Monday, July 4, 2016

কোরানে 'কতল' by সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী


কোরানে 'কতলঃ 
যে সকল সাধকগণ আল্লাহ্‌র পথে অগ্রসর হইবার জন্য কতল কর্মে আত্মনিয়োগ করেন আল্লাহ তাহদের কর্মসমূহকে বিপথগামী করেন না। বরং তাহাদের সকল কর্ম সঠিক পথে চালিত হয়। কতলের অপর নাম সেরাতুল মোস্তাকিম। কতল কর্ম দ্বারাই সেরাতুল মোস্তাকিম(*1) প্রাপ্ত হওয়া যায়। কতল কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রধান উপায়। সাধকের জন্য ইহা অবশ্য করণীয় বিষয়। সাধনার এই পদ্ধতি জালালি নয় বরং সম্পূর্ণ জামালি; যাহাদ্বারা ‘জামালে মোহাম্মদ’ অর্জিত হয়।
কোরানের ‘কতল’ শব্দটি যদি হত্যা অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহা হইলে মোমিন অপেক্ষা অসুর প্রকৃতির নির্দয় লোকেরাই এই কর্মের জন্য অধিক যোগ্য বলে বিবেচিত হইত। মোমিনগণকে কতল কর্মে উৎসাহিত করিবার কোন সার্থকতা বা যৌক্তিকতা থাকে না।
আল-কোরানের অঙ্কতি এবং মহানবীর অনুসৃত কতল কর্ম যদি জগতবাসী গ্রহণ করিতে তাহা হইলে আমরা যুদ্ধমুক্ত এবং আত্মশুদ্ধিমূলক জেহাদের মহিমায় মহিমান্বিত একটি পৃথিবী দেখিতে পাইতাম।
মোহাম্মদী-স্তর আল্লাহ্‌র কর্তৃক প্রশংসিত সর্বোচ্চ মানের স্তর। এই স্তরে পৌঁছিতে চাহিলে হেরাগুহার দায়েমি সালাতের আদর্শকে গ্রহণ করিয়া তথা কতল কর্মে আত্মনিয়োগ করিয়া দেহরাজ্যের ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত প্রতিটি ঘটনা যাহাই ঘটিয়া থাকে বা অনুভূত হইয়া থাকে তাহা পুংখানুপুংখরূপে এক এক করিয়া দর্শন এবং উহার মোহ বর্জন করিয়া আত্মজ্ঞানে জ্ঞানী হইতে হইবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র পথের পথিক ব্যতীত বিশ্বের সকল মানুষ আপন সৎকর্মকে শোভন ও সুন্দর মনে করিয়া থাকে। এবং উহার মোহ-কালিমায় আবদ্ধ হওয়ার অপকারিতার কথা ভাবিয়া দেখে না। এই কারণে তাহারা অসীমভাবে প্রবৃত্তির অনুসারী হইতেছে।      
                                               
“এবং যখন তোমরা একটি নফসকে কতল কর তখন তোমরা ইহার মধ্যে (অর্থাৎ এই নফসের মধ্যে) ব্যাপ্ত লাভ কর। এবং আল্লাহ্‌ বাহির করেন যাহা তোমরা গোপন করিয়া রাখ। সুতরাং আমরা বলি ইহাকে (অর্থাৎ নফসকে) আঘাত কর ইহার ব্যতিক্রম আর একটি দ্বারাঃ এইরূপেই আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদিগকে তাঁহার পরিচয় দেখাইয়া থাকেন যেন তোমরা বুদ্ধি খাটাইতে পার। তারপর ইহার পরেও তোমাদের হৃদয় কঠিন হইয়া যায় সুতরাং ইহা হইয়া উঠে পাথরের মত কঠিনতর। এবং নিশ্চয় পাথরের মধ্যে এমনও আছে যাহা হইতে প্রবাহিত হয় নহর। সুতরাং অবশ্য ইহা হইতে অবশ্য যাহা পতিত হয় আল্লাহ্‌র ভয়ে। অলস অমনোযোগী ব্যাক্তিগণ যে কর্ম করে আল্লাহ্‌ তাহার সঙ্গে থাকে না (বাকারাঃ৭২-৭৪) 
 
ব্যাখ্যাঃএকটি নফস(*2) যখন ‘লা’ (না) এর অনুশীলন দ্বারা সমস্ত কর্মে লা-ময় হইয়া ক্বাফ-শক্তি অর্জন করে তখন সেই নফসটি ‘কতল’ হইয়াছে বলা হয়। যখন নফস কতল হয় তখন সেই নফস নিজের মধ্যে যেমন আনন্দে উৎফুল্ল থাকে তেমনই অন্য লোকেরাও তাহাতে আনন্দে উতফুল্ল হয়। তাঁহার রব তাঁহার তখন উন্মুক্ত। রবের গোপন অবস্থা হইতে বাহির হইয়া আসা আল্লাহই সম্পন্ন করেন।
তাই উচ্চতম পরিষদের আদেশঃ “হে ইনসান (*3), তোমরা নিজের নফসকে আঘাত কর (কতল হইবার জন্য)।” এই আঘাত একটি ব্যতিক্রমী নফস দ্বারা অর্থাৎ কতলকৃত নফস দ্বারাই করিতে হয়। ইহাই মৃতকে জীবিত করিবার অর্থাৎ মানবকে মহামানব পরিণত করিরাব প্রক্রিয়া, যাহার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁহার পরিচয় দান করিয়া থাকেন। অতএব “হে সাধারণ মানুষ, তোমরাও বুদ্ধি বিবেচনা দ্বারা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নাও এবং বুদ্ধ হও।”
‘নফস কতল করা’ বিষয়টি চিরন্তন। অথচ মানুষ তাহার পরেও বিবেকহীন কঠিন হইয়া পড়ে। এই পাথর-সদৃশ কঠিন নফস হইতেও জ্ঞান প্রবাহের সূচনা হইতে পারে। নফসের নফসানিয়াত ভাঙ্গিয়া গেলে এখান হইতেই অসীম জ্ঞানবারী প্রবাহিত হয়। এই জাতীয় নফসের সমস্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণতা তথা ইহার কাঠিন্য একে একে পতিত হয় এবং তাহা আল্লাহরই ভয়ে আল্লাহ্‌র জন্য। আর তাই একই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে অলস ও অমনোযোগী, তাহাদের কর্মের সহিত আল্লাহ্‌(*4) থাকেন না বা ‘আল্লাহ্‌ গুণ’ বিরাজ করে না। (দ্র. বাকারাঃ৭২-৭৪)
 
“হে আজীবনের আমানুগণ, কতলের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তোমাদের উপর কেতাবস্থ করা হইল (অর্থাৎ দেহস্থ বা স্বভাবস্থ করা হইল)। স্বাধীনের সহিত স্বাধীন, এবং দাসের সহিত দাস, এবং নারীর সহিত নারী। তারপর তাহার ভাই যদি কোন বিষয়ে তাহাকে স্নেহের ক্ষমা করে অতঃপর (যদি) জ্ঞানের সহিত ধর্ম দর্শনে অনুগত হয় এবং অসীমভাবে তাঁহার দিকে পরিশোধ দান করে এহসান দ্বারা (অর্থাৎ সালাতের সৌন্দর্য দ্বারা); তবে ইহা তোমাদের রব হইতে একটি লঘু করণ (বা হালকা করণ) এবং একটি রহমত। এইরূপ হইবার পরও যদি কেহ এর অতিরিক্ত (বা বেশী) আকাঙ্ক্ষা করে তবে তাহার জন্য জ্বালাময় শাস্তি। এবং তোমাদের জন্য আল কেসাসের মধ্যে (অর্থাৎ এইরূপ বিশেষ প্রকার প্রতিশোধের মধ্যে) জীবন রহিল। হে আজীবন জ্ঞানীগণ, যেন তোমরা কর্তব্যপরায়ণ হইতে পার।(বাকারাঃ১৭৮+১৭৯) ”
ব্যাখ্যাঃ ‘কেসাস অর্থ’ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া, ফিরাইয়া লওয়া। কতলের প্রচলিত অর্থ হত্যা করা, ‘কতল’ শব্দটির দার্শনিক অর্থ হইল---কোনও ব্যক্তিকে সালাত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মরার আগে মৃত্যু দান করা অর্থাৎ ক্বাফ-শক্তি দান করিয়া তাঁহাকে অমর করিয়া তোলা।
‘লাম’ দ্বারা বুঝায় ‘লা’। ‘তে’ দ্বারা বুঝায় বিস্তার। ‘ক্বাফ’ দ্বারা বুঝায় ক্বাফ-শক্তি। সালাতের ‘লা’ প্রক্রিয়া সপ্ত ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটির উপর বিস্তার সাধন করিলে কাফ-শক্তি অর্জিত হয়। ইহাকে বলা হয় ‘কতল করা’।
সংস্কার বা ধর্মরাশিকে সালাতের সাহায্যে ‘লা’ অর্থাৎ মহাশূন্যতার মধ্যে লইয়া আসিলে সাধক যে ক্বাফ-শক্তি অর্জন করে উহাই ধর্মরাশির প্রকৃত প্রতিশোধ। ধরমরাশি মানুষকে জন্মচক্রে আবদ্ধ করিয়া ডুবাইয়া মারিতেছে। ‘লা’ এর প্রতিশোধ ব্যতীত কেহই ইহার প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। জ্ঞানী সাধকগণ ধর্মের প্রতি যেইরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া থাকেন তাহা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করিয়া অনন্ত জীবন লাভ করেন।
‘কতল’ প্রক্রিয়া সাধকের মুক্তিপথের একমাত্র সহায়ক পদ্ধতি। হত্যার প্রতিশোধ হিশেবে হত্যা না করিয়া যদি হত্যাকারীকে স্নেহের ক্ষমা করিয়া তাঁহাকে কতল করা হয়, তাহা হইলে বাঁচিবার তাগিদে অবশ্য সে কতল কর্মের বাধ্যতামূলক অবস্থায় রাজি থাকিবে। মোমিনদের দ্বারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এইরূপ ব্যবস্থা রাখিলে কোন দেশের সঙ্গেই বৈরী ভাব থাকে না।
আরবদের মধ্যে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের রীতি প্রবল ছিল। যে কারণে প্রতিশোধমূলক হত্যা করিবার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইত। এই বাক্য দ্বারা তাহা সংযম ও সীমিত করিবার ব্যবস্থা দেওয়া হইল। ইহাতে ক্ষমার ব্যবস্থা রহিল। একান্ত যদি ক্ষমা করা উচিত বা সম্ভবপর না হয়, তবে সমপরিমাণ প্রতিশোধের ব্যবস্থা দেওয়া হইল, যাহাতে হত্যার প্রতিশোধমূলক শত্রুতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি না পায়। এই ব্যবস্থা দ্বারা হত্যা সীমিত হইবে এবং রহমত বৃদ্ধি পাইবে। অতএব যাহারা এই বিধান এড়াইয়া যাইবে  তাহাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
১৭৯ নং বাক্যে জ্ঞানীগণকে লক্ষ্য করিয়া বলা হইতেছে যে, কেসাসের বিধান পালন করিলে হিংসাত্মক হত্যা বন্ধ হইবে এবং সমাজ জীবন্ত হইয়া উঠিবে। ফলত আল্লাহ্‌র প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা বৃদ্ধি পাইবে। এই বিধানের গুরুত্ব জ্ঞানীগনই কেবল উপলব্ধি করিয়া থাকেন।
বাক্য দুইটির প্রচলিত সামাজিক ব্যাখ্যা পেশ করা হইল। সংক্ষেপে প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা নিন্মরূপঃ সাধকগণকে বলা হইতেছে, ‘কতলের মধ্যে কেসাস তোমাদের উপর কেতাবস্থা করা হইল। হে পরিপূর্ণ জ্ঞানীগণ, তোমাদের জন্য কেসাসের মধ্যে জীবন রহিল যেন তোমরা (গুরুর) কর্তব্য পালন করিতে পার।
সংস্কার বা ধর্মরাশিকে ‘লা’ অর্থাৎ মহাশূন্যতার মধ্যে লইয়া আসিলে সাধক যে কাফশক্তি অর্জন করে উহাই ধর্মরাশির প্রকৃত প্রতিশোধ। ধর্মরাশি মানুষকে জন্মচক্রে আবদ্ধ করিয়া ডুবাইয়া মারিতেছে। ‘লা’ এর সাধক ব্যতীত কেহই ইহার প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। জ্ঞানীগণ এবং সাধকগণ যেইরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া থাকেন তাহা দ্বারা মৃত্যুকে জয় করিয়া অনন্ত জীবন লাভ করেন।
নিজ জীবনে কতলের অনুশীলন করিয়া যাহারা মৃত্যুঞ্জয়ী হন তাঁহারাই কেবল গুরুর কর্তব্য পালনের যোগ্যতা অর্জন করিতে পারেন। ইহার অন্য কোন বিকল্প নাই। সমাজে শত্রুতা বৃদ্ধির গুরুতর অবস্থাটিকে লঘুকরণ পদ্ধতিতে আনয়ন করিবার জন্য কতলকর্ম প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার মোমিনগণের উপর অর্পিত থাকিবে। তাহারা ব্যতীত কেহই ইহা পরিচালন করিতে সক্ষম নয়। অবশ্য একথা সত্য যে, বিশ্বে কখনও এই অবস্থা প্রচলিত হইতে পারে নাই।
 
#অনুবাদ (২ঃ১৯০) এবং যাহারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাহাদের সহিত যুদ্ধ কর এবং (ইহার) অন্তর্ভুক্ত হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ (ইহাতে) অন্তর্ভুক্তগণকে ভালবাসেন না।
অথবা..............এবং (ইহার) সীমা লঙ্ঘন করিওনা। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীগণকে ভালবাসেন না। (সীমা লংঘন কথাটি ভাবার্থে, শব্দার্থে নয়)।
 
#ব্যাখ্যাঃ 'কতল' শব্দটির অর্থ ব্যাপক। ইহাদ্বারা যেমন সাধারণ অর্থে হত্যা করা বা যুদ্ধ করা বুঝায় তেমনই আবার লা-এর বিস্তার সাধন করিয়া আল্লাহর পথের 'ক্বাফ শক্তি' অর্জন করাও বুঝায়। সাধকের ক্বাফ-শক্তি অর্জনের পথে যাহারা সশস্ত্র বাধার সৃষ্টি করে তাহাদিগকে প্রতিরোধ করিবার উদ্দেশ্যে যেইরূপ জেহাদ  করা আল্লাহর প্রত্যক্ষ নির্দেশ অনুযায়ী একান্ত কর্তব্য, তাহা অবশ্য পালন করিতে হইবে। কিন্তু জেহাদের লক্ষ্য ও সীমা লংঘন করা চলিবে না। প্রয়োজন হইলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করিতে হইবে। কিন্তু জেহাদের লক্ষ্য ও সীমা ও সীমা লংঘন করা চলিবে না। জেহাদ করিতে যাইয়া সাধকগণ যেন যোদ্ধাগণের অন্তর্ভুক্ত হইয়া না পড়ে। নিশ্চয় আল্লাহ যোদ্ধাগণের অন্তর্ভুক্ত হওয়া পছন্দ করেন না। কারণ যুদ্ধ করা আল্লাহর নীতিবিরুদ্ধ। ইসলামী রাষ্ট্রে কোন সেনাবাহিনী থাকিবে না। প্রয়োজন হইলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী (অর্থাৎ মোজাহেদ) গঠন করিতে হইবে এবং উপস্থিত জেহাদ শেষে উহা ভাঙ্গিয়া দিতে হইবে। মহানবীর পরবর্তীকালে এই নীতি পরিত্যক্ত হইয়াছিল। তারপর হজরত আলী এবং ইমাম হাসানের স্বল্প রাজত্বকাল ব্যতীত আর কোন কালেই কোরানের এই নীতি অনুসৃত হয় নাই। "
 
#অনুবাদ (২ঃ১৯১-১৯৩) "এবং যেখানেই তাহাদিগকে ধর, কতল কর এবং যেখান হইতে তোমাদিগকে বহিষ্কৃত করিয়াছে তোমারাও তাহাদিগকে সেখান হইতে বহিষ্কার কর এবং হত্যা অপেক্ষা ফেতনা গুরুতর। এবং তাহাদিগকে মসজিদুল হারামের নিকটে হত্যা করিও না যে পর্যন্ত তাহারা তোমাদিগকে সেখানে হত্যা না করে। সুতরাং যদি তোমাদিগকে কতল কর তবে তোমারা তাহাদিগকে কতল কর। এইরূপ কাফেরদের প্রতিফল।
তারপর যদি তাহারা বিরত হয় তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল রহিম।
এবং তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে থাক, যাবত অশান্তি দূরীভূত না হয়, এবং আল্লাহর জন্য (অর্থাৎ আল্লাহর পথে চলার জন্য) আদদ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। তারপর যদি তাহারা বিরত হয় তবে অত্যাচারীদের উপর ব্যতীত শত্রুতা নাই। "
 
#ব্যাখ্যাঃ এই বাক্যে আল্লাহতা'লা মুসলমানদিগকে তাহাদের আক্রমণকারী শত্রুগণকে সংহার করিবার আদেশ দিয়াছেন। ইহাতে কেহ কেহ কোরানের উপর দোষারোপ করিতে চাহেন; কিন্তু এইরূপ আদেশ আদৌ অসঙ্গত নয়। কারণ যুদ্ধ ঘোষিত বা আক্রান্ত হইবার পর শত্রুগণকে সংহার করা যুদ্ধ নীতির চির অনুমোদিত ও অপরিহার্য বিষয়। যুদ্ধকালে শত্রু বিনাশের অধিকার না থাকিলে কোন জাতিই অস্তিত্ব রক্ষা করিতে পারিবে না। ইসলাম বিদ্বেষী কোরেশরা মুসলমানদিগকে মক্কা হইতে নির্বাসিত এবং বহিষ্কৃত করিয়াছিল। তারপর কাবা গৃহে আসিয়া হজ্ব করিতেও বাধা দিয়াছিল যদিও তাহারাই ছিলেন প্রকৃত তৌহিদবাদী। ইহার ফলে হজ্ব পালন না করিয়াই হুদাইবিয়ার সন্ধি করিয়া ফিরিয়া যাইতে হইয়াছিল। তাই পৌত্তলিকদিগকে বিতারিত করিয়া কাবা গৃহ অধিকার করিবার জন্য মুসলমানদিগকে অনুমতি দিতেছেন। এইরূপে কাবার অধিকার হস্তগত করিবার জন্য মোহাম্মদী মুসলমানদিগকে যুদ্ধ করিবার অনুমতি দেওয়া হইতেছে যতকাল ইহা হস্তগত না হয় এবং অশান্তি দূরীভূত না হয়। এবং জনগণ বিনা বাধায় স্বচ্ছন্দে আল্লাহর ধর্ম পালন করিতে পারে। আল্লাহর ধর্ম পালন করা অর্থ বস্তুমোহ ত্যাগ করিবার অনুশীলন গ্রহণ করা। কাফেরগণ বস্তুবাদী হওয়ার কারণে এইরূপ অনুশীলন গ্রহণে অনিচ্ছুক। শান্তি প্রতিষ্ঠা হইয়া গেলে ধর্মদ্রোহীদের সঙ্গে আর কোন বিরোধ ও শত্রুতা থাকিবে না যেহেতু তাহারা ধর্ম পালন বিষয়ে নিরপেক্ষ হইয়া যাইবে কিন্তু তাহাদের মধ্যকার অত্যাচারী ব্যক্তি বিশেষকে চিরকালই শত্রুরূপে গণ্য করিতে হইবে সামাজিক ফেতনা ক্বাফ-শক্তি অর্জনের পথের অন্তরায়। মহান নেতার নেতৃত্বাধীন যে যুদ্ধ হয় তাহা ক্বাফ-শক্তি অর্জন করিবার পথ সুগম করিবার জেহাদ ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এইরূপ জেহাদ অপেক্ষা ফেতনা অধিকতর মারাত্মক আপদ। অবশ্য কতল বা যুদ্ধ করিবার নির্দেশ সম্যক নেতার নির্দেশে হইতে হইবে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতীত জেহাদ হয় না। যাহা হয় তাহা জেহাদের নামে যুদ্ধ। মোহাম্মদী ইসলাম গ্রহণের পর আরব জাতি 'মসজিদুল হারাম' এর আদর্শ রক্ষা করে নাই এবং ইহার হাকিকত বিনষ্ট করিয়াছে। মুসলমান পক্ষে যুদ্ধ পরিচালক অবশ্য হইতে হইবে আল্লাহর প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তি, তবেই কোন যুদ্ধ বা হত্যাই অন্যায়ভাবে পরিচালিত হইতে পারিবে না। অবশ্য পরবর্তীকালে 'উলিল আমর' শাসকের অভাবে কোরানের আকাঙ্ক্ষিত ন্যায়-নীতি সংরক্ষিত থাকে নাই।
এবং তোমাদের কি হইল যে তোমরা আল্লাহ্‌র পথে কতল করিবে না? এবং দুর্বল পুরুষ এবং অসীম নারীকূল এবং ছেলেমেয়ে যাহারা বলে, হে আমাদের রব, এই শহর হইতে আমাদিগকে বাহির করিয়া নাও যাহার অধিবাসীগণ অত্যাচারী। এবং আমাদের জন্য তোমা হইতে একজন বন্ধু বানাইয়া দাও এবং আমাদের জন্য তোমা হইতে একজন সাহায্যকারী বানাইয়া দাও। (তাহাদের সকলের উদ্ধারের জন্য কি কতল কর্ম করিবে না?(সুরা নেসাঃ৭৫)     
ব্যাখ্যাঃ বিভিন্ন পর্যায়ের অত্যাচারিত মানুষ যাহারা সামাজিক অন্যায় হইতে মুক্তি চায় তাহাদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করা যেমন ন্যায়সঙ্গত বিষয় তেমনই অসীম নারীকূলের মধ্যে যাহারা নারীত্বের চিরবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের জন্য অবিরাম প্রার্থনা করিয়া থাকে, চির দুঃখের বন্ধন হইতে তাহাদের উদ্ধারের জন্য কতল কর্ম করা অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কতল কর্ম ব্যতীত সমাজ পরিশুদ্ধ হয় না।
‘কতল কর্ম’ ব্যাপকভাবে অনুসৃত হইলে মোহযুক্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে বৃদ্ধি পাইবে এবং পাপের মূল উৎস লোভ ও মোহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাইবে।
মদিনায় হিজরতের পরে কিছুসংখ্যক দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশু বিষম অত্যাচারের মধ্যে বসবাস করিতেছিল। হিজরত করিবার সম্বল তাহাদের ছিল না। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়া তাহাদের প্রার্থনা পূর্ণ হইয়াছিল।

যাহারা সাধক তাহারা কতল করে আল্লাহ্‌র পথে আর যাহারা কাফের তাহারা করে বিষয়মোহের পথেঃ সুতরাং আজীবন কতল কর শয়তানের সকল বন্ধুদিগকে। নিশ্চয় শয়তানের সকল বন্ধুদিগকে। নিশ্চয় শয়তানের পরিকল্পনা দুর্বল (সূরা নেশাঃ৭৬)
ব্যাখ্যাঃ আমানু সাধকগণ যুদ্ধ করে আল্লাহ্‌র পথে অর্থাৎ বিষয় মোহ বর্জনের পথে। অপরপক্ষে কাফেরগণ যুদ্ধ করে তাগুদের পথে অর্থাৎ বিষয় মোহ অর্জনের পথে। উভয় ক্ষেত্রে একই কতল শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে। বিষয়-মোহ অর্জনের দ্বারা মন হয় দুর্বল এবং খণ্ডিত। আর বিষয়-মোহ বর্জনের দ্বারা মন আল্লাহ্‌র ক্বাফ শক্তিতে শক্তিশালী হইয়া আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য লাভ করে। ‘কায়দা’ অর্থ পদ্ধতি বা ধারা। একই বস্তুর প্রতি কাফের ব্যক্তির ব্যবহার পদ্ধতি দুর্বল; উহা দ্বারা মনের দুর্বলতা অর্জন করিয়া জীবনকে করে খণ্ডিত এবং সাধকের ব্যবহার পদ্ধতি শক্তিশালী; উহা দ্বারা স্বর্গীয় শক্তি অর্জন করিয়া অখণ্ড জীবনপ্রাপ্ত হয়। তাগুত বর্জনের পথ তথা সালাতের পথ, আল্লাহ্‌র পথ। আর তাগুত অর্জনের তথা বৃদ্ধি করিবার পথ, শয়তানের পথ।
কাফের এবং আমানু উভয়ে শক্তির পূজারী। শক্তিলাভের জন্য কতল করে। একজনের লক্ষ্য বস্তুশক্তি অপরজনের লক্ষ্য মানসিক শক্তি। এখানে ‘কতল করে’ অর্থ শক্তিলাভের প্রচেষ্টায় জীবন যুদ্ধ করে। কাফেরগণ দুনিয়ার অস্থায়ী শক্তি বৃদ্ধি করে মোহময় বিষয়সম্পদ অর্জন করিয়া। আর আমানুগণ চিরস্থায়ী মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে বিষয় সম্পদের পার্থিব মোহ বর্জন করিয়া।

 নিশ্চয় আল্লাহ্‌ মমিনগণ হইতে তাহাদের নফস এবং মাল ক্রয় করিয়াছেন জান্নাতের বিনিময়ে। আল্লাহ্‌র পথে তাহারা কতল করে এবং কতল হয়। ইহার উপরে (স্থাপিত) একটি হক ওয়াদা, তাওরাতে, ইঞ্জিলে এবং কোরানে। এবং কে আপন অঙ্গীকার আল্লাহ্‌ হইতে অধিক হক পালনকারী? অতএব আনন্দিত হও, তাঁহার সহিত তোমরা যে ক্রয়-বিক্রয় করিয়াছ তোমাদের সেই ক্রয়-বিক্রয়ের দ্বারা। এবং উহাই সেই আজমত-ওয়ালা (ক্ষমতাবান) ফয়েজ।(সূরা বারাতঃ১১১)
ব্যাখ্যাঃ কতল (কাফ, তে, লাম)= ‘ক্বাফ’ অর্থ আল্লাহ্‌র ক্বাফ-শক্তি। ইহাতে রহিয়াছে আল্লাহ্‌র ছয়টি শক্তিশালী নামের বা গুণের সমষ্টিগত শক্তি। ‘তে’ অক্ষর দ্বারা বিস্তার বুঝায়। লাম দ্বারা লা অর্থাৎ না বুঝায়। অতএব কতল অর্থ ‘না’ এর বিস্তার সাধন করিয়া ক্বাফ শক্তির অধিকারী হওয়া। মনের মধ্যে মহা শূন্যতা অর্জন করাই কতল করা।
ক্বাফ শক্তি সালাতের সাহায্যে অর্জন করিতে হয়, জাকাত নামক ‘লা’ কর্মের বিস্তার সাধন করিয়া। অর্থাৎ সপ্ত ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটি বিষয়কে নফি করিতে হয়, অর্থাৎ জাকাত করিতে হয়। ইহাই সকল আত্মিক শক্তির মূল উৎস। কতল কর্ম দ্বারা সকল বিভ্রান্তি বিদূরিত হইয়া যায়। কতল যিনি করেন তিনি তাঁহার সকল কর্মের উপর ‘লা’ এর বিস্তার সাধন করিয়া কর্ম করেন আল্লাহ্‌ কখনও তাঁহার কর্মসমূহ বিপথগামী করেন না। ইন্দ্রিয়পথে আগমনকারী সকল বিষয়ের লা-প্রক্রিয়ার বিস্তার সাধন করা ত্যাগ ও ধৈর্য সাপেক্ষ। ‘তে’ অক্ষর দ্বারা বিস্তার বুঝায়। ‘লা’ এর বিস্তার সাধন করিলে আল্লাহ্‌র ক্বাফ গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। একই অর্থে ‘ক্বাফ’ অক্ষরটিকে আল-কোরানে একটি ইঙ্গিতপুর্ন বিরতি চিহ্নরূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। ‘আল্লাহ্‌র পথে কতল কর” এই নির্দেশ আল কোরানে বহুবার ব্যক্ত করা হইয়াছে। কতল কর্ম ব্যতীত আল্লাহ্‌র পথে অগ্রসর হওয়া যায় না।
মোমিনগণ(*5) জান্নাতবাসী। তাহাদের জন্য যে জান্নাত অর্থাৎ আল্লাহ্‌ নিকট ‘আশ্রয় প্রাপ্ত অবস্থা’ তাহা তিনি মোমিনদিগের নিকট বিক্রয় করিয়াছেন বা প্রতিদান করিয়াছেন তাহাদের নফস এবং সমগ্র মালের বিনিময়ে। সমূহ মালের মধ্যে ধর্মরাশি হইল আসল মাল। সকল প্রকার ধর্মরাশির মোহ সালাত ও যাকাতের মাধ্যমে ত্যাগ করা কঠিন বিষয়। ইহাকেই ‘কতল কর্ম’ বলে। মোমিনগণ তাহাদের নফসের অভিব্যাক্তিগুলিকে সালাতের কাজে নিয়োজিত নিয়োগ করিয়া আল্লাহ্‌র ক্বাফশক্তি অর্জনের পথে নিজেরা যেমন আত্মনিয়োগ করেন, অন্য সকলকেও তেমনই কতলের প্রশিক্ষণ দানে সচেষ্ট থাকেন। ইহা তাহাদের উপর আল্লাহ্‌ কর্তৃক আরোপিত নৈতিক কর্তব্য।
কতলের ধ্যান-কর্মের সুফলদান করা বিষয়ে যে ওয়াদা আল্লাহ্‌ করিয়াছেন তাহার সত্যতা অন্য সকল মহাপুরুষের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত আছে। সুতরাং মহানবীর সঙ্গে যাহারা এই প্রকার ক্রয়-বিক্রয় করিয়াছে তাহাদের এই সৌভাগ্যে ও সুযোগ লাভের আনন্দিত হওয়া উচিত। কতল কর্ম প্রচুর ত্যাগ সাপেক্ষ। তাহাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্‌ অবশ্য তাঁহার রহমতের ফয়েজ দান করিয়া আপন অঙ্গীকার পূর্ণ করিবেন। ‘আজমত ওয়ালা ফয়েজ’ অর্থ মানসিক উন্নতিমূলক ফয়েজ।

সুতরাং যখন তোমরা কাফেরদিগের সঙ্গে মিলিত হও (বা সাক্ষাৎ কর) তখন তাহাদিগের গর্দানে আঘাত কর। তাহাদিগকে তোমরা পরাজিত করা পর্যন্ত (আজীবন আঘাত কর), তারপর বন্ধনটি শক্ত কর। ইহার পর হয় বিশেষ অনুগ্রহ নয় তো চিরস্থায়ী মুক্তিপণ যতকাল না যুদ্ধ ত্যাগ করে অথবা ইহার (অর্থাৎ যুদ্ধের) তর্জন গর্জন। ইহাই বিধান। এবং যদি আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেন তবে অবশ্য তাহাদিগ হইতে পাল্টা-ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, কিন্তু তিনি চাহেন তোমাদের কতককে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করিতে। এবং যাহারা আল্লাহ্‌র পথে কতল করে তিনি কখনও তাহাদিগকে কর্মসমূহ বিপথগামী করেন না। (৪৭। সূরা মোহাম্মদঃ৪) 

   
ব্যাখ্যাঃ মোমিন এবং মুসল্লি(*6) ব্যতীত প্রত্যেক মানুষই কম বেশী কাফের। কারণ তাহার মধ্যে অবস্থিত মহাসত্য তাহাদ্বারাই আবৃত হইয়া রহিয়াছে।
যদি এবং যখন কাফেরদেরকে সঙ্গে মোকাবেলা করিতেই হয় তবে আজীবন তাহাদের গর্দানে আঘাত দিবার নির্দেশ দিতেছেন যতক্ষণ তাহারা পরাজয় স্বীকার না করে। ‘কাফেরের গর্দানে আঘাত’ অর্থ অসত্যের মূলে আঘাত হানা। গর্দান মাথাকে ধারণ করিয়া আছে। মিথ্যার আসন মাথা। গর্দানে আঘাত খাইলে মাথা সত্যের নিকট নত হইয়া পড়িবে। মিথ্যার ভিত্তি ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং মোমিনদিগের প্রণীত সত্যের নিকট আত্মসমর্পণ করিবে। আঘাত দেওয়ার এই নির্দেশ মোমিনগণকে দেওয়া হইয়াছে। মোমিন ব্যতীত অন্য কাহারও তবলীগ করা অথবা সশস্ত্র সংঘর্ষ করা নিষিদ্ধ। মোমিন ব্যক্তির নির্দেশ ব্যতীত তাহা করিলে তবলীগ না হইয়া উহা হইবে সীমালঙ্ঘন এবং জেহাদ না হইয়া উহা হইবে যুদ্ধ। যুদ্ধ ইসলামে হারাম। জেহাদ অবশ্য করণীয়। না করিলে কাফের বলিয়া গণ্য করা হয়।
কোরান বলিতেছেনঃ “কাফের পরাজিত হইয়া নতি স্বীকার করিলে তাহাকে তোমাদের নীতির বন্ধনে বাঁধ। তারপর বন্ধনটি ক্রমশ শক্ত কর। তারপর বন্ধন শক্ত হইয়া গেলে সে তোমাদের হইয়া যাইবে। তখন হয় তাহাকে বিশেষ অনুগ্রহ কর অথবা চিরস্থায়ী মুক্তিপণের মধুর সম্বন্ধে আবদ্ধ কর। তাহাদের সঙ্গে শিক্ষামূলক এইরূপ মধুর সম্বন্ধ ততকাল বজায় রাখ যতকাল তাহাদের মন হইতে তথা সত্ত্বা হইতে যুদ্ধভাব নিষ্কাশিত হইয়া যায়।”
মোমিন ব্যতীত প্রত্যেক মানুষের মনেই যুদ্ধভাব অর্থাৎ অন্যের উপর ক্ষমতা প্রয়োগের ভাব সুপ্ত হইয়াই আছে যতকাল সে উহা প্রসব করিয়া না ফেলে। ‘হাত্তা তাদাআল হারবু’ অর্থ যতকাল না প্রসব করে যুদ্ধ। মানব সত্ত্বার মধ্যে যুদ্ধ হামেল হইয়া আছে। মহানবী আসিয়াছেন জগত হইতে ইহাকে প্রসব করাইয়া ফেলিয়া দিতে। ‘জালিকা’ অর্থ উহাই। অর্থাৎ উহাই আল্লাহ্‌ চাহেন বা উহাই আল্লাহ্‌র অভিপ্রেত বিধান। আল্লাহ্‌ দেখিতে চাহেন মোমিন দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধমুক্ত একটি প্রেমময় বিশ্ব।
আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করিলে কাফেরকে শাস্তি দিয়া থাকেন কিন্তু তিনি ‘তোমাদের কতককে’ অর্থাৎ আমানুদের কতককে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করিতে চাহেন, কিন্তু তাহা সাধারণত করেন না। সালাতের তথা ইমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বাস্তব পরীক্ষা ক্ষেত্রে যাইয়া ইমানের পরীক্ষায় পাশ করিয়া আসিতে হয়। কতল কর্মে আত্মনিয়োগ করাই আল্লাহ্‌র নিকট সর্বাপেক্ষা অধিক অভিপ্রেত বিষয়, যেহেতু ইহা ব্যতীত মানুষ মুক্তিপণে অগ্রসর হইতে পারে না। কতল কর্মের সার কথা হইল সালাতের আত্মদর্শন কর্মে গভীরভাবে নিয়োজিত হওয়া।
কতল (কাফ, তে, লাম)= ‘ক্বাফ’ অর্থ আল্লাহ্‌র ক্বাফ-শক্তি(*7)। ইহাতে রহিয়াছে আল্লাহ্‌র ছয়টি শক্তিশালী নামের বা গুণের সমষ্টিগত শক্তি। ‘তে’ অক্ষর দ্বারা বিস্তার বুঝায়। লাম দ্বারা লা অর্থাৎ না বুঝায়। অতএব কতল অর্থ ‘না’ এর বিস্তার সাধন করিয়া ক্বাফ শক্তির অধিকারী হওয়া। মনের মধ্যে মহা শূন্যতা অর্জন করাই কতল করা।
ক্বাফ শক্তি সালাতের(*8) সাহায্যে অর্জন করিতে হয়, জাকাত নামক ‘লা’ কর্মের বিস্তার সাধন করিয়া। অর্থাৎ সপ্ত ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটি বিষয়কে নফি করিতে হয়, অর্থাৎ জাকাত করিতে হয়। ইহাই সকল আত্মিক শক্তির মূল উৎস। কতল কর্ম দ্বারা সকল বিভ্রান্তি বিদূরিত হইয়া যায়। কতল যিনি করেন তিনি তাঁহার সকল কর্মের উপর ‘লা’ এর বিস্তার সাধন করিয়া কর্ম করেন আল্লাহ্‌ কখনও তাঁহার কর্মসমূহ বিপথগামী করেন না। ইন্দ্রিয়পথে আগমনকারী সকল বিষয়ের লা-প্রক্রিয়ার বিস্তার সাধন করা ত্যাগ ও ধৈর্য সাপেক্ষ। ‘তে’ অক্ষর দ্বারা বিস্তার বুঝায়। ‘লা’ এর বিস্তার সাধন করিলে আল্লাহ্‌র ক্বাফ গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। একই অর্থে ‘ক্বাফ’ অক্ষরটিকে আল-কোরানে একটি ইঙ্গিতপুর্ন বিরতি চিহ্নরূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। ‘আল্লাহ্‌র পথে কতল কর” এই নির্দেশ আল কোরানে বহুবার ব্যক্ত করা হইয়াছে। কতল কর্ম ব্যতীত আল্লাহ্‌র পথে অগ্রসর হওয়া যায় না।(দ্র. ৪৭:৪, ৯:১১১,)

তিনি তাহাদিগকে শীঘ্র পরিচালনা করেন এবং সংশোধন করেন তাহাদের অবস্থা। এবং তাহাদিগকে দাখিল করেন জান্নাতে ইহা তাহাদিগের জন্য আত্মপরিচয় দানকারী। (সূরা মোহাম্মদঃ ৫+৬)
ব্যাখ্যাঃকতল কর্মে লিপ্ত ব্যক্তিগণের হেদায়েত কর্ম আল্লাহ্‌তালা শীঘ্র সম্পন্ন করেন বা করিয়া থাকেন এবং এইরূপে তাহাদের মনের অবস্থা সংশোধন করেন, অর্থাৎ সকল মোহ-কালিমা মুছিয়া ফেলেন এবং এমন এক জান্নাতে দাখেল করেন যাহা তাহাদের জন্য হইয়া উঠে আত্মপরিচয় দানকারী এবং উন্নত স্তর দানকারী। জান্নাতের এই স্তরে আসিয়া বিষয়-মোহের ঊর্ধ্বে অবস্থান লইয়া তাহারা পরিণামে বিশ্বের বিষয়রাশির উপর ‘আরেফ’ অর্থাৎ জ্ঞাতা হইয়া থাকেন। (দ্র. ৪৭:৫+৬)

আমানুগন অর্থাৎ সাধক পথিকগণ একটি গন্তব্যে উপনীত হইয়া স্থিতিশীল হইতে চাহে। তাই তাহারা বলেঃ একটি সূরা কেন নাজেল হয় না যাহা হইবে গন্তব্য প্রাপ্তির একটি হুকুমত, অর্থাৎ সিদ্ধান্তমূলক একটি নির্দেশ, যাহা পালন করিয়া কামিয়াব বা স্থিতিশীল হইতে পারিবে। তারপর যখন সেইরূপ একটি সূরা নাজেল হয় এবং তাহাতে থাকে কতল কর্মের নির্দেশ তখন তাহাদের মধ্যে যাহাদের অন্তরে ব্যাধি আছে অর্থাৎ যাহারা দুর্বল চিত্ত তাহাদের চেহারার উপর মৃত্যু ভয়ের ভীত-বিহ্বল অবস্থা দৃষ্ট হয়। গভীর সালাতের সাহায্যে কতল কর্ম করিতে হয়। ইহাতে ‘মরার আগে মৃত্যু’ বরণ করা বিষয়টি অনিবার্য ঘটনা হইয়া দাঁড়ায়। শুধু আমানু কেন কতক মোমিনও ইহাতে ভীত হইয়া থাকে। ইহার অপর নাম সালাতুল উস্‌তা, বা মধ্যবর্তী সালাত বা সালাতের গভীর অবস্থা। ইহাতে নফস অর্থাৎ মন হইয়া যায় বিষয় জগতের আশ্রয় হইতে সম্পূর্ণ বিচ্যুত ও একেবারে নিরাশ্রয়। মরার আগে ইহাই নফসের মৃত্যু। এই মৃত্যুভয় অতিক্রম করিয়াই লা-মোকামে যাইতে হয় এবং চিরতরে মৃত্যুকে জয় করিয়া অমর হইতে হয়। ইহাতে সাধকের চির অমরত্ব প্রাপ্তি।
কোরান বলিতেছেনঃ আক্ষেপ সেইসব সাধকদের জন্য যাহারা কতল কর্মের মৃত্যুভয়ে ভীত হইয়া পিছপা হয়। কতলের যে লা-অবস্থা তাহা অত্যন্ত সুবিস্তারিত। লা-কর্ম অর্থাৎ জাকাত কর্ম যখন সাতটি ইন্দ্রিয় দ্বারের প্রত্যেকটির উপর বিস্তার লাভ করিতে সক্ষম হয় তখনই কেবল ক্বাফশক্তি অর্জিত হয়। ইহা সহজ কর্ম নয়, মানবীয় নফসের জন্য একেবারেই ছারখার অবস্থা।
ক্বাফ অক্ষরটি ক্বাফশক্তির ইঙ্গিত বহনকারী একটি চিহ্ন হিশেবে আল-কোরানে গ্রহণ করা হইয়াছে। এবং ইহা অন্যতম একটি বিরতি চিহ্নরূপে বিদ্যমান।(দ্র. ৪৭:২০)
কতলকর্মে যাহাদের অনীহা তাহাদের জন্য সালাতুল উস্‌তার পরিবর্তে বা স্থলে সাধারণ সালাত কর্ম করাই বাঞ্ছনীয়। তথাপি যদি তাহাদের কেহ ‘আমর’ প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে অর্থাৎ আপন ধর্মকর্মসমূহের উপর আমির হইতে চায় তবে আল্লাহ্‌র সদাকাত করাই তাহাদের মঙ্গলজনক। কর্মের উপর আমির হওয়া অর্থ আপন ধর্মরাশির উপর কর্তা হইয়া যাওয়া (তুলনীয় ৯৭:৪)। আল্লাহ্‌র সদাকাত করা অর্থ বিষয়রাশির উপর সালাত করা। (দ্র. ৪৭:২১)
তবে ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, কতল কর্ম অবশ্য করণীয় বিষয়, যাহা না করিলে মানব মনের ফাসাদ দূরীভূত হয় না, এবং ব্যক্তিজীবনে ও সমাজ জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কতল কর্মে নিয়োজিত না হইলে অর্থাৎ কতল কর্ম হইতে বিরত থাকিলে বা বিমুখ হইলে মহাপুরুষদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয়। অর্থাৎ জরায়ুতে তাহাঁদের সঙ্গ লাভ করা যায় না, তথা মহামানবের পৃষ্ঠে আরোহণ করা যায় না। সর্ববিষয়ের উপরে মহাপুরুষের আমর বা কর্তৃত্ব না থাকাই জগতের সর্ব অশান্তির মূল। (দ্র. ৪৭:২২)
টীকাভাষ্য*১. সিরাতাল মোস্তাকীম
মোস্তাকীম= up right, sincere, honest, persevering, firm. ধীর, স্থির, অচঞ্চল, শুদ্ধ, সরল, দৃঢ়। ‘‘এস্তেকামাত’’ অর্থ ধীরতা, স্থিরতা, অচঞ্চলতা, সরলতা, দৃঢ়তা ইত্যাদি। যিনি এই গুনে গুণী তিনি “মোস্তাকীম” এবং তাঁহার অনুসৃত পথ সিরাতাল মোস্তাকীম। মনের এই পথ সহজ নয় সরলও নয়। বরং ইহা গভীরভাবে সালাত ও জাকাত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে ধীরতা ও দৃঢ়তা অবলম্বনের একটি জটিল পথ।  
সিরাতাল মোস্তাকীম= মোহমুক্ত দৃঢ় পথ, যে পথে মন বিষয় মোহে চঞ্চল হইয়া উঠে না। সেইরূপ সাধক ব্যক্তির পথ যিনি ধীর স্থির হইয়াছেন, তথা মোমিন ব্যক্তির পথ। মোমিন ব্যক্তির নির্ধারিত জীবন পদ্ধতি ব্যতীত অন্য সকল প্রকার জীবন পদ্ধতি বক্র পথ।
এক কথায় “সেরাতুম্‌ মোস্তাকীম” হইল পরিসিদ্ধ সাধকের মানসিক ভ্রমণ পথ বা কামেল মহাপুরুষের পথ, তথা উচ্চ পর্যায়ের মোমিন ব্যক্তির মানসিক গতিপথ। এহেন মোমিন মন হইতে বিষয় মোহ উৎপাটিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং ভাল হোক বা মন্দ হোক কোন একটি বিষয়ের প্রতিও তাঁহার কোনরূপ চাঞ্চল্যকর আকর্ষণ নাই। তিনি পরিপূর্ণভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ, সামাদ। মনের এই পরিশুদ্ধ পথ সকল পর্যায়ের সাধকের জন্য একটি  মহান আদর্শরূপে উপস্থাপন করা হইয়াছে/স্থাপন করা হইয়াছে।
*২) নফস
চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক অভিব্যক্তিকে নফস বলে। শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি ইন্দ্রিয়সমূহ এবং বুদ্ধি, স্মরণশক্তি ইত্যাদির গুণাগুণ নফসেরই এক একটি অভিব্যক্তি। শুদ্ধির পর্যায় অনুসারে মানুষের নফস চারি প্রকার পর্যায়ভুক্তঃ-
১। নফসে আম্মারাঃ যে  নফস ভাল-মন্দ বিচার না করিয়া আপন ইচ্ছামত চিন্তা ও কর্ম করে তাহাকে 'নফসে আম্মারা' বা অশুদ্ধ মন বলে।
“খান্নাস” অর্থ গোপনীয় শয়তান, আত্মগোপনকারী নফস বা মন। এক কথায় দুষ্ট মন, যে মন এখনও শুদ্ধ হয় নাই।
মনের চিন্তা-ভাবনা গোপন বিষয়। বাহির হইতে ইহা দ্রষ্টব্য নয়। জ্বিন এবং ইনসানের দুষ্ট মনকে খান্নাস বলে। কামেল পুরুষ ছাড়া সকল মানুষের মনই কম বেশী খান্নাস। আপন মনের কুপরামর্শে এবং নানাবিধি জৈবিক তাড়নায় মানুষ অস্থির থাকে। তাহা ছাড়া বাহির হইতে কুপরামর্শ আসে অন্যান্য জ্বিন এবং ইনসান পর্যায়ের মানুষ হইতে। মনকে পরিশুদ্ধ করিয়া মুক্ত লাভের ইচ্ছা করিলে ইনসান পর্যায়ের মানুষ হইতে। মনকে পরিশুদ্ধ করিয়া মুক্তি লাভের ইচ্ছা করিলে এই সকল খান্নাসের মন্দ পরামর্শ হইতে সম্যক গুরুর নিকট আশ্রয় লইতে হইবে। তাহা ছাড়া উপায় নাই।(দ্র. সূরা নাস)
 ২। নফসে লাউয়ামাঃ যে নফস মোমিন ব্যক্তির বা গুরুর নির্দেশিত পথে কর্মযোগে থাকিবার প্রচেষ্টারত এবং গুরুর শিক্ষা অনুযায়ী আত্মশুদ্ধি কর্মে লিপ্ত আছে, এই জাতীয় সাধক নফসকে 'নফসে লাউয়ামা' বা শুদ্ধিকর্মে ব্যস্ত বা অনুতপ্তশীল মন বলে। লাউয়ামা নফসকে কোরানে আমানু তথা সাধক বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন।
৩। নফসে মোৎমায়েন্নাঃ যে নফস আত্মশুদ্ধি কর্মে কামিয়াব হইয়া সন্তোষের অবস্থায় আসিয়া প্রশান্ত হইয়া গিয়াছে তাহাকে ' নফসে মোৎমায়েন্না' পরিশুদ্ধ মন বলে। এই পর্যায়ের নফস এলহাম প্রাপ্ত এবং ইহারা মোমিন এবং জান্নাতবাসী এবং জান্নাতের সপ্তস্তরের যে কোন একটি স্তরে আছেন এবং ইহাদের গুণগ্রামের মধ্যে স্তরভেদ আছে।
৪। নফসে ওয়াহেদঃ নফসের এই স্তরে সর্বোচ্চ মানের স্তর। এই স্তর জান্নাতের সপ্তস্তরের ঊর্ধ্বে বিরাজিত পরম কর্তা ব্যক্তিগণের স্তর, এবং তাঁহাদের সবার মধ্যে চরম একক রূপ বিরাজিত। তাঁহারা সবাই মোহাম্মদ। সকল স্তরের জান্নাতবাসীগণ সবাই তাঁহাদের মুখাপেক্ষি হইয়াই থাকেন। যাহারা এলহাম দ্বারা চলেন তাঁহারা 'নফসে মোলহেমার'। এই পর্যায়ের ব্যক্তিগণ জান্নাতের মধ্যকার উচ্চ পর্যায়ভুক্ত। নফসে ওয়াহেদ এলহাম দানকারী দাতা।
  In other words whatever you do is your Nafs. Allah does not do anything. He is above doing anything. Muhammad (A) in Nafs, or formed Muhammad, showed in his life how to do things without Nafs.
বিস্তারিত দ্রষ্টব্যঃ https://www.facebook.com/notes/moula-sufi-sadar-uddin-ahmad-chishty/%E0%A6%A8%E0%A6%AB%E0%A6%B8/661633213971934
*৩. ইনসান
যে মানুষ তাহার ত্রুটি সম্বন্ধে জাগ্রত এবং একটা বাস্তব এবং সত্য মনোভাবের উপর দাঁড়ায়। ইনসান অলীক মনোভাবকে গুরুত্বই দেয় না। ইনসানের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহা অন্যের নাই। ইনসান গুরুর গুরুত্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন এবং কমবেশি গুরুর সাহচর্যে থাকে। রহমান প্রভুগুরু রূপে জিনকে কোরান শিক্ষা দিয়া ইনসানে রূপান্তর করেন। তারপর তাহাকে সর্ববিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেন (৫৫:১-২). গুরু এবং ইনসানের সম্পর্ক আন্তরিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গুরুর বাহিরে সে কোন আপন অস্তিত্ব মানে না, যদিও অতীত কর্মের কারণে গুরুকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করিতে সক্ষম হয় না। এই সংজ্ঞায় বহির্ভুত মনসমূহ সবাই জিন। গুরুর বাহিরে কোন ইনসান নাই। ইনসানের বহুবচন নাস।
ইনসান জান্নাতের প্রথম পর্যায়ে উন্নীত হইলে তাহাকে আদমও বলা যাইতে পারে। সুতারাং আদম পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব সর্বযুগেই বিদ্যমান।  ইনসান জীবশ্রেষ্ঠ। তাই সে জ্ঞানে গরিমায়, কৃষ্টি সভ্যতা ইত্যাদি সর্বদিক হইতে অন্য সকল জীবকুল হইতে নিজেকে ধনবানরূপে দেখিতে পায়। এইগুলি অবশ্য স্বর্গীয় গুণ এবং গৌরবের বিষয়। গুরুগণ হইতে এইগুলি অর্জন করিয়াই সে নিজেকে আপন গৌরবে গৌরবান্বিত দেখিতেছে। আসলে তাহার মস্তিষ্ক যে সকল উন্নতমানের উপার্জন দ্বারা ভরপুর হইয়া আছে, তাহা যে পুনর্জন্মের উপাদান হইয়াই মস্তিষ্কে জমা হইয়া আছে এইকথা বুঝিতে সে বোকামি করিতেছে। নিন্মমানের মানুষ এবং ইতর জীবকুল ইহা না বুঝিতে পারে কিন্তু ইনসান ইহা বুঝিবার যোগ্যতা রাখে। এইজন্য লা-মোকার কথা না বুঝিতে চাহিলে ইনসানকে বোকা বা বলদ বলিয়া আখ্যায়িত করা হইতেছে। মানুষ স্বভাবতই সালাত বিরোধী। সালাত মস্তিষ্কের মধ্যে মহাশূন্যতা আনয়ন করে। বিপরীত দিকে শেরেক আনয়ন করে প্রাচুর্য এবং মনের বহুমুখী ধন সম্ভার, যাহা আপাতদৃষ্টিতে অধিক সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এই জন্য ইনসান জান্নাতমুখী হইতে ভালবাসে এবং গুণগ্রাম সহকারে নিজেকে জান্নাতের ধনে ধনীরূপে দেখে। মুক্তিলাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। বিশ্বের সুসভ্য গুরুবাদী ইনসানগণ কল্যাণমুখী কিন্তু মুক্তিমুখী নয়, তথা জান্নাতমুখী কিন্তু লা-মুখী নয়। ইহা সালাতের বিরোধীতা বা সালাতের প্রতি অনীহা।
বিস্তারিত দ্রষ্টব্যঃ https://www.facebook.com/notes/moula-sufi-sadar-uddin-ahmad-chishty/%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8/661633743971881

 4. আল্লাহঃ(আর্দ ও সামা) সৃষ্টির ও মনের কেন্দ্রবিন্দুটি হইলেন আল্লাহ্‌। আল+ইলাহ=আল্লাহ। অর্থাৎ একমাত্র উপাস্য।ইলাহ্‌ অর্থ কর্তা, নেতা, অধিকারী, তাই উপাস্য। সৃষ্টিময় আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোন ইলাহ্‌ নাই। মোহাম্মদ (আ.) ব্যতীত নিরাকার আল্লাহ্‌র পরিচয়ের কোন প্রকাশ নাই। সৃষ্টি পরিচালনার জন্য তাঁহারই উপর সকল নেতৃত্ব কর্তৃত্ব এবং অধিকার ন্যস্ত রহিয়াছে। সুতারাং তিনিই হইলেন আল ইলাহ্‌'র প্রকাশ্য অভিব্যক্তি। সকল মহাপুরুষ ঐ জাহেরী ইলাহ্‌'রই পরিচয় প্রকাশক।একমাত্র সেই ইলাহ্‌'র নির্দেশ ব্যতীত মনুষ্য জীবনের নির্ভরের অন্যান্য বস্তু ও ব্যক্তিগনকে মানুষ যেইরূপ কর্তৃত্বের আসনে বসাইয়া থাকে কাল্পনিক বা মিথ্যা ইলাহ্‌; যেহেতু এই ইলাহ্‌সমূহ নিজেরাই অস্থায়ী এবং আল ইলাহ্‌'র নিয়ন্ত্রণাধীন।   বিস্তারিত দেখুনে এখানে https://www.facebook.com/notes/moula-sufi-sadar-uddin-ahmad-chishty/%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%8D/661634140638508

*5. মোমিন অর্থ বিশ্বাসী। নীতিগত কোন সত্যকে মৌখিক ও আন্তরিকভাবে যে ব্যক্তি স্বীকার করিয়া লয় তাঁহাকে সেই বিষয়ে বিশ্বাসী বলা হইয়া থাকে। সেইরূপ আমাদের ধর্মীয় পরিভাষায় আমারাও বিশ্বাসী তাঁহাকেই বলি যিনি না দেখিয়াই বিশ্বাস করিয়া লইয়াছেন আল্লাহ্‌, পরকাল, ফেরেস্তা এবং আল্লাহ্‌র রসূল ও তাঁহার অবতীর্ণ কেতাব।
এইরূপ সাধারণ বিশ্বাসীকে (আমানুকে) সম্বোধন করিয়াই কোরান তাঁহার প্রায় সকল আদেশ-উপদেশ দান করিয়াছে তাঁহাদের সংশোধনের জন্য। কারণ বিশ্বাসী ব্যতীত অন্য লোক কোরানের দ্বারা মানিয়া চলিতে রাজি হইবে না। অপরপক্ষে কোরান বিশ্বাসীর (মোমিন) যে দিয়াছে তাঁহার মান এত উন্নত যে, সেরূপ বিশ্বাসী অল্পই দেখা যায়।
কাজেই আমরা অনায়াসে বলিতে পারি যে, কোরান ব্যাপকভাবে এই শব্দটিকে ব্যবহার করিয়াছে। সাধারণ ও বিশেষ অর্থে এবং ব্যাপক ও সুনির্দিষ্ট অর্থে এই শব্দটিকে কোরান গ্রহণ করিয়াছে। সকল মানুষকে উৎসাহিত করা এবং বিশ্বাসীর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যই শব্দটির এইরূপ ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। কোরান ও হাদিসের ইহা একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য যে উহার সংজ্ঞার মধ্যে স্থিতিস্থাপক (Elasticity)  ও ব্যাপকতা রহিয়াছে।
মোমিন(৩:৩৮), যিনি ইমানে পরিপূর্ণ। যেই কোন দিক বিবেচনায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত। ইহা বাস্তব ব্যাপার—অহেতুক যুক্তিতর্কের বিষয় নয়। মুমিন আল্লাহ্‌ একটি নাম বিশেষ (৫৯ হাসরঃ২৩)। যে গুণে আল্লাহ্‌ মুমিন সে গুণ কোন ব্যক্তির মাঝে বিকশিত হইলে তিনিই মুমিন পদবাচ্য।

সাধারণতঃ কোরান যেখানে মোমিনকে সম্বোধন করিয়া কিছু বলিয়াছে, সেখানে ব্যাপকভাবে সাধারণ বিশ্বাসীকেই বুঝাইয়াছে; কিন্তু যেখানে মোমিনের সংজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছে অথবা মোমিনের গুণাবলী, পরিচয় স্বরূপ ও অভিব্যক্তির প্রকাশ করিয়াছে সেখানে মোমিন অতি ঊর্ধ্বলোকে দুনিয়ার বাহিরে বিরাজ করেন।
কোরান মাজিদে মোমিনের সেরূপ সংজ্ঞা ও পরিচয় রহিয়াছে সেরূপ মোমিন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সৃষ্টির রহস্য। তাঁহার অন্তত আল্লাহ্‌র মসজিদে আশ্রয়প্রাপ্ত এবং তাহা আল্লাহ্‌র আর্শ। মসজিদ একমাত্র মোমিনের জন্য। মোমিন ব্যতীত অন্য লোকের পক্ষে প্রকৃত মসজিদ চিনিবার উপায় নাই, আবার মোমিনকে না চিনিলে মসজিদ চিনা যায় না। মসজিদে প্রবিষ্ট হইয়া মোমিনের অন্তর আল্লাহ্‌র সিংহাসনের মর্যাদা লাভ করিয়াছে। এইজন্য মোমিনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ কোরান হইতে কিছু প্রকাশ করা প্রয়োজন।
কোরান মজিদে মোমিনের যেরূপ সংজ্ঞা ও পরিচয় রহিয়াছে সেরূপ মোমিন ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সৃষ্টির রহস্য। তাঁহার অন্তত আল্লাহ্‌র মসজিদে আশ্রয়প্রাপ্ত এবং তাহা আল্লাহ্‌র আর্শ। মসজিদ একমাত্র মোমিনের জন্য। মোমিন ব্যতীত অন্য লোকের পক্ষে প্রকৃত মসজিদ চিনিবার উপায় নাই, আবার মোমিনকে না চিনিলে মসজিদকে চিনা যায় না। মসজিদে প্রবিষ্ট হইয়া মোমিনের অন্তর আল্লাহ্‌র সিংহাসনের মর্যদা লাভ করিয়াছে। এইজন্য মোমিনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ কোরান হইতে কিছু প্রকাশ করা প্রয়োজন।
কোরান মাজিদে সর্বত্রই মোমিন লোকদের প্রকৃত ও পরিচয় সম্বন্ধে বহু কথা বহুরূপে প্রকাশ করিয়াছে। বিভিন্ন কথা ও পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাসীর সৌন্দর্য ও স্বরূপ বিভিন্নরূপে অংকিত করা হইয়াছে। অধিক উল্লেখ না করিয়া সূরা মোমেনুনে একস্থানে ক্রমাগত যে কয়টি আয়াত মোমিনের পরিচয় রূপে একত্র রহিয়াছে তাহাই শুধু উদ্বৃত্ত করিয়া নিম্নে উহার ব্যাখ্যা দান করিতে চেষ্টা করিলাম। যথা (২৩:১-১১)
১। নিশ্চয় শুধুমাত্র বিশ্বাসীগণ কল্যাণ প্রাপ্ত হইয়াছে;
২। তাঁহার ঐ সকল লোক যাহারা তাঁহাদের সালাতের মধ্যে ভীত থাকে;
৩। এবং তাঁহারা ঐ সকাল লোক যাহারা অপ্রয়োজনীয় কথা হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখে;
৪। এবং তাঁহারা ঐ সকল লোক যাহারা যাকাতের জন্য ক্রিয়াশীল থাকে;
৫। এবং তাঁহারাই তাঁহাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য যত্নশীল;
৬। তাঁহাদের সঙ্গি-সঙ্গিনীর উপরে (কর্তব্য পরায়ান অবস্থায় থাকা) ব্যতীত অথবা তাঁহাদের ডান হাতের অধিকার আছে (অর্থাৎ অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর কর্তব্যপরায়ণ থাকা অবস্থা ব্যতীত), সুতরাং নিশ্চয় তাঁহারা দোষণীয় নয়।
৭। সুতরাং যাহারা এর অসীম পিছনের আকাঙ্ক্ষা করে তাহা হইলে তাহারা সীমালঙ্ঘনকারী;
৮। এবং তাঁহারাই তাঁহাদের আমানত ও ওয়াদার জন্য রক্ষাকারী;
৯। এবং তাঁহারা তাঁহাদের সালাতের উপর হেফাজত করে;
১০-১১। এই সকল লোক তাঁহাদের উত্তারাধিকারী হইয়াছে; যাহারা উত্তরাধিকারী হইয়াছে ফেরদাউসের। উহাতে তাঁহারা চিরদিন থাকিবে।

ব্যাখ্যাঃ বিশ্বাসী ব্যতীত আর কোন লোক জীবনে কোনরূপ সুফল লাভ করিতে পারিবে না, কারণ মানব জীবনের কল্যাণ ও সার্থকতা বলিতে যাহা কিছু রাখা হইয়াছে তাহা শুধুই বিশ্বাসীর জন্য আল্লাহ্‌র বিধানে নির্দিষ্ট করিয়া রাখিয়াছেন। বিশ্বাসী না হইলে মানুষ সর্বপ্রকার কল্যাণ ও সুখ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইবে। এই কল্যাণ দুনিয়ায় নয়—মানুষের সামগ্রিক জীবনের কল্যাণ।
কোন মোমিন বা কিরূপ মোমিন এই কল্যাণের অধিকারী?
তাঁহারা ঐ সকল লোক যাহারা ‘সালাত’ অর্থাৎ সংযোগ প্রচেষ্টা পালনকারী। সুতরাং তাহাদের সালাতের মধ্যে তাহারা এই ভয়ে ভীত থাকে যেন আল্লাহ্‌র সঙ্গে তাহাদের মনের এই সংযোগ প্রচেষ্টার মধ্যে দুনিয়ার খেয়াল আসিয়া উহা ছিন্ন না করে।
আল্লাহ্‌র সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করাই যাহাদের মনের প্রচেষ্টা তাঁহার কখনও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা উচ্চারণ করিতে পারে না। কারণ গল্পগুজব করিলে বা কোনরূপ অপ্রয়োজনীয় কথা বলিলে ইহাই প্রমান হয় যে, আল্লাহ্‌র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা না করিয়া ততক্ষণ দুনিয়াকেই গ্রহণ করা হইয়াছে। বাঁচিয়া থাকিবার জন্য এবং আল্লাহ্‌কে ডাকিবার সুযোগ গ্রহণের জন্য যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন তাহার বাহিরে কথোপকথন করিয়া সময় কাটান এইরূপ বিশ্বাসীর অভ্যাস বহিভুত হইতে বাধ্য, কারণ প্রয়োজনহীন বাজে কথা দূরে থাক, কাজের কথা বলিবার সময়ও তাহাদের তেমন থাকে না। এর কারণ ‘সালাত’ একটি অখণ্ড সংযোগ প্রচেষ্টা। ইহা সময় দ্বারা খণ্ডিত নয়, যদিও পাঁচবার আনুষ্ঠানিক সালাত পালন করা শরীয়তে বাধ্যতামূলক বিধান রাখা হইয়াছে।
কোরান পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা উল্লেখ করে নাই, কারণ উহা মূলনীতি নির্ধারক। কোরান বলিতেছেঃ ‘আকিমুস সালাত’ অর্থাৎ ‘সংযোগ প্রচেষ্টা কায়েম কর’। কায়েম অর্থে স্থায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন সালাত করিতে থাকা বুঝায়। শরীয়তে দিনে পাঁচবার সালাত পালনের যে-পদ্ধতি দান করা হইয়াছে তাহাও স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই করা হইয়াছে। যাঁহারা প্রকৃতই মোমিন হইয়া গিয়াছেন তাঁহারা কর্মের মধ্যেও মনের সংযোগ রক্ষা করিয়া রাখিতে পারিয়াছেন। তাঁহাদের সাংসারিক কর্মগুলিও সালাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। সালাত সম্বন্ধে বলিতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়। সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় তাহা সম্ভব নয়।
সালাতের সঙ্গে যাকাত সংশ্লিষ্ট। সুতরাং এই জাতীয় লোক তাঁহাদের সমগ্র চিত্তবৃত্তি এবং পার্থিব সম্পদ জাকাত করিবার জন্য অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নিকট জাকাত রূপে উৎসর্গ করিবার জন্য সদা কর্ম তৎপর থাকেন। জাকাত না-করিলে সালাত হইবে না কারণ নফসের বৃত্তিগুলি নফসকে তাহার ইচ্ছামত ব্যবহার করিতে দিলে ঐ সমস্ত দ্বারা সে দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করিবে এবং দুনিয়ার সঙ্গেই সে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হইবে। ক্রমে সালাত অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টাও তাহার থাকিবে না।
চিত্তবৃত্তি সামগ্রিক অভিব্যক্তি আল্লাহ্‌র দাসত্বে তাঁহারই ইচ্ছামত ব্যয় করিতে গেলে ঐগুলির ব্যবহার সম্পূর্ণ তাঁহারই নিকট ছাড়িয়া দিতে হয়। এইরূপ আপনাকে ছাড়িয়া দেওয়ার জন্য যাঁহারা ব্যস্ত রহিয়াছেন তাঁহাদের বাজে কথা বলিবার সময় কোথায়?
আল্লাহ্‌ দেওয়া সমগ্র শক্তি ও সম্পদ আল্লাহকে জাকাত দেওয়া সহজ কথা নয়। এর জন্য সর্বদা তৎমুখাপেক্ষী হইয়া, উদ্‌ঘ্রীব হইয়া আপন চিন্তাশক্তিগুলিকে উৎসর্গ করিবার কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়। আল্লাহ্‌র দিকে হইতে মুখ ফিরাইয়া যতটুকু দুনিয়ার দিকে নজর দেওয়া হয় ততটুকু জাকাত দেওয়ার অবস্থা ছুটিয়া যায়। জাকাত করিতে চাহিলে সর্বদাই ক্রিয়াশীল থাকিতে হয়। তাঁহার দেওয়া হাত, পা, চোখ, কান, বুদ্ধি, ধন-সম্পত্তি ইত্যাদি প্রত্যেকটি বৃত্তি ও শক্তি তাঁহার লাগাইবার জন্য এবং নিজ নফসের ইচ্চামত ব্যবহার হইতে মুক্ত করিবার জন্য সর্বদা সজাগ ও ক্রিয়াশীল থাকিতে হয়।

যাহারা এইরূপ মহান ব্রত গ্রহণ করিয়া জীবন যাপন করিবার সংকল্প লইয়াছেন তাহাদের পক্ষে যৌন সম্ভোগের বাড়াবাড়ি করিবার সুযোগ কোথায়? এদিকে নজর দেওয়াই তাহাদের পক্ষে কঠিন হইয়া উঠে। দুনিয়ার যতপ্রকার উপভোগ ও আকর্ষণ আছে যৌন লালসা তাহার মধ্যে সবচেয়ে প্রবল। সুতরাং যৌন লালসা বিচার করিলেও বুঝা যায় সত্য সত্যই মন আল্লাহ্‌র দিকেনা দুনিয়ার দিকে অধিক আকৃষ্ট। আল্লাহ্‌ যৌন সম্ভোগের যে সুযোগ ও সীমা দিয়াছেন তাহার বাহিরে মনের লোভ বিস্তারিত হইলে বুঝা গেল মন দুনিয়ামুখি, আল্লাহমুখি নাই। আর যাহারা যৌন অঙ্গ ব্যবহারের এই নিদির্ষ্ট সীমা ভঙ্গ করে তাহাদের কথা না বলাই বাহুল্য কারণ তাহারা একেবারেই অবাধ্য।

সপ্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ যে ধর্মরাশিকে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করিতেছে তাহা মানব মনে স্মৃতি ও সংস্কাররূপে জমা হইয়া জাহান্নামে রচনা করিতেছে। ইহার উপর সালাত করিলে ঐ ধর্মরাশি মস্তিষ্কে কোন ছায়া ফেলিতে পারে না অর্থাৎ মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সংস্কার শূন্য হইয়া উঠে। একজন মোমিন যেহেতু ২৪ ঘণ্টাই সালাতে নিমগ্ন থাকেন তাই তিনি সংস্কারমুক্ত প্রশান্তময় এক মানসিক হালে বিরাজ করেন। তার এই মানসিক প্রশান্তি তিনি তার ব্যক্তিগত সময়ে পুরোপরি ধরিয়া রাখেন। কিন্তু এই পার্থিব জীবনযাত্রায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেহেতু বিভিন্ন মানুষ ও অধীনস্থদের সাথে লেনদেন ইত্যাদি  মানসিক বিষয়ে কর্তব্যপরায়ণ থাকিতে হয় সেইসব ক্ষেত্রে মানসিক প্রশান্তির হাল কিছুটা হইলেও বিঘ্নিত হয়। ইহা তাহার জন্য দোষণীয় নয় যেহেতু তিনি পার্থিব কর্তব্য শেষ হইলে পুনরায় তাহার মানসিক প্রশান্তির হালে চলিয়া আসেন এবং লেনদেনরত অবস্থায় বিষয় বা ব্যক্তিগণকে তাহার মস্তিষ্ক হইতে সম্পূর্ণ সরাইয়া ফেলেন। যে সময় অতীত হইয়া যায় তাহার স্মৃতি কিংবা তাহার প্রতি কোনরূপ অনুরাগ বা বিরাগ কিছুই তাহার মস্তিষ্কে ঠাই পায় না। অর্থাৎ তিনি কখনই অতীতের দিকে বা পিছন পানে তাকান না। ‘পিছনে’ শব্দটির উপর বড় মদ বসাইয়া ইহাকে অসীম বা অনন্ত পিছনের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে, অর্থাৎ বিগত জীবনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। একজন মুসল্লি তাহার বিগত জীবনগুলিতে দায়েমি সালাত পালন না করিবার কারণে মানসিক অশান্তি ও দুঃখ-জ্বালা ভোগ করিয়াছেন। পার্থিব লেনদেনের বিষয়গুলোকে মনে ধরিয়া রাখিয়া আপন মানসিক প্রশান্তির হালকে বিঘ্নিত করিয়াছেন। সেই জীবনগুলোর স্বভাব তাহাকে ডাকে না অর্থাৎ অসীম পিছনের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করিয়া তিনি শুদ্ধ হইয়াছেন। তাই এখন তাহার মস্তিষ্ক অতীত ঘটনাকে ধরিয়া রাখার স্বভাব মুক্ত হইয়াছে। আর তাই এই পার্থিব লেনদেনের সময় সঙ্গী-সঙ্গিনী বা অধীনস্থদের সাথে কর্তব্যপরায়ণ থাকিবার জন্য যতটুকু মানসিক মনোযোগ দিতে হয় ততটুকু অধিক তিনি দেন না এবং বাকি সময়টুকু সম্পূর্ণ সংস্কারহীন অবস্থায় থাকিতে সচেষ্ট থাকেন। ইহা না করিলে সীমালঙ্ঘনকারীদের দলভুক্ত হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
‘আমানত’ ও ওয়াদা’ রক্ষাকারী ব্যক্তি অসাধরন মানুষ। মোমিনরূপে পরিগণিত হওয়ার জন্য আর একটি শর্ত হইল আমানত এবং ওয়াদা রক্ষা করা। আমানত দুই প্রকার যথা—আল্লাহর আমানত এবং মানুষের আমানত।
আল্লাহ্‌র আমানত সম্বন্ধ্বে কোরানের (৩৩:৭২-৭৩) বাক্যে উল্লেখিত আছে। অতি শুদ্ধ চরিত্র মহান ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্য লোকের পক্ষে আল্লাহ্‌র আমানত রক্ষা করা অসম্ভব ব্যাপার। আল্লাহ্‌র আমানত বলিতে ‘কোরান’, ‘নূরে মোহাম্মদী’, ‘রুহ’ এবং মূলতঃ স্বয়ং আল্লাহতা’লাকেই বুঝায়। মানুষ আল্লাহ্‌র এই মহান আমানত বহন করিবার ভার অন্য কেহই গ্রহণ করে নাই। অবশ্য মানুষ বুঝিতেই পারে নাই যে, আল্লাহ্‌র রুহ তথা আল্লাহতা’লাকে গ্রহণ করার দায়িত্ব কত কঠিন ও কষ্টকর এবং তাঁহারই সহায়তা ব্যতীত একেবারেই অসম্ভব। আল্লাহ্‌র আমানত যেই মানুষ রক্ষা করেন সেই মানুষ অসাধারণ। সেই মানুষ আল্লাহ্‌র দ্বীনে বাস করেন, দুনিয়ায় বাস করেন না, কারণ দুনিয়ার বাস করিয়া আল্লাহ্‌র আমানত রক্ষা করা যাইতেই পারে না।
‘মানুষের আমানত’ অর্থ হইলঃ যাহার উপরে যে সামাজিক কর্তব্য ন্যস্ত আছে তাহা যথাযথ পালন করা। সংসারের সমবায় জীবনে যাহার উপর যে কর্তব্য গচ্ছিত ও ন্যস্ত রহিয়াছে উহার উপর তাহার সেই কর্তব্য যথাযথ পালন করা। সংসার জীবনে যে যেখানে স্থাপিত রহিয়াছে সেখানেই মানুষের দেওয়া কতকগুলি আমানতদারী অর্থাৎ কর্তব্য তাহার উপর ন্যস্ত রহিয়াছে। এই সকল আমানত সে ঠিক না রাখিলে সামাজিক কর্তব্যে অবহেলা প্রমাণ হয় এবং তাহা দ্বারা সামাজিক অকল্যাণ সংঘটিত হয়।

‘ওয়াদা’ অর্থ অঙ্গীকার। ইহাও দুই প্রকার। আল্লাহ্‌র নিকট ওয়াদা এবং মানুষের নিকট ওয়াদা। আমরা সবাই দুনিয়ায় জন্ম লইয়া আসিবার পূর্বে রবের নিকট এই ওয়াদা করিয়া আসিয়াছি যে, দুনিয়াতে যাইয়া আল্লাহতা’লাকে রবরূপে গ্রহণ করিয়াই জীবন অতিবাহিত করিব, কিন্তু এখানে আসিয়া অঙ্গীকার ভুলিয়া গিয়াছি এবং সকল বিষয়ে রবের বিরুদ্ধাচারণ করিতেছি (৭:১৭২-১৭৪ দ্র.)। ‘লামোকামে’ আমরা আল্লাহ্‌র নিকট অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইয়া আসিয়াছি তাঁহাকে রব রূপে গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু দুনিয়ার আবেষ্টনীর মধ্যে আসিয়া সেই অঙ্গীকার আমরা ভুলিয়া থাকি। কবে, কখন, কেমন অবস্থায় সেই অঙ্গীকার করিয়াছিলাম দুনিয়া ছুটিয়া গেলেই তাহার সকলই আবার স্মরণ হইবে। আল্লাহ্‌র সঙ্গে মানুষের চুক্তি ও অঙ্গীকারের কথা কোরানে অনেক উল্লেখ আছে।
এ কথা সবাই জানেন যে, মানুষের নিকট অঙ্গীকারের মূল্যও সংসারে কম নয়। অঙ্গীকার রক্ষা না করিলে নানারূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইয়া থাকে। প্রকৃত বিশ্বাসী আল্লাহ্‌ সংক্রান্ত হউক অথবা মানব সংক্রান্ত হউক কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। ভঙ্গ করিলে তিনি প্রকৃত বিশ্বাসী থাকিতে পারেন না।

৯ নম্বর বাক্যে পুনরায় সালাতের উল্লেখ করিয়া সংযোগ প্রচেষ্টার উপর অধিক জোর দেওয়া হইয়াছ্বে, এবং ইহাই বলা হইয়াছে যে যাহারা মোমিন তাহারা ব্যবহারিক জীবনে এবং মনের রাজ্যে সর্বত্র আল্লাহ্‌র সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টা হেফাজত অর্থাৎ যত্ন সহকারে রক্ষা করিয়া থাকেন। তাঁহারা তাঁহাদের সালাতের উপর হেফাজতকারী হইয়া থাকেন, জাহাতে জীবনের কোন কর্ম ও চিন্তা সালাতের বহির্ভূত হইয়া না পড়ে। উপরোক্ত সকল গুণাবলীর সমন্বয় যে সকল বিশ্বাসীর মধ্যে রহিয়াছে তাঁহারাই সেই সকল লোকের উত্তরাধিকারী হইতে পারেন যাহারা ফেরদৌসের (অর্থাৎ বেহেস্তের) উত্তরাধিকারী হইয়াছেন।
এই পর্যায়ের বিশ্বাসীদের পরিচয় প্রকাশে কোরানে আরও বহু প্রকার উক্তি আছে। যথাঃ তাঁহারা আপন প্রবৃত্তি অনুসারে কথা বলেন না—কোন কাজও করেন না, তাঁহারা রবের দাসত্ব করিবার জন্য শেরেক বর্জন করিতে যত্নবান হন ইত্যাদি। ইহারাই সেইরূপ বিশ্বাসী যাহারা পার্থিব জীবনেই জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।

নিশ্চয়ই যাহারা মোমিন তাহারা যখন আল্লাহ্‌র স্মরণ-সংযোগ করে তখন তাহাদের হৃদয় প্রকম্পতি হয় এবং যখন তাহাদের উপর আল্লাহ্‌র পরিচয় প্রকম্পিত হয় এবং যখন তাহাদের উপর আল্লাহ্‌র পরিচয় আবৃত্তি করা হয়, তাহাদের ইমান বৃদ্ধি পায় এবং তাহাদের রবের উপর নির্ভর করে; তাহারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং তাহাদেরকে যে রেজেক দেওয়া হইয়াছে তাহা হইতে ব্যয় করে। তাঁহারাই প্রকৃত মোমিন, তাহাদের রবের নিকট একটি মর্যাদা এবং ক্ষমা ও মর্যাদাশীল একটি রেজেক।
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্‌র স্মরন-সংযোগ আসিলেই মোমিনের অন্তর কাঁপিয়া উঠে এবং আল্লাহ্‌র পরিচয়ের বিশ্লেষণ তাহাদের উপর পঠিত হইলে তাহাদের ইমান বৃদ্ধি লাভ করে, ফলে তাহারা আপন রবের উপরে নির্ভর করে।
এই শ্রেণীয় মোমিনগণ সালাত প্রতিষ্ঠিত করে, অর্থাৎ সকল বিষয়ের উপর সালাত করে এবং যাহাই তাহাদিগকে রেজেকরূপে দেওয়া হয় ইন্দ্রিয়পথে আগমনকারী তাহার সকল ব্যয় করিয়া ফেলে; মোহযুক্ত হইয়া কিছুই মনের মণিকোঠায় আটকাইয়া রাখে না।
এই শ্রেণীয় মোমিনরাই সত্যিকার মোমিন। তাঁহাদিগের জন্য তাঁহাদের রবের নিকট রহিয়াছে মর্যাদার একটি স্তর এবং সম্মানজনক রেজেক।

এবং তিনি তাঁহাদের (মোমিনদের) অন্তরে পরস্পর প্রীতি (বা প্রেম) স্থাপন করেন যদি তুমি যাহা কিছু পৃথিবীর (দেহের) মধ্যে জমা আছে ব্যয় কর তাহা হইলেও তাহাদের পরস্পরের অন্তরে তুমি প্রেম দিতে পারিবে না এবং আল্লাহ্‌ তাহাদের পরস্পরের অন্তরে প্রেম দান করেন। নিশ্চয় তিনি শক্তিশালী বিজ্ঞানময় বিচারক। হে নবী, আল্লাহই তোমার (জন্য) যথেষ্ট এবং মোমিনদের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করে (তাহারাই তোমার জন্য যথেষ্ট)(৮।আনফালঃ৬৩-৬৪)
ব্যাখ্যাঃ প্রেম অখণ্ড এবং অমর একটি বিষয়। ইহা মোহের মতো মৃত্যু দ্বারা খণ্ডিত হয় না। সুতরাং যাহারা প্রেমের অধিকারী তাহারা মৃত্যুকে জয় করিয়াছেন অর্থাৎ মরার আগে মরিয়া গিয়াছেন। উচ্চ পর্যায়ের মোমিন ব্যতীত কেহই প্রেমের অধিকার নয় এবং এই প্রেম আল্লাহতালা সৃষ্টি করিয়া থাকেন।
কোরান আমানুকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “তোমার দেহের মধ্যে যে সকল গুণাবলী রহিয়াছে তাহার সবটুকু ব্যয় করিলেও মানুষকে প্রেম দান করিয়া প্রেমিক বানাইতে পারিবে না, যতক্ষণ তুমি নিজে কতল কর্মের সাহায্যে মানসিকভাবে মোহের জগত ত্যাগ করিয়া প্রেমের অধিকারী না হও। অর্থাৎ পুর্নাঙ্গ মোমিন না হও।”
আল্লাহ্‌ এবং যাহারা মোমিনদের মধ্যে নবির অনুসরণ করে সেইরূপ উচ্চ পর্যায়ের মোমিনগণই নবির জন্য যথেষ্ট। যথেষ্ট শব্দ দ্বারা বুঝাইতেছেন যে, তাহারা মোহের জগত হইতে উত্তোরিত হইয়া পরম প্রেমময় হইয়াছেন, নির্ভরতার জগত ত্যাগ করিয়া স্বনির্ভর হইয়াছেন।

*6. মুসল্লি। বিস্তারিতদ্রষ্টব্যঃ https://www.facebook.com/notes/moula-sufi-sadar-uddin-ahmad-chishty/%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A7%AD%E0%A7%A6%E0%A7%A7%E0%A7%AF-%E0%A7%A9%E0%A7%AB/661630800638842

*7 ক্বাফশক্তিঃ ১)ক্বাইউমুন, ২)কুদ্দুসুন, ৩)ক্বাবিউন, ৪)ক্বাদিরুন ৫)ক্বাবেদুন এবং ৫)ক্বাহ্‌হারুন। আল্লাহ্‌র এই ছয়টি শক্তিশালী গুণের সমষ্টিকে ক্বাফ শক্তি বলে। যে কথার সঙ্গে ক্বাফ অক্ষরটি বসানো হইয়াছে সেই কথাটি পালন করিলে ক্বাফ শক্তি অর্জিত হয়। হাকিকতে ক্বাইউমিয়াতকে সৃষ্টির মধ্যে স্থায়িত্ব দান করার জন্য ক্বাফ। যেমনঃ *১)ক্বাইউমুন= চিরস্থায়িত্বের শক্তি। ক্বাইউমু= স্থায়িত্ব নির্ধারিত করা হইল।
*২)কুদ্দুসুন= দুর্বল এবং অধঃপতিতকে উন্নত মর্যাদা দানকারী শক্তি।
*৩)ক্বাবিউন= চিরঞ্জীব শক্তির উৎস। ক্বাবিউ= সৃষ্ট শক্তিশালী হইয়া উঠিল।
*৪) ক্বাদিরুন= সুপরিমিত দান কারী শক্তি। তক্বদির দাতা শক্তি। তক্বদির অর্থ ভাগ্য নহে বরং কর্মবৃত্ত দানকারী শক্তি। এই বৃত্ত () সৃষ্টজীব নিজ ক্ষমতায় বদলাইয়া লইতে পারে না। মানুষ ভাল আমলের দ্বারা উহা ক্বাদির শক্তির নির্ধারিত স্বাভাবিক নিয়মেই পরবর্তী উন্নত কর্মবৃত্ত প্রাপ্ত হইয়া থাকে। বস্তু জগতের সীমা ডিঙ্গাইয়া আধ্যাত্ম জগতে দয়া করিয়া কাহাকেও গ্রহণ করিলেও সেখানেও তাহার জন্য নির্দিষ্ট একটি কর্মবৃত্ত দান করা হয়। এই জন্য আধ্যাত্মিক জগতেও রসুলগণ একজন হইতে অন্যজন অধিক ফজল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।
*৫) কাহ্‌হারুন= অপ্রতিহত ক্ষমতা। মৃত্যু দানকারী শক্তি। ক্বাহ্‌হারু= ধ্বংসকারী। ‘না’ কে ধ্বংস করা হইল। অর্থ যাহা ক্ষণস্থায়ী এবং মিথ্যা তাহা ধ্বংস করা হইল। অর্থাৎ ‘যাহা নহে’ তাহাই ধ্বংস করা হইল।
*৬)ক্বাবিদুন- ক্বাবিদু= নিয়ন্ত্রক। সৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করা হইল। ভাঙ্গন ক্রিয়ার শক্তি বর্ধিত করিয়া সৃষ্টি হইতে কোন কিছু নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলার শক্তি সৃষ্টকে দান করা হইল।
ক্বাফ এর ব্যাখ্যাঃ অতএব ইহাদ্বারা দেখা যাইতেছে যে, আল্লাহতা’লা এই ৬টি শক্তিশালী সেফাত তাঁহার মনোনীত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিগণকে দান করিয়া অতি পর্যায়ের এক একটি শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব কদাচিত তৈয়ার করিয়া চলিয়াছেন। এইরূপ ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক একটি উচ্চতম ব্যক্তিত্বকে ‘ক্বাফ’ বলা হইয়াছে। ক্বাফ সূরাতে ‘ক্বাফ’ অর্থে খাস করিয়া মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহকে (আ.) বুঝানো হইয়াছে, কারণ তিনি ‘ক্বাফ’ দলের সকলের নেতা।
সংক্ষেপে বলিতে গেলে উল্লেখিত ৬টি নাম আল্লাহ্‌র পরম শক্তির দিকে ইঙ্গিত করিতেছে। জাহের এবং বাতেন, যে কোন এক প্রকারেই হউক, ‘ক্বাফ’ অক্ষরটি উক্ত ৬টি গুণসম্পন্ন চরম ও পরম এক একটি ব্যক্তিত্বের প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে।
অনুবাদ(৫০:১)— ক্বাফ এর সাক্ষী*১ গৌরবান্বিত কোরান*২।
ব্যাখ্যাঃ ক্বাফ অক্ষরটি দ্বারা আল্লাহ্‌র যে ছয়টি সেফাতের প্রতীক রূপে উল্লেখ করা হইয়াছে গৌরবময় কোরান তাঁহার সাক্ষ্য বহন করে। অর্থাৎ যে মহান ব্যক্তি উক্ত ছয়টি সেফাতের অধিকারী হন, কোরানের পূর্ণ জ্ঞানের অধিকার তাঁহাদেরই হইয়া থাকে এবং তাহারাই স্বর্গীয় মহিমার অধিকার প্রাপ্ত হইয়া গৌরবান্বিত হন। তাঁহারা মাসুম হইয়া থাকেন। তাঁহাদিগকে চিনিবার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাই। তাঁহাদের জ্ঞানোজ্জ্বল মনের অভিব্যক্তি হইল জ্ঞানময় কোরান।
বিখ্যাত ধর্ম বিজ্ঞানীগণ এই বিষয়ে একমত যে, “ক্বাফ অল কোরানেম মজিদ” এই কথার লিখিত তাবিজ ব্যবহার করিলে ধনবান হওয়ার ক্রিয়া উহাতে বিদ্যমান রহিয়াছে।
*১.’ওয়া’ অর্থ সাক্ষী, প্রমাণ, দলিল। ওয়া দ্বারা কোরানে কোথাও শফথ বুঝাইবেনা। আল্লাহ্‌র কথাই যথেষ্ট। তাঁহার পক্ষে সফথ করিয়া কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। তাহা ছাড়া শফথ করিতে গেলে তাহা অপেক্ষা যিনি অধিক বড় হইবেন তাহার শফথ করিতে হয়। এইজন্য আল্লাহ্‌ কাহারও শফথ করিয়া কথা বলিতে পারেন না, সাক্ষী করিতে পারেন।
*২. মাজিদ= জ্যোতির্ময়, গৌরবান্বিত, সম্মানিত, মহিমান্বিত।

*8. সালাত।
আত্মদর্শন উদ্দেশ্য শেরেক হইতে মুক্ত হইবার জন্য দায়েমি সালাত পালনের আহ্বান।সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টার নাম সালাত। রসুলের সংযোগই আল্লাহ্‌র সংযোগ। এই সংযোগ অর্থাৎ সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা ও তাঁর পরিচয় দ্রষ্টব্য ৭০:২২-৩০,৩২-৩৫). ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য।
কর্মই সালাতের উপদান। এই কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলিয়াছেনঃ “সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে যথাবিহিত সম্পাদনের নাম সালাত।” সকল কর্ম ও চিন্তাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাহার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত দেখিবার নাম সালাত। কর্মকে যতই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করিয়া দেখা যায় ততই সালাতের গভীরতা আসে।

No comments:

Post a Comment