Monday, July 4, 2016

মুসল্লির চরিত্র (৭০:১৯-৩৫)

মুসল্লির চরিত্র (৭০:১৯-৩৫)
১৯. নিশ্চয়ই ইনসানকে রূপান্তর সৃষ্টি করা হইয়াছে দুর্বলচিত্তরূপে;
২০. যখন মন্দ তাহাকে স্পর্শ করে তখন হয় ধৈর্যচ্যুতি;
২১. এবং কল্যাণ যখন তাহাকে স্পর্শ করে তখন হয় কৃপণ;
২২. মুসল্লি ব্যতীত—
২৩.(মুসল্লি তাহারা) যাহারা তাহাদের সালাতের উপর চিরকাল সার্বক্ষণিকভাবে থাকে।
২৪. এবং তাঁহারাই তাহাদের মালের মধ্যে (অর্থাৎ আগমনরত ধর্মরাশির মধ্যে) ন্যায় সম্বন্ধে (অর্থাৎ সালাত প্রক্রিয়া প্রয়োগ সম্বন্ধে) সুপরিজ্ঞাত আছে।
২৫. অবিরামভাবে প্রার্থীর জন্য এবং বঞ্চিতদের (জন্য)।
২৬. এবং তাহারাই ধর্মের কালের সহিত সত্যায়নকারী।
২৭. এবং তাহারাই তাহাদের রবের শাস্তি হইতে ভীত।
২৮. এবং তাহারাই তাহাদের রবের শাস্তি নিরাপত্তাবিহীন।*1
২৯. এবং তাহারাই তাহাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য যত্নশীল;
৩০. তাহাদের সঙ্গি-সঙ্গিনীর উপরে (কর্তব্যপরায়ণ অবস্থায় থাকা) ব্যতীত অথবা তাহাদের ডান হাতের অধিকার আছে (অর্থাৎ অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর কর্তব্যপরায়ণ থাকা অবস্থা ব্যতীত), সুতরাং নিশ্চয় তাহারা দোষণীয় নয়।
৩১. সুতরাং যাহারা এর অসীম পিছনের আকাঙ্ক্ষা করে তাহা হইলে তাহারা সীমালঙ্ঘনকারী।
৩২. এবং তাহারাই তাহাদের আমানত ও ওয়াদার জন্য রক্ষাকারী।
৩৩. এবং তাহারাই তাহাদের (বিষয় রাশির) সাক্ষ্যদানের সহিত দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকে।
৩৪. এবং তাহারাই তাহাদের সালাতের উপর হেফাজত করে।
৩৫. সর্বযুগেই ইনারা জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত হয়ে আছেন।

১৯ নং হইতে আরম্ভ করিয়া ৩৫ নং বাক্যে মুসল্লি ব্যক্তির চরিত্রগত স্বরূপ ও সংজ্ঞা প্রকাশ করা হইয়াছে।

টীকাভাষ্যঃ*1.রবই নিরাপত্তা দাতা। নিরাপত্তাহীনতাই আজাব। সৃষ্টির মধ্যে নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করাই রবের আজাব। রব হইতে নিরাপত্তা লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের শাস্তির মধ্যেই বাস করে, মুসল্লি এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ এবং অনুভূতিশীল।

মুসল্লিঃ—১ দুঃখ-বিপদে অস্থির হওয়া সুখ-সম্পদে কৃপণ হওয়া মানুষের স্বভাব। কারণ, মানুষ জন্মগতভাবেই দুর্বলচিত্ত। চিত্ত দৌর্বল্যের এই ত্রুটি হইতে মুসুল্লি-চরিত্র মুক্ত হইয়াছে। দুঃখ-সুখ উভয় অবস্থায় মুসুল্লি ধীর-স্থির।
২। সালাত যে করে তাহাকে মুসুল্লি বলে এবং মুসুল্লির কার্যক্রমকে সালাত বলে। মুসুল্লির সালাত ‘দায়েমি’ অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা পরিব্যপ্ত। সারাদিনের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তা যে-সমস্ত ধর্মরাশি ও সংস্কার মস্তিষ্কে উৎপন্ন করে তাহাদের গ্রহণ-বর্জন রসুলাল্লাহর নির্দেশিত ধারায় সুসম্পন্ন করিতে যত্নবান থাকে। অনুমদনের বাইরে কিছুই করেন না।
৩। সপ্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বার পথে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ধর্মরাশি আমাদের মস্তিষ্কে আগমন করে এবং বিভিন্ন সংস্কার তৈরী করে। ধনী, গরিব, নিঃস্ব সবাই আপন আপন মস্তিষ্কে যে সংস্কার জমা করে তাহাই তাহাদের মাল। এইভাবে প্রতিটি বস্তুবাদী মানুষ প্রচুর মালের অধিকারী। একজন মুসল্লি মনের মধ্যে আগত ধর্মরাশির উপর সালাত প্রক্রিয়া প্রয়োগ করিয়া ইহা দ্বারা সংস্কার উৎপন্ন হইতে দেয় না। ধর্মরাশির উপর ইহাই আল্লাহ্‌র আদেশকৃত ন্যায়-বিচার। আপন মালের উপর মুসল্লি যেইরূপভাবে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠায় সুপরিজ্ঞাত ঠিক একইভাবে সে তাহার শিষ্যবর্গ, যাহারা সালাত শিক্ষায় উদগ্রীব, এবং যাহারা এই শিক্ষা হইতে বঞ্চিত, তাহাদের মালের উপর ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার শিক্ষা প্রদানেও সর্বক্ষণ যত্নবান থাকে।
৪। প্রতিটি কর্ম ও চিন্তা এক একটি কাল লইয়া আমাদের মস্তিষ্কে উদয় হয় এবং গত হইয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিটি ধর্ম (বস্তু বা বিষয়) এক একটি সময়ে সীমাবদ্ধ থাকিয়া মনের মধ্যে উদয়-বিলয় হয়। বস্তুবাদী মন এই সকল বিষয় বস্তুতে ডুবিয়া থাকে বলিয়া ইহার উদয়-বিলয় নিরপেক্ষ মনে প্রত্যক্ষ করিতে পারে না, আর তাই ধর্ম রাশির অন্তর্নিহিত সত্যও উদঘাটন করা সম্ভব হয় না। ধর্মরাশির উপর সালাত পালন করিবার অর্থই হইল প্রতিটি ধর্ম যে বিষয় লইয়া মস্তিষ্কে আগমন করে সেই সময় সেই ধর্মকে মনকে ডুবাইয়া না রাখিয়া তাহাকে অণু অণু করিয়া প্রত্যক্ষ করা এবং ধর্মের উপর নিজেকে ভাসাইয়া রাখা। ইহা করিতে পারিলে সেই ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য বাহির হইয়া আসে এবং সালাত পালনকারী ইহার উপর সত্যদ্রষ্টা হইয়া যায়। এইভাবে একজন মুসল্লি তাহার সপ্ত ইন্দ্রয়ের পথে আগত ধর্মরাশির উপর সালাত প্রয়োগ করিয়া প্রতিটি ধর্মের কালের সহিত সত্যায়নকারী হইয়া উঠেন। দুনিয়ার জীবন নিরাপত্তাহীন শাস্তিমূলক। ধর্মের কালকে যাহারা জয় করিতে পারিয়াছেন তাহারা এলহাম দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকেন। রব তাহাদের প্রত্যক্ষ পরিচালক। মুসল্লি দুনিয়ার শাস্তির ভয়ে অত্যন্ত ভীত। রবের সংযোগে যদি কখনও ব্যাঘাত ঘটিয়া ক্ষণিকের জন্যও দুনিয়ায় পদস্খলন ঘটে, রবের তরফ হইতে এইরূপ শাস্তির ভয়ে তাহারা সন্ত্রস্ত হইয়া থাকেন। অপর পক্ষে যাহারা দুনিয়ার অধিবাসী তাহারা দুনিয়ায় বাস করা যে কিরূপ শাস্তির বিষয় তাহা অনুভব করিতেও পারে না। এখানে উল্লেখ্য যে, এই পৃথিবীতে বাস করা আর দুনিয়ায় বাস করা এক কথা নয়। ‘দুনিয়া’ বস্তুবাদী মনের মস্তিষ্কে জন্ম লাভ করে।
৫। সপ্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ যে ধর্মরাশিকে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করিতেছে তাহা মানব মনে স্মৃতি ও সংস্কাররূপে জমা হইয়া জাহান্নামে রচনা করিতেছে। ইহার উপর সালাত করিলে ঐ ধর্মরাশি মস্তিষ্কে কোন ছায়া ফেলিতে পারে না অর্থাৎ মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সংস্কার শূন্য হইয়া উঠে। একজন মুসল্লি যেহেতু ২৪ ঘণ্টাই সালাতে নিমগ্ন থাকেন তাই তিনি সংস্কারমুক্ত প্রশান্তময় এক মানসিক হালে বিরাজ করেন। তার এই মানসিক প্রশান্তি তিনি তার ব্যক্তিগত সময়ে পুরোপরি ধরিয়া রাখেন। কিন্তু এই পার্থিব জীবনযাত্রায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেহেতু বিভিন্ন মানুষ ও অধীনস্থদের সাথে লেনদেন ইত্যাদি  মানসিক বিষয়ে কর্তব্যপরায়ণ থাকিতে হয় সেইসব ক্ষেত্রে মানসিক প্রশান্তির হাল কিছুটা হইলেও বিঘ্নিত হয়। ইহা তাহার জন্য দোষণীয় নয় যেহেতু তিনি পার্থিব কর্তব্য শেষ হইলে পুনরায় তাহার মানসিক প্রশান্তির হালে চলিয়া আসেন এবং লেনদেনরত অবস্থায় বিষয় বা ব্যক্তিগণকে তাহার মস্তিষ্ক হইতে সম্পূর্ণ সরাইয়া ফেলেন। যে সময় অতীত হইয়া যায় তাহার স্মৃতি কিংবা তাহার প্রতি কোনরূপ অনুরাগ বা বিরাগ কিছুই তাহার মস্তিষ্কে ঠাই পায় না। অর্থাৎ তিনি কখনই অতীতের দিকে বা পিছন পানে তাকান না। ‘পিছনে’ শব্দটির উপর বড় মদ বসাইয়া ইহাকে অসীম বা অনন্ত পিছনের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে, অর্থাৎ বিগত জীবনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। একজন মুসল্লি তাহার বিগত জীবনগুলিতে দায়েমি সালাত পালন না করিবার কারণে মানসিক অশান্তি ও দুঃখ-জ্বালা ভোগ করিয়াছেন। পার্থিব লেনদেনের বিষয়গুলোকে মনে ধরিয়া রাখিয়া আপন মানসিক প্রশান্তির হালকে বিঘ্নিত করিয়াছেন। সেই জীবনগুলোর স্বভাব তাহাকে ডাকে না অর্থাৎ অসীম পিছনের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করিয়া তিনি শুদ্ধ হইয়াছেন। তাই এখন তাহার মস্তিষ্ক অতীত ঘটনাকে ধরিয়া রাখার স্বভাব মুক্ত হইয়াছে। আর তাই এই পার্থিব লেনদেনের সময় সঙ্গী-সঙ্গিনী বা অধীনস্থদের সাথে কর্তব্যপরায়ণ থাকিবার জন্য যতটুকু মানসিক মনোযোগ দিতে হয় ততটুকু অধিক তিনি দেন না এবং বাকি সময়টুকু সম্পূর্ণ সংস্কারহীন অবস্থায় থাকিতে সচেষ্ট থাকেন। ইহা না করিলে সীমালঙ্ঘনকারীদের দলভুক্ত হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬। মুস্ললিরূপে পরিগণিত হওয়ার আর একটি শর্ত হইল আমানত এবং ওয়াদা রক্ষা করা। আমানত ও ওয়াদা দুই প্রকারঃ আল্লাহ্‌র আমানত এবং মানুষের আমানত। আল্লাহ্‌র নিকট ওয়াদা এবং মানুষের নিকট ওয়াদা। আল্লাহ্‌র আমানত সম্বন্ধে কোরানের (৩৩:৭২-৭৩) বাক্যে উল্লেখিত আছে। অতি শুদ্ধ চরিত্র মহান ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্য লোকের পক্ষে আল্লাহ্‌র আমানত রক্ষা করা অসম্ভব ব্যাপার। অপরপক্ষে মানুষের আমানত অর্থ হইলঃ যাহার উপরে যে সামাজিক কর্তব্য ন্যস্ত আছে তাহা যথাযথ পালন করা। আমরাই সবাই দুনিয়ার জন্ম লইয়া আসিবার পূর্বে রবের নিকট এই ওয়াদা করিয়া আসিয়াছি যে, দুনিয়াতে যাইয়া আল্লাহতালাকে রবরূপে গ্রহণ করিয়াই জীবন অতিবাহিত করিব, কিন্তু এখানে আসিয়া অঙ্গীকার ভুলিয়া গিয়াছি এবং সকল বিষয়ে রবের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছি (৭:১৭২-১৭৪ দ্রষ্টব্য)। মানুষের নিকট যে সব অঙ্গীকারে আমরা আবদ্ধ হইয়া থাকি তাহা আমরা পালন করিবার চেষ্টা করিয়া থাকি। ‘আমানত এবং ওয়াদা’ এর দ্বিমুখী কর্তব্য পালন করা মুসল্লি বলিয়া পরিগণিত হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত।
৭। সাক্ষ্য দান ব্যাপারে মুসল্লি অত্যন্ত দৃঢ় ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান থাকনে। কোনরূপ ভয়ভীতি বা লাভলোকসানের চিন্তা তাহাকে সঠিক সাক্ষ্য দান বিষয়ে কোনরূপ অবস্থাতেই বিচলিত করিয়া তুলিতে পারে না।
৮। যাহারা মুসল্লি তাহারা তাহাদের সালাতের উপর হেফাজতকারী হইয়া থাকেন, যাহাতে জীবনের কোন কর্ম ও চিন্তা সালাতের বহির্ভূত হইয়া না পড়ে। মুসল্লির কার্যক্রমকে সালাত বলে। সালাত পালনকারীকে মুসল্লি বলে। এক কথায় কোরানের উল্লেখিত ‘সালাত’ এর অর্থ আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা।
৯। উল্লেখিত আট প্রকার গুণের অধিকারী যাহারা হইয়া থাকেন তাহারাই মুসল্লি। মুসল্লিগণ কেরামত প্রাপ্ত এবং অত্যন্ত সম্মানিত। জীবদ্দশায় এখান হইতেই তাঁহার জান্নাতে অবস্থান প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। তাহারা জান্নাতে আছেন এবং থাকিবেন।
(কোরান দর্শনঃ সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী)

No comments:

Post a Comment