লাহপাকও মানব দেহে রুহ ফুকেছেন যেমন কোরআন পাকে বর্ণিত হয়েছে “ফানাফাখতু ফিহী মির রুহী” অর্থাৎ তার ভিতরে আমার থেকে রুহ ফুকলাম। আর তখনই মানবের ইন্দ্রীয় ক্রিয়ার বিকাশ ঘটল। প্রকৃতপক্ষে বাসত্মবিকই! সূরের ভিতর যে একটি আস্বাদ বা গুণ বর্তমান আছে তা সহজেই অনুমেয় এবং তা অস্বীকারও করা যায় না। সূরের মধ্যে যদি কোন রকম স্বাদ বা গুণ বর্তমান না থাকত তাহলে উহা অন-রকে আকৃষ্ট করতে পারত না। ক্রন্দনরত শিশু সুরের ঝংকারে সম্মোহিত হয়ে ক্রন্দন ভুলে যায়। কৃষক পল্লী গীতির সূর সুধা পানে ক্লানি- দূর করে। অন্ধকারে সঙ্গীহীন পথিক মন থেকে ভূতের ভয় দূর করার জন্য সুখের জাল বিস-ার করে। সূরের বারিধারায় শোকাতুরের শোকাগ্নি নির্বাপিত হয়। আর মহা সত্যের (স্রষ্টার) প্রেমিক তাপস সুরের পাখায় ভর করে আধ্যাত্মিক পথে ধাবিত হয় প্রিয়তমের মিলনে তীব্র আকাংখা বুকে নিয়ে। সূর যে কেবল মানব অন-রকেই আকৃষ্ট করে তা নহে তা জীব জন’র অন-রকেও প্রভাবিত করে। যেমন হযরত দাউদ (আঃ) যখন সুমিষ্ট সূরে “জাবুর” কিতাব পাঠ করতেন সেই সূরে মুগ্ধ হয়ে শুধু মানবকুল কেন,পশু পাখী এমনকি নদীর মৎস সমূহও সব কিছু ভুলে গিয়ে সে সূরের মাধুর্ষতা উপভােগ করত। বিষধর সর্প সূরের প্রভাবে তার হিংস্র স্বভাব পরিহার করে সূরের তালে হোলে দোলে খেলা করে। আর তাই বীণ বাজায়ে সর্পকে হস-গত করা হয়। উট চালকের সূরে মুগ্ধ হয়ে ভারী ভারী বোঝা বহন করে নিয়ে যায়। ঘন্টার ধ্বনি শুনে হাতী আনন্দে তালে তালে পা ফেলে চলে যায়। বস’ত সুরের ভিতর এমনই এক পবিত্র আস্বাদ বা আকর্ষণীয় গুণ বর্তমান আছে যা হৃদয়ের যাবতীয় কুলষতা দূর করে মন প্রাণকে আকৃষ্ট করে থাকে। রাসুলে খোদা (দঃ) সঙ্গীত উপভোগ করতেন এবং সুর তাকে আকৃষ্ট করতো। যেমন হুজুর (দঃ) হাসান বিন সাবিত (রাঃ) এর জন্য মসজিদে মিম্বর স’াপন করে এবং সেই মিম্বরে উঠে হাসান বিন ছাবেত (রাঃ) হুজুর (দঃ) এর গৌরব ও সৌভাগ্যের কবিতা মধুর কন্ঠে আবৃত্তি করতেন,এমনকি হুজুর (দঃ) তার কন্ঠে বিমগ্ধ হয়ে স্বীয় চাঁদর উপহার দিয়েছেন। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে একবার রাসূল পাক (দঃ) এর দরবারে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এসে বললেন:ইয়া রাসুল্লাল্লাহ আপনার গরীব উম্মতগন ধনী উম্মতগন হতে অর্ধ দিবস পূর্বে (যা এ দুনিয়ার পাচশত বৎসরের সমান) বেহেশতে গমন করবে। ইহা শ্রবণে রাসূলে খোদা (দঃ) অত্যন- আনন্দিত হযে উপসি’ত সাহাবাগনকে লক্ষ্য করে বললেন-“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে আমাকে গান শুনাইতে পার? জনৈক বদবী (গায়ক) বলল,আমি শুনাইতে পারি। তখন সে নিম্নোক্ত গানটি পরিবেশন করল-কাব্যানুবাদঃ দংশিয়াছে প্রেম স্বর্প হৃদয়ে আমার,নাহি ডাক্তার আর নাহি মন্ত্রকার,কিন’মন প্রাণ বিধি সকাশে যাহার,দাওয়াই আর মন্ত্র মোর আছে অনিবার” উক্ত গান শ্রবনে রাসুলে খোদা (দঃ) অজুদ বা ভাবাপন্ন অবস’ায় হেলতে দুলতে লাগলেণ,উপসি’ত সাহাবাগণও তাই করতে লাগলেন। এমনকি এমন ভাবাপন্ন অবস’ায় পৌছেছিলেন যে রাসূলে পাকের উভয় কাঁধ মোবারক হতে চাঁদর মোবারক খসে জমীনে পড়ে যায়। যখনই এই মহানন্দা পবিত্র নৃত্য সমাপন হলো,প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম স্বীয় স’ানে বসলেন। তখন আবু সূফীয়ানের পুত্র হযরত মা’বীয়া (রাঃ) বললেন-“মা আহছানা লা’বুজুম ইয়া রাসুলাল্লাহ” অর্থাৎ ইয়া রাসুলাল্লাহ্ আপনাদের খেলা (নৃত্য) কি সুন্দর। প্রতি উত্তরে হুজুর পাক (দঃ) বললেন-যে কেহ প্রিয়তমের স্মরণে গানে অনুরূপ না হয় সে ভদ্র নহে।” পরে উপসি’ত সাহাবায়ে কেরামগণ রাসুলে পাকের উক্ত চাঁদর মোবারকখানা তবারুক হিসেবে চারশত টুকরায় ভাগ করে নেন। এতে প্রতিয়মান হয় যে উপসি’ত সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল চারশত। (তাফসীরাতে আহমদীয়া ৬০২ পঃ) হযরত খালদ বিন জাকওয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত হযরত বোরাই বিনতে মুয়াজ বর্ণনা করেন- আমি যখন স্বামী ঘরে নতুন বিবাহিতা হয়ে প্রবেশ করলাম তখন রাসূল (দঃ) এসে আমার বিছনায় এমন ভাবে বসে গেলেন যেমন তুমি আমার নিকট বসেছে। আমাদের পরিবারের নব যুবতীয়া দফ (ঢোল) বাজাইতেছিল। এবং আমাদের পূর্ব পুরুষগন যারা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদের বীরত্বের গান করতেছিল। তাদের মদ্যে একজন গাইতে লাগল,“আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন যিনি ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন। “তখন হুজুর পাক (দঃ) ইহা না গেয়ে পূর্বে যা গাইতেছিলে তাহাই গাও।” (বুখারী ও তিরমিজি শরীফ) শুধুমাত্র রাসুলে খোদা (দঃ) এর সঙ্গীত প্রিয়তার নিদর্শণ হিসেবে উল্লেখিত হাদীস দ্বয়ের উল্লেখ করা হলো। মাইজভান্ডারী সঙ্গীত মানবের অন-ঃকরণে আল্লাহ ও রাসূল (দঃ),আহলে বায়াতে রাসূল,আউলিয়ায়ে কেরামগনের মহব্বত বাড়ায়,দুনিয়ার মহব্বত কমিয়ে দেয় এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এরূপ সঙ্গীত মানবের জন্য অত্যন- উপকারী। অন্যান্য এবাদত বন্দেগীর সময় চির শত্রু শয়তানের প্ররোচনায় মনের একাগ্রতা ঠিক রাখা খুবই কঠিন। কিন’ত্বরীকত পন’ীদের ছেমা বা সঙ্গীত এমনই এক ইবাদত যা অন্য সব দিক থেকে মন প্রাণকে ফিরায়ে আল্লাহ রাসূল ও আপন পীর মুর্শীদের দিকে রজ্জু রাখে। কারণ সূর মানব হৃয়কে গভীর ভাবে আকৃষ্ট করে একাগ্রতা এনে দেয়। যার হৃদয়ে সূরের সুজ্ঞান সৃষ্টি হয় সে কখনো নিষ্ঠুর প্রকৃতির হতে পারে না। সূরেলা অন-রে বিরাজ করে কোমলতা। আর সেথায় প্রবাহিত হয় নির্মল প্রেমের বর্ণনা। এই প্রেম প্রাথমিক স-রে সীমাবদ্ধ থেকে সৃষ্টির ভিতরে তার সসীমকে লংঘন করে গতিশীল হয়ে পড়ে রহস্য পূর্ণ অসীমের পথে। এই পথের প্রেমিক স্বার্থক পরিণতি লাভ করে সুমহান প্রেমস্পদের মাঝে নিজ সত্ত্বা বা আমিত্ত্বকে বিলীন করে। এ জন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন মহাপুরুষগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে,অমূল্য স্বগীয়দান সমূহের মধ্যে “সূর” তথা গান একটি বিশিষ্ট স’ানের অীধকারী এবং সৃষ্টিকর্তার গোপন রহস্যাবলীর অন্যতম। ভালবাসার অগ্নি শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে সূর অত্যন- ক্ষমতাবান। যারা একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন,ইহা শতসিদ্ধ যে,আল্লাহ তাযালা কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। কিন’তিনি বান্দার প্রেম কামনা করেন। যা আল কোরআনকে নিয়ে গভীর গবেষণা করলেই সহজে অনুমেয় হয়ে উঠে। এজন্যই যে কোন এবাদতই হোক না কেন তা প্রেম রসে সিক্ত না হলে,প্রেমের মহাজন তা কবুল করেন না। কারণ বিশ্ব সৃষ্টির মূল রয়েছে পবিত্র প্রেমের অদম্য প্রেরণা। হাদীস কুদীতে তার সাক্ষ্য বহন করে। “কনতু কানজান মুখফিয়ান ফা আছবাবতু আন উরাফা ফা খালাকতুল খালকা লে উরাকা” অর্থাৎ আমি গুপ্ত ধন ডাক্তার স্বরূপ ছিলাম অতঃপর প্রেমাবেশে প্রেসাসক্ত হয়ে নিজেকে নিজে পরিচত করার জন্য এই সৃষ্টি মালার সূচনা করলাম যেন তারা আমাকে চিনে।
সূফীয়ে কেরাম প্রেমকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেনঃ ১. এশকে হাকীকী যা ঐশী প্রেম বা খোদা প্রেম।
২.জাগতিক প্রেম যেমন স্বামী স্ত্রী,মা বাবা ভাই বোন ইত্যাদি। ৩. এশকে ফাসেকী বা নিন্দনীয় প্রেম যা খোদা প্রেমের প্রতিবন্ধক।
এখানে যে প্রেমের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে এশকে হাকীকী বা খোদা প্রেম। যার মন পুত:পবিত্র পার্থিব কামনা বাসনার উর্ধ্বে তার জন্যই প্রেম,ঐশী প্রেমই প্রকৃত প্রেম। আর কোমল অন-ঃকরণ হলো এ প্রেমের উৎস। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে সেই প্রেমাগ্নি সুপ্ত অবস’ায় বিরাজ করে। যেমন পাথরে অগ্নি লুকায়িত থাকে ঘর্ষণে প্রকাশ পায়। তেমনি যখন কোন খোদা প্রেমিক আশেক ভক্তের সম্মুখে ঐশী ভাবাপন্ন গান,গজল বা সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় তখন তার হৃদয়ের সুপ্ত প্রেমাগ্নি জ্বলে উঠে এবং স্রষ্টার প্রেমে আত্মহারা হয়ে যায়।
ইমাম গাজ্জালী (রাঃ) এহইয়াউ উলুমুদ্দিন’ কিতাবে লিখেন “যার অন-রকে সঙ্গীতে আকৃষ্ট করে না,সে নীচের পতিত স্বভাবের অধিকারী ,রুহানীয়ত হতে বঞ্চিত ও কুট চরিত্র বিশিষ্ট অনির্মল অন-ও,ভ্রষ্ট্র ও পাখীসমূহ হতেও নীচু এবং যাবতীয় পশু হতেও ঘৃণিত।” সূফী সম্রাট আল্লামা রুমী (রাঃ) বলেন-ছেমা বা সঙ্গীত হলো আশেকদের হৃদয়ের খোরাক।’
পীরানে পীর দস-গীর গাউছুল আযম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) নামক কিতাবের ১২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন “নিশ্চয় ছেমা বা সঙ্গীত কারো জন্য ফরজ,কারো জন্য সুন্নাত কারো জন্য বিদয়াত।” আল আনওয়ারোর রাহমানিয়া ফি তরীকাতিল কাদেরীয়া কাছনেজানীয়া কিতাবের ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-সর্বপ্রথম জিকিরের মজলিসে তবলা নামক বাদ্য বাজনা পীরানে পীর দস-গীর গাউছুল আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) প্রচলন করেন। উল্লেখ্য যে,গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানীর (রাঃ) দরবারে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বাদে এশা প্রত্যেক জু’মার নামাজের পর এবং প্রতি বৎসর রবিউসসানীর ১১ তারিখ ওরশ শরীফে ছেমা বা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে সঙ্গীত,জিকির আজকারের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমি বিগত ১৯৯৮ হতে ৯৯ সাল পর্যন- বাগদাদ শরীফ লেখাপড়া করা অবস’ায় সাপ্তাহিক মাহফিল ও ওরশ শরীফে শরীক হয়ে ধন্য হয়েছি। এবং ২০০০ হতে ২০০৫ সাল পর্যন- মিশর আল্ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। সেখানে ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর পবিত্র ছের মোবারকের মাজার শরীফ যা আযহার বিশ্ব বিদ্যালয়ে সম্মুখে অবসি’ত লেখা আছে সরকারীভাবে ৭ দিন ব্যাপী ওরশ শরীফ হয় এবং মিশরের শ্রেষ্ঠ কাওয়াল গান বাদ্য বাজনার দ্বারা ছেমা বা কাওয়ালী মাহফিল করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন অলী আল্লাহপাকের দরবারে বাদ্য বাজনা সহ ছেমা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গীতের সূর ও বাদ্যবাজনার তালে অসংখ্য ভক্ত অনুরক্ত খোদার প্রেমে বিভোর থাকে,নৃত্য থাকে আল্লাহর জিকিরে। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন হতেই সূর ও সঙ্গীত মানব হৃদয়ের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান সমাজ অপসংস্কৃতির করাল গ্লাসে নিমজ্জিত। মানব চরিত্র অপসংস্কৃতির ছোয়ায় ধ্বংসের অতল গহ্বরে চলে যাচ্ছে। ঠিক সে সময়ে মাইজভান্ডারীয়া ছেমা সংগীত ইসলামী সংস্কৃতি যদি সমাজের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে পৌছানো যায়,তাহলে পরিবার,সমাজ,দেশ অপসংস্কৃতির কালো হাত হতে রেহাই পাবে এবং মানব মন আল্লাহ প্রেমে বিভোর থাকবে। নেমে আসবে দেশে,সমাজে ও পরিবারে সুখ,শানি- ও সমৃদ্ধি,মুক্তি পাবে আখেরাতে। আল্লাহপাক মাইজভান্ডারী সূর সঙ্গীত সমাজে প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
ইসলাম হচ্ছে সর্ব কালের সকল জিজ্ঞাসার জবাব। সকল সমস্যার সমধান। তা হচ্ছে একটি বিপ্লবী ঘোষনা। একটি সদা-সক্রিয় সু-সংগঠিত ও জীবন- আন্দোলন। মুসলমানরা হচ্ছে এ আন্দোলনের মুজাহিদ। বাহ্যিক ও আত্মিক দুটি ধারা প্রবাহে রয়েছে এ আন্দোলনের সার্থকতা এবং উভয় ধারার সমন্বয়ে মানব জাতির দিক দর্শন ও সংস্কার কার্যে যিনি আত্মোৎসর্গ করেন তিনি মুসলিম মনীষী রুপে ইসলামী সমাজে সমাদৃত। কুরআন সুন্নাহ,ইজমা কিয়াস এর ভিত্তিতে পরিচালিত উক্ত আন্দোলন বা পথ ও মতের কর্মধারা হবে ইসলামী সংস্কৃতির বাহন। এক্ষেত্রে তৌহিদ,ঈমান,নামাজ,রোজা,হজ্ব,যাকাত,জিহাদ ঈদুল-আযহা,ঈদুল ফিতর উদযাপন,শবে মে’রাজ,শবে বরাত,শবে কদ্বর,ঈদে মিলাদুন্নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,আশুরা,ওরশ শরীফ,ওয়াজ মাহফিল,দরুদ,মীলাদ,জিকির-আযকার,জন্ম,মৃত্যু,কুরবানী,বিবাহ,খৎনা,ইসলামী সংগঠন ইত্যাদি যেমন ইসলামী সংস্কৃতির ধারক বাহক ও বাস-ব রূপ,তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা,সাহিত্য,সং্গীত চর্চা,বক্তৃতা,চিত্রকলা,স’াপত্য,ভাস্কর্য,নৃত্য নাটক ইত্যাদিও ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন’ী নয় বরং তা যদি ইসলামী নীতিমালার গন্ডীর ভিতরে থাকে তাহলে তা ইসলামী সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গও বটে। সংগীতের বেলায়ও যে সংগীত বা গান বাদ্য রাসূলে করীম (দঃ) কর্তৃক সমর্থিত,আউলিয়ায়ে কেরাম কর্তৃক আমলকৃত,যা ইসলামী ভাবধারায় প্রস্ফুটিত এবং আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) এর প্রেম বর্ধক তা ইসলামী সংগীত হিসেবে ইসলামী সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান। উদ্দেশ্য ভেদে সংগীত বৈধ ও অবৈধ হওয়া ন্যায় সঙ্গত। কিন’তকে সম্পূর্ণ রুপে হারাম বা নিষিদ্ধ বলা যায় না। কেননা বহু সহীহ হাদীস শরীফে গান বাদ্য সম্পর্কে অনেক বর্ণনা রয়েছে। বহু আউলিয়ায়ে কেরাম নির্মল সংগীত প্রিয় ছিলেন। যে সংগীত বা গান বাদ্যের দ্বারা মন গলে,বিনয় ও নম্রভাব,আল্লাহ তায়ালঅর নৈকট্য ও সাক্ষাত মিলন লাভের আগ্রহ,তার বিরহ,অসন’ষ্টি ও আজাবের ভয় অন-রে উদিত হয় উপরন’আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) এর প্রতি মহব্বত বাড়ায় দুনিয়ার মহব্বত কমিয়ে দেয় এবং পবিত্র আনন্দ দান করে এরূপ সংগীত বা গান গজল বৈধ ও উত্তম। আর এরূপ গানের সাথে বাজনাও বিধেয়। পক্ষান-রে যে সংগীত বা গান বাজনার দ্বারা আল্লাহ ও রাসূল (দঃ) প্রতি ভাব হতে বিরত বিরত রাখে,এবং অন-রে কু-ভাব,কু-ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে বিপথগামী করে তথা অশ্লীতাপূর্ণ তা সর্ববাদী সম্মত অবৈধ ও হারাম। আর সঙ্গত কারনেই ঐ রূপ গানের সাথে বাজনাও হারাম। কেননা নিয়ত বা উদ্দেশ্য ও প্রযোগ বিধি অনুসারে প্রত্যেক কাজ কর্মেরই উত্তম অধম,ভাল-মন্দ,হালাল হারাম দিক রয়েছে। তাই হাদীস শাস্ত্রের সর্ব প্রথম গ্রন’বুখারী শরীফের সর্ব প্রথম হাদীসে পাক হলোঃ ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়াত” অর্থাৎ অবশ্যই কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে একটি সাধারন আইন হলোঃ আল ইমুরু বে মাক্বাদ্বেদেহা” অর্থাৎ “সমস- কার্যের হুকুম নিয়ত বা উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে। সুতরাং সৎ উদ্দেশ্যে সংগীত বা গান বাজনা হালাল এবং অসৎ উদ্দেশ্যে হারাম। অসৎ উদ্দেশ্যে শুধু গান বাজনা কোন কোরআন তিলাওয়াতও হারাম। (এহইয়াউলুমুদ্দিন,ইমাম গাজ্জালী) এমন কি ফরজ ইবাদত,নামাজ,রোজা ও শরীয়তের কারণ বা অবস’া মোতাবেক কখনো কখনো হারাম হয়ে যায়। মাইজভান্ডারী সংগীত বলতে ইসলামী মরমী বা ভক্তি মূলক সংগীতকে বুঝায়। আল্লাহ রাসুল ও পীর অলীদের শানে এবং তত্ত্ব জ্ঞানপূর্ণ ইসলামের মর্মকথা সূর ছন্দে প্রকাশ করাই মাইজভান্ডারী সংগীতের মূল বৈশিষ্ট। মাইজভান্ডারী সংগীত স্রষ্টা প্রেম,নবী প্রেম,মুর্শিদ প্রশানিত্ম ও ভক্ত প্রাণের অন-র মথিত করা আকুতি বিধৃত। মূলতঃ “ইশকে হাকীকী” তথা খোদা প্রেমের আবেগ সংগীতগুলো সংকৃত। মাইজভান্ডার গ্রাম থেকে মাইভান্ডার শরীফ,মাইজভান্ডার শরীফ থেকে মাইভান্ডারী ত্বরীকা,মাইজভান্ডারী ত্বরীকা থেকে মাইজভান্ডারী সংগীত যে দুইজন আধ্যাত্ম মহা পুরুষের বদৌলতে উদ্ভাবিত হয়েছে তারা হলেন লক্ষ কোটি আশেক ভক্তের প্রাণের ধন,প্রাণের কেবলা,গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী শাহসূফী মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ আল হাসানী প্রকাশ হযরত কেবলা আল মাইজভান্ডারী (কঃ) ও গাউছুল আজম শায়খে ফা’য়াল শাহসূফী মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান আল হাসানী প্রকাশ বাবাভান্ডারী কেবলা (কঃ)। এই যুগে শ্রেষ্ট দুই মহান সাধকের বিস্ময়কর সৃষ্টি মাইজভান্ডারী ত্বরীকা এবং বিস্ময়কর প্রভাব ও সম্মোহনী শক্তি স্বরূপ মাইজভান্ডারী সংগীত আপামর জন সাধারনকে স্রষ্টার প্রেমে উজ্জীবিত এং আত্ম সম্পূর্ণ ও আত্ম সংশোধন ও আত্মার বিপ্লব সাধনের মহা মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে। মাইজভান্ডারী সংগীত আজ হতে প্রায় ‘শ’ দেড়শ বছর পূর্বের নতুন ও অপরিচিত কোন বিষয় নয়। মাইজভান্ডারী সংগীত তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সূর,তাল-ছন্দ নিয়ে সংগীত অঙ্গনে আলোময় স’ান করে নিয়েছেন। সূরের দেশ,গানের দেশ,বাউলের দেশ এই বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামল পল্লীর দেশ ও দেশের মানুষের চলন,বলন ও মননের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমপূর্ণ ইসলামী ও আত্যাত্মিক ভাব ধারায় মাইজভান্ডারী সংগীত বাংলাদেশের সংস্কৃতির এমন কি ইসলামী সংস্কৃতির এক মহা সম্পদে পরিণত হয়েছে। মাইজভান্ডারী সংগীত কিভাবে মানুষকে আল্লাহর প্রেম মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলে এবং মাইজভান্ডারী সংগীত মানুষের মনে কেন এবং কিরূপ প্রভাব পড়ে তা সুদুর প্রসারী আলোচনা প্রয়াস রাখে। মূলতঃ সঙ্গীত বলতে গান এবং বাদ্য যন্ত্রাদীর ঝংকারের মসষ্টিকে বুঝায়। তাল মান লয়সহ বিভিন্ন সূরের বাহনে ভাবের বহিঃপ্রকাশই সঙ্গীত। সাধারনত দুটি শ্রেণীতে সঙ্গীতকে বিভক্ত করা হয়েছে।
(১) কন্ঠ সঙ্গীতঃ এই সঙ্গীতে কণ্ঠস্বর প্রাধান্য লাভ করে। কিন’বাদ্য যন্ত্রের ধ্বনি কণ্ঠস্বরের সাহায্যকারী হিসেবে থাকতে পারে। (২) যন্ত্র সংগীতঃ এই সঙ্গীতে কণ্ঠস্বর নেই,শুধু আছে বাদ্য যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত ভাবে সূরের অপূর্ব খেলা। কন্ঠের যা যন্ত্রের আওয়াজ বিশেষ ভঙ্গিতে উচ্চ এবং নিম্ন ক্রমে আল্পুত ভাবে প্রকাশই সূরের খেলা। গানের প্রাণ হলো সূর। নিত্য-নতুন মহিমার অধিপতি জগতে স্রষ্টার অপূর্ব কৌশলে মানবের হৃদয় সাগরে প্রতি নিয়ত যে কত রূপ ভাব তরঙ্গের উত্থান-পতন হচ্ছে তার কোন সীমা সংখ্যা নেই। সাগর তরঙ্গ সংকুলান না হলে স্বভাবতই তাতে যেমন একটি কল্লোলের বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় তদ্রুপ মানবের হৃদয় সাগরেও ঐ সকল ভাব তরুঙ্গের উত্থান-পতনের যে কল্লোল বা ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাকেই সূর বরা হয়। আর সূরের ধর্ম হলো স্বীয় সম্মোহীন শক্তি দ্বারা অনত্মরকে আকৃষ্ট করা। বিভিন্ন ভাবানত্মরের সৃষ্টি করে। এ জন্যই দেখা যায় কোন কোন সূর সঙ্গীত পরিবেশনে শ্রোতা আনন্দিত হয়,কোনটিতে অশ্রু বর্ষণ করে,আবার কোনটিতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। আবার কোন কোন সূর সঙ্গীতে শ্রোতা ভাবে বিভোর হয়। তাছাড়াও লক্ষ করা যায় অনত্মরাত্মা যখন দু:খ তরঙ্গে আলোড়িত হয় তখন কষ্ট দিয়ে যে সূর নির্গত হয় তা দু:খ ব্যঞ্জক,আর হৃদয় সুখ তরঙ্গে উদ্বেলিত হলে তখন যে সূর নির্গত হয় তা মনোহর ও আনন্দ চিত্ত হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতই সূর প্রিয়। সুন্দর ফুল দেখলে দৃষ্টি যেমন সে দিকে নিবন্ধ হয়,সূর শ্রবণে অনত্মরও তেমন আকৃষ্ট হয়। পবত্র কোরআনে করীমও সুন্দর,সুললীত,মার্জিত সূরে পাঠ করার নির্দেশ রয়েছে। যেমন হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেঃ “লাইছা মিন্না মানলাম ইয়াতাগান্না বিল কোরআন” অর্থাৎ যে কোরআনকে সুললীত সূরে পাঠ না করে সে আমাদের দলভূক্ত নয়।” অর্থাৎ তোমরা কোআনকে তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা অলংকৃত কর। পবিত্র কোরআন শরীফের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তা কবিতার ছন্দে বর্ণিত এবং ছন্দ ও সূরের মাধ্যমে পাঠ করার নির্দেশ দানের উদ্দেশ্য হলো;সূর বিহীন কর্কশ ষ।ভলৈ কালঅমে পাক পাঠ করলে শ্রোতার মন বিষায়িত হয়ে উঠতে পারে এবং পাক কালামের সৌন্দর্য্য এবং মহাত্ম খর্ব তথা অবমাননা করা হবে। মানব হৃদয়ের সাথে সূরের বন্ধন খুব অমীয় ও নিবিড়। মানব মাত্রই বিরহী বিরহ থেকে আসে ভাব এবং ভাবের বহি:প্রকাশই হলো সূর। সূফী কুল শিরমনি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রাহঃ) বিশ্ব বিখ্যত “মসনবী” শরীফের সূচনা করেছেন মানব বিরহের কাহিনী কর্ণনার মাধ্যমে। যেমন মসনবী শরীফের প্রথম শ্লোক হচ্ছে:অর্থাৎ বাঁশরী কি অবস’া বর্ণনা করতেছে কান পেতে শুন! সে বাঁশী বিরহ বিচ্ছেদের অভিযোগ করতেছে।” এখানে বাঁশী বলতে মানুষের রূহকে বুঝানো হয়েছে। রূহ হলো পবিত্র ও নূরানী জিনিস। তাঁর আদি বাস “আলমে আরওয়াহ” রুহের জগতে বিরহ বিচ্ছেদ বলতে রুহের জগত হতে মানব দেহে অবস’ানের কথা বলা হয়েছে। রুহ চিল সম্পূর্ণ পুতঃপবিত্র ও স্বাধীন। কিন’মানব দেহে এসে পার্থিব কামনা বাসনা তথা দুনিয়ার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে বন্দী হয়েছে এবং উর্ধ্ব জগত হতে তথা ঐশী সত্ত্বার সান্নিধ্য হতে রুহ নিম্ন জগতে তথা এ ধরাধামে অবতরণ করেছে। সূফী সাধক,পূণ্যাত্মা মহা মনীষীগণ যাদের অন-র দৃষ্টি প্রখর ও কামেল পীরের দিক্ষা ও ছোহবতে অন-র হতে গাফলতির পর্দ্দা অপসারিত হয়েছে তারাই হৃদয় বা আত্মার বিরহ বিচ্ছেদ অনুভব করতে পারেন। আর যে মানব তা উপলদ্ধি করতে পারে না তাকে ধিক্কার দিয়ে সূফী সম্রাট রুমী (রহঃ) বলেন বাশীর (আত্মার) এই সূর অগ্নি সুলঙ্গ;মৃদু সমীরণ নহে,এই অগ্নি যার মধ্যে নেই তার মৃত্যু শ্রেয়।” সূফী সম্রাট রুমী (রহঃ) মানবাত্নাকে বাশীর সাথে তুলনা করার একাধিক কারণ রয়েছে। যেমন তিনি আহলে ছেমা বা গান বাদ্য প্রিয় ছিলেন। বাশীর সূর শুনলেই তার আজদ বা ভাবাবেশ অবস’া দেখা দিত এই অবস’ায় তিনি ইন্দ্রীয় জ্ঞান বর্হিভূত অনেক কিছু দেখতে,জানতে ও শুনতে পেতেন। তার থেকে প্রবর্তিত ত্বরীকার জ্ঞান হলো:মৌলভীয়া তরীকা’ এই তরীকায়ও গান বাদ্যের মাধ্যমে ঐশী প্রেমে বিভোর হওয়ার প্রচলন আছে। তাছাড়া মানবাত্মাকে বাশীর সাথে তুলনা করার বিশেষ বিশেষ কারণ হচ্ছে;বাশী ছয় ছিদ্র বিশিষ্ট হয়ে থাকে এই ছয় ছিদ্র দিয়ে ছয় প্রকার রাগ বা সূর নির্গত হয়। এক একটি রাগ এক একটি জিকিরের সমতালে ধ্বনিত হয়। তদ্রুপ মানুষের হৃদয় রাজ্যে ছয়টি লতিফা রয়েছে। ক্বলব,রুহ,ছের,খকি,আখফা ও নফছ এই ছয়টি লতিফা বা ষড় পদ্ম মানুষের অভ্যন-রে বিরাজমান আছে। ত্বরীকত সাধনা ও মুর্শিদের সাহায্যে লতিফা গুলোর পরিশুদ্ধি লাভ করে জিকির জারি হয়ে থাকে। সঙ্গীতের ছয় রাগ তা সূরের সাথে ছয় জিকিরের গল মিলে বলেই সঙ্গীত শ্রবণে হৃদয়বান মানুষের হৃদয় অপূর্ব অবস’ার প্রকাশ পায়। শিশু সন-ান যেমন পিতাকে খুজে না পেলে বাবা,বাপ,আব্বা ইত্যাদি বলে ক্রন্দন সুরে ডেকে তালাশ করতে থাকে। আল্লাহ প্রেমিক হৃদয়বান মানুষও তদ্রুপ আল্লাহ তায়ালা হতে বিচ্ছেদের অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার পর হৃদয়ে বিরহ অনল সতেজ হয়ে তাদের হৃদয়সি’ত ছয় লতিফা হতে আল্লাহ সম্বোধন সূচক ছয়টি জিকির ছয় রাগের সহিত সমতালে ঘোষিত হয়ে থাকে। আর এ জন্যই মাওলানা রুমী (রাঃ) মানবাত্মা বা হৃদয়কে খোদায়ী বাশরী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা বাশী যেমন ফুৎকারের মাধ্যমে তার ক্রিয়া প্রকাশ করে তদ্রুপ আল্লাহপাকও মানব দেহে রুহ ফুকেছেন যেমন কোরআন পাকে বর্ণিত হয়েছে “ফানাফাখতু ফিহী মির রুহী” অর্থাৎ তার ভিতরে আমার থেকে রুহ ফুকলাম। আর তখনই মানবের ইন্দ্রীয় ক্রিয়ার বিকাশ ঘটল। প্রকৃতপক্ষে বাসত্মবিকই! সূরের ভিতর যে একটি আস্বাদ বা গুণ বর্তমান আছে তা সহজেই অনুমেয় এবং তা অস্বীকারও করা যায় না। সূরের মধ্যে যদি কোন রকম স্বাদ বা গুণ বর্তমান না থাকত তাহলে উহা অন-রকে আকৃষ্ট করতে পারত না। ক্রন্দনরত শিশু সুরের ঝংকারে সম্মোহিত হয়ে ক্রন্দন ভুলে যায়। কৃষক পল্লী গীতির সূর সুধা পানে ক্লানি- দূর করে। অন্ধকারে সঙ্গীহীন পথিক মন থেকে ভূতের ভয় দূর করার জন্য সুখের জাল বিস-ার করে। সূরের বারিধারায় শোকাতুরের শোকাগ্নি নির্বাপিত হয়। আর মহা সত্যের (স্রষ্টার) প্রেমিক তাপস সুরের পাখায় ভর করে আধ্যাত্মিক পথে ধাবিত হয় প্রিয়তমের মিলনে তীব্র আকাংখা বুকে নিয়ে। সূর যে কেবল মানব অন-রকেই আকৃষ্ট করে তা নহে তা জীব জন’র অন-রকেও প্রভাবিত করে। যেমন হযরত দাউদ (আঃ) যখন সুমিষ্ট সূরে “জাবুর” কিতাব পাঠ করতেন সেই সূরে মুগ্ধ হয়ে শুধু মানবকুল কেন,পশু পাখী এমনকি নদীর মৎস সমূহও সব কিছু ভুলে গিয়ে সে সূরের মাধুর্ষতা উপভােগ করত। বিষধর সর্প সূরের প্রভাবে তার হিংস্র স্বভাব পরিহার করে সূরের তালে হোলে দোলে খেলা করে। আর তাই বীণ বাজায়ে সর্পকে হস-গত করা হয়। উট চালকের সূরে মুগ্ধ হয়ে ভারী ভারী বোঝা বহন করে নিয়ে যায়। ঘন্টার ধ্বনি শুনে হাতী আনন্দে তালে তালে পা ফেলে চলে যায়। বস’ত সুরের ভিতর এমনই এক পবিত্র আস্বাদ বা আকর্ষণীয় গুণ বর্তমান আছে যা হৃদয়ের যাবতীয় কুলষতা দূর করে মন প্রাণকে আকৃষ্ট করে থাকে। রাসুলে খোদা (দঃ) সঙ্গীত উপভোগ করতেন এবং সুর তাকে আকৃষ্ট করতো। যেমন হুজুর (দঃ) হাসান বিন সাবিত (রাঃ) এর জন্য মসজিদে মিম্বর স’াপন করে এবং সেই মিম্বরে উঠে হাসান বিন ছাবেত (রাঃ) হুজুর (দঃ) এর গৌরব ও সৌভাগ্যের কবিতা মধুর কন্ঠে আবৃত্তি করতেন,এমনকি হুজুর (দঃ) তার কন্ঠে বিমগ্ধ হয়ে স্বীয় চাঁদর উপহার দিয়েছেন। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে একবার রাসূল পাক (দঃ) এর দরবারে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এসে বললেন:ইয়া রাসুল্লাল্লাহ আপনার গরীব উম্মতগন ধনী উম্মতগন হতে অর্ধ দিবস পূর্বে (যা এ দুনিয়ার পাচশত বৎসরের সমান) বেহেশতে গমন করবে। ইহা শ্রবণে রাসূলে খোদা (দঃ) অত্যন- আনন্দিত হযে উপসি’ত সাহাবাগনকে লক্ষ্য করে বললেন-“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে আমাকে গান শুনাইতে পার? জনৈক বদবী (গায়ক) বলল,আমি শুনাইতে পারি। তখন সে নিম্নোক্ত গানটি পরিবেশন করল-কাব্যানুবাদঃ দংশিয়াছে প্রেম স্বর্প হৃদয়ে আমার,নাহি ডাক্তার আর নাহি মন্ত্রকার,কিন’মন প্রাণ বিধি সকাশে যাহার,দাওয়াই আর মন্ত্র মোর আছে অনিবার” উক্ত গান শ্রবনে রাসুলে খোদা (দঃ) অজুদ বা ভাবাপন্ন অবস’ায় হেলতে দুলতে লাগলেণ,উপসি’ত সাহাবাগণও তাই করতে লাগলেন। এমনকি এমন ভাবাপন্ন অবস’ায় পৌছেছিলেন যে রাসূলে পাকের উভয় কাঁধ মোবারক হতে চাঁদর মোবারক খসে জমীনে পড়ে যায়। যখনই এই মহানন্দা পবিত্র নৃত্য সমাপন হলো,প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম স্বীয় স’ানে বসলেন। তখন আবু সূফীয়ানের পুত্র হযরত মা’বীয়া (রাঃ) বললেন-“মা আহছানা লা’বুজুম ইয়া রাসুলাল্লাহ” অর্থাৎ ইয়া রাসুলাল্লাহ্ আপনাদের খেলা (নৃত্য) কি সুন্দর। প্রতি উত্তরে হুজুর পাক (দঃ) বললেন-যে কেহ প্রিয়তমের স্মরণে গানে অনুরূপ না হয় সে ভদ্র নহে।” পরে উপসি’ত সাহাবায়ে কেরামগণ রাসুলে পাকের উক্ত চাঁদর মোবারকখানা তবারুক হিসেবে চারশত টুকরায় ভাগ করে নেন। এতে প্রতিয়মান হয় যে উপসি’ত সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা ছিল চারশত। (তাফসীরাতে আহমদীয়া ৬০২ পঃ) হযরত খালদ বিন জাকওয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত হযরত বোরাই বিনতে মুয়াজ বর্ণনা করেন- আমি যখন স্বামী ঘরে নতুন বিবাহিতা হয়ে প্রবেশ করলাম তখন রাসূল (দঃ) এসে আমার বিছনায় এমন ভাবে বসে গেলেন যেমন তুমি আমার নিকট বসেছে। আমাদের পরিবারের নব যুবতীয়া দফ (ঢোল) বাজাইতেছিল। এবং আমাদের পূর্ব পুরুষগন যারা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদের বীরত্বের গান করতেছিল। তাদের মদ্যে একজন গাইতে লাগল,“আমাদের মধ্যে এমন একজন নবী আছেন যিনি ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন। “তখন হুজুর পাক (দঃ) ইহা না গেয়ে পূর্বে যা গাইতেছিলে তাহাই গাও।” (বুখারী ও তিরমিজি শরীফ) শুধুমাত্র রাসুলে খোদা (দঃ) এর সঙ্গীত প্রিয়তার নিদর্শণ হিসেবে উল্লেখিত হাদীস দ্বয়ের উল্লেখ করা হলো। মাইজভান্ডারী সঙ্গীত মানবের অন-ঃকরণে আল্লাহ ও রাসূল (দঃ),আহলে বায়াতে রাসূল,আউলিয়ায়ে কেরামগনের মহব্বত বাড়ায়,দুনিয়ার মহব্বত কমিয়ে দেয় এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এরূপ সঙ্গীত মানবের জন্য অত্যন- উপকারী। অন্যান্য এবাদত বন্দেগীর সময় চির শত্রু শয়তানের প্ররোচনায় মনের একাগ্রতা ঠিক রাখা খুবই কঠিন। কিন’ত্বরীকত পন’ীদের ছেমা বা সঙ্গীত এমনই এক ইবাদত যা অন্য সব দিক থেকে মন প্রাণকে ফিরায়ে আল্লাহ রাসূল ও আপন পীর মুর্শীদের দিকে রজ্জু রাখে। কারণ সূর মানব হৃয়কে গভীর ভাবে আকৃষ্ট করে একাগ্রতা এনে দেয়। যার হৃদয়ে সূরের সুজ্ঞান সৃষ্টি হয় সে কখনো নিষ্ঠুর প্রকৃতির হতে পারে না। সূরেলা অন-রে বিরাজ করে কোমলতা। আর সেথায় প্রবাহিত হয় নির্মল প্রেমের বর্ণনা। এই প্রেম প্রাথমিক স-রে সীমাবদ্ধ থেকে সৃষ্টির ভিতরে তার সসীমকে লংঘন করে গতিশীল হয়ে পড়ে রহস্য পূর্ণ অসীমের পথে। এই পথের প্রেমিক স্বার্থক পরিণতি লাভ করে সুমহান প্রেমস্পদের মাঝে নিজ সত্ত্বা বা আমিত্ত্বকে বিলীন করে। এ জন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন মহাপুরুষগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে,অমূল্য স্বগীয়দান সমূহের মধ্যে “সূর” তথা গান একটি বিশিষ্ট স’ানের অীধকারী এবং সৃষ্টিকর্তার গোপন রহস্যাবলীর অন্যতম। ভালবাসার অগ্নি শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে সূর অত্যন- ক্ষমতাবান। যারা একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন,ইহা শতসিদ্ধ যে,আল্লাহ তাযালা কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। কিন’তিনি বান্দার প্রেম কামনা করেন। যা আল কোরআনকে নিয়ে গভীর গবেষণা করলেই সহজে অনুমেয় হয়ে উঠে। এজন্যই যে কোন এবাদতই হোক না কেন তা প্রেম রসে সিক্ত না হলে,প্রেমের মহাজন তা কবুল করেন না। কারণ বিশ্ব সৃষ্টির মূল রয়েছে পবিত্র প্রেমের অদম্য প্রেরণা। হাদীস কুদীতে তার সাক্ষ্য বহন করে। “কনতু কানজান মুখফিয়ান ফা আছবাবতু আন উরাফা ফা খালাকতুল খালকা লে উরাকা” অর্থাৎ আমি গুপ্ত ধন ডাক্তার স্বরূপ ছিলাম অতঃপর প্রেমাবেশে প্রেসাসক্ত হয়ে নিজেকে নিজে পরিচত করার জন্য এই সৃষ্টি মালার সূচনা করলাম যেন তারা আমাকে চিনে।
সূফীয়ে কেরাম প্রেমকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেনঃ ১. এশকে হাকীকী যা ঐশী প্রেম বা খোদা প্রেম।
২.জাগতিক প্রেম যেমন স্বামী স্ত্রী,মা বাবা ভাই বোন ইত্যাদি। ৩. এশকে ফাসেকী বা নিন্দনীয় প্রেম যা খোদা প্রেমের প্রতিবন্ধক।
এখানে যে প্রেমের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে এশকে হাকীকী বা খোদা প্রেম। যার মন পুত:পবিত্র পার্থিব কামনা বাসনার উর্ধ্বে তার জন্যই প্রেম,ঐশী প্রেমই প্রকৃত প্রেম। আর কোমল অন-ঃকরণ হলো এ প্রেমের উৎস। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে সেই প্রেমাগ্নি সুপ্ত অবস’ায় বিরাজ করে। যেমন পাথরে অগ্নি লুকায়িত থাকে ঘর্ষণে প্রকাশ পায়। তেমনি যখন কোন খোদা প্রেমিক আশেক ভক্তের সম্মুখে ঐশী ভাবাপন্ন গান,গজল বা সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় তখন তার হৃদয়ের সুপ্ত প্রেমাগ্নি জ্বলে উঠে এবং স্রষ্টার প্রেমে আত্মহারা হয়ে যায়।
ইমাম গাজ্জালী (রাঃ) এহইয়াউ উলুমুদ্দিন’ কিতাবে লিখেন “যার অন-রকে সঙ্গীতে আকৃষ্ট করে না,সে নীচের পতিত স্বভাবের অধিকারী ,রুহানীয়ত হতে বঞ্চিত ও কুট চরিত্র বিশিষ্ট অনির্মল অন-ও,ভ্রষ্ট্র ও পাখীসমূহ হতেও নীচু এবং যাবতীয় পশু হতেও ঘৃণিত।” সূফী সম্রাট আল্লামা রুমী (রাঃ) বলেন-ছেমা বা সঙ্গীত হলো আশেকদের হৃদয়ের খোরাক।’
পীরানে পীর দস-গীর গাউছুল আযম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) নামক কিতাবের ১২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন “নিশ্চয় ছেমা বা সঙ্গীত কারো জন্য ফরজ,কারো জন্য সুন্নাত কারো জন্য বিদয়াত।” আল আনওয়ারোর রাহমানিয়া ফি তরীকাতিল কাদেরীয়া কাছনেজানীয়া কিতাবের ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-সর্বপ্রথম জিকিরের মজলিসে তবলা নামক বাদ্য বাজনা পীরানে পীর দস-গীর গাউছুল আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) প্রচলন করেন। উল্লেখ্য যে,গাউছুল আজম আবদুল কাদের জিলানীর (রাঃ) দরবারে প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বাদে এশা প্রত্যেক জু’মার নামাজের পর এবং প্রতি বৎসর রবিউসসানীর ১১ তারিখ ওরশ শরীফে ছেমা বা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে সঙ্গীত,জিকির আজকারের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমি বিগত ১৯৯৮ হতে ৯৯ সাল পর্যন- বাগদাদ শরীফ লেখাপড়া করা অবস’ায় সাপ্তাহিক মাহফিল ও ওরশ শরীফে শরীক হয়ে ধন্য হয়েছি। এবং ২০০০ হতে ২০০৫ সাল পর্যন- মিশর আল্ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। সেখানে ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর পবিত্র ছের মোবারকের মাজার শরীফ যা আযহার বিশ্ব বিদ্যালয়ে সম্মুখে অবসি’ত লেখা আছে সরকারীভাবে ৭ দিন ব্যাপী ওরশ শরীফ হয় এবং মিশরের শ্রেষ্ঠ কাওয়াল গান বাদ্য বাজনার দ্বারা ছেমা বা কাওয়ালী মাহফিল করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন অলী আল্লাহপাকের দরবারে বাদ্য বাজনা সহ ছেমা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গীতের সূর ও বাদ্যবাজনার তালে অসংখ্য ভক্ত অনুরক্ত খোদার প্রেমে বিভোর থাকে,নৃত্য থাকে আল্লাহর জিকিরে। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন হতেই সূর ও সঙ্গীত মানব হৃদয়ের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান সমাজ অপসংস্কৃতির করাল গ্লাসে নিমজ্জিত। মানব চরিত্র অপসংস্কৃতির ছোয়ায় ধ্বংসের অতল গহ্বরে চলে যাচ্ছে। ঠিক সে সময়ে মাইজভান্ডারীয়া ছেমা সংগীত ইসলামী সংস্কৃতি যদি সমাজের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে পৌছানো যায়,তাহলে পরিবার,সমাজ,দেশ অপসংস্কৃতির কালো হাত হতে রেহাই পাবে এবং মানব মন আল্লাহ প্রেমে বিভোর থাকবে। নেমে আসবে দেশে,সমাজে ও পরিবারে সুখ,শানি- ও সমৃদ্ধি,মুক্তি পাবে আখেরাতে। আল্লাহপাক মাইজভান্ডারী সূর সঙ্গীত সমাজে প্রতিষ্ঠা করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
No comments:
Post a Comment